ইন্টারভিউ দেখতে বেশ ভালো লাগে আজকাল। মেকী ইন্টারভিউ নয়, সামান্য মন-খোলা এবং সোজাসাপটা প্রশ্নোত্তর-সম্বলিত ইন্টারভিউ। কিংবা শুধু ভালো আলোচনাও চলতে পারে। সেসব কথোপকথনে যদি নতুন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়, তবে আরও বেশি পছন্দ হয়। এহেন একটি ইন্টারভিউতে কবীর সুমন একবার বলেছিলেন, কিছু গান আছে, যেগুলোতে গলায় আবেগ না এনে, সোজাসুজি গাইতে হয়। "এ তুমি কেমন তুমি" গানটার প্রসঙ্গে, জাতীয় পুরস্কারের পর উনি এই মতামতটা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়, অনেক গানের ক্ষেত্রেই এই কথাটা খাটে, বিশেষত বেশ কিছু রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে তো বটেই। আসলে অনেক গানের ক্ষেত্রে, কথা ও সুরটাকেই তার ম্যাজিকটা করতে দিতে হয়, কণ্ঠ্য শুধু কিছু nuance-কে ধরতে সাহায্য করে। "এমন দিনে তারে বলা যায়" - এমনই একটা গান।
মাঠের ধারে গাছের তলায় বসে এসব কথা ভাবছিলাম। ঠিক তখনই হেডফোনে "এমন দিনে তারে"-গানটা শুরু হল, ইমনের গলায়। নাহ, ইমন বড্ড আবেগ দিয়েই গাইছেন, সুমনের বলা নীতিকে ভেঙে দিয়ে। রূপঙ্কর মনে হয় এর থেকে ভালো গেয়েছেন। তবুও কেন জানি না, গানটার সাথে বয়ে চললাম। ইমনের একটা ইন্টারভিউতে পড়েছিলাম, উনি যখন "তুমি যাকে ভালোবাসো"-গানটা রেকর্ড করেন, তখন সদ্য পুরোনো সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে। ফলে ওই গানটি খুব নির্লিপ্তভাবে গেয়েও সমস্ত আবেগ ঢেলে দিতে পেরেছিলেন। E minor-কর্ডের সমস্ত বিষাদ ওঁর কণ্ঠ্য ছুঁয়ে আমাদের সকলের হৃদয়ে আছড়ে পড়েছিল। কিন্তু এই গানটিতে কি ইমন একটু বেশিই ভেসে গেছেন তার প্রাক্তনের সাথে কাল্পনিক আলাপচারিতায়, তাই নির্লিপ্ত থাকতে পারেননি?
বেশ উজ্জ্বল ঝকঝকে নীল আকাশে টুকরো কিছু সাদা মেঘই দেখছিলাম এতক্ষন, বেশ মনোরম বাতাসও বইছিল। কিন্তু ইমনের "এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে, তপনহীন ঘন তমসায়"-গাওয়াতেই একটা কাল্পনিক আঁধার নেমে এলো। আমি আকাশের দিকে চেয়ে থেকেই দেখলাম, একটা খয়েরি রঙের গোলটেবিলের দুপ্রান্তে মুখোমুখি বসে আছে - একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। টেবিলের ওপর রাখা আছে, একটি স্ট্যান্ডের ওপর নরম আলোর মোমবাতি। ইমন গেয়ে উঠলেন,
"""
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার ।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার–
জগতে কেহ যেন নাহি আর ॥
"""
সামান্য রাগই হল রবি ঠাকুরের ওপর। এভাবে দু'জনকে মুখোমুখি বসিয়ে দিলেন, হঠাৎ এতো বছর বাদে, জীবনের সায়াহ্ন যখন দুজনকেই হাতছানি দিচ্ছে ! ইজাজত-এর নাসির-রেখার মনে ঠিক কি চলছিল, একটু যেন অনুভব করলাম। এতো সহজে যে সহজ হওয়া যায় না, আগের জটিলতাগুলোকে পেরিয়ে আসা যায় না, তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। রবি ঠাকুর সেই বুঝেই বোধ হয় নির্দেশ দিলেন, উচ্চৈঃস্বরে, "দেশ" রাগের সম্বাদী স্বর "পা" ছুঁয়ে পরের octave-এর "সা" ছুঁলেন।
"""
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব ।
""""
"কলরব"-এর তীব্রতা ধরতেই বোধ হয় রবি ঠাকুর "সা"-তে অনেকক্ষন সুরটাকে ধরে রাখলেন। কিন্তু সেই তীব্র প্রতিঘাতে আমরা সেই যে জীবন-সমাজকে পিছনে ফেললাম, তারপর তো আমাদের সামনে শুধু আমরাই থাকতে পারতাম। আমি ডুবে যেতাম তোমার চোখে, যে চোখে কোনো কলুষ ছিল না। তুমি আশা দেখতে আমার চোখে। আর সেই আশায় আমরা নিমজ্জিত হতাম হৃদয়াবেগের সাগরে। ইমন তখন গাইছেন,
"""
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব–
আঁধারে মিশে গেছে আর সব ॥
"""
হ্যাঁ, আমাদের অতীত-দুশ্চিন্তা-সঙ্কোচ তখন যেন আঁধারে হারিয়ে গেছে। এভাবেই ওগুলো অদৃশ্য হোক। তবেই বোধ হয় আমরা বলতে পারবো সমস্ত কথা খোলামনে। আমাদের যে মন একে ওপরের কষ্ট সত্যিই দেখতে চাইতো না। আমি জানি যে, তুমি কখনোই চাওনি আমার চোখে দুঃখ দেখতে। তুমিও জানো যে, আমি চাইনি। কিন্তু আজ আমরা সেই অযাচিত দুঃখ-কষ্টকেই স্বীকৃতি দেব স্বীকারোক্তির সুরে। আমাদের অন্তরজ্বালা ধুয়ে যাবে সেই সততার আবহে। রবীন্দ্রনাথ "দেশ" রাগের বাদী "রে", সম্বাদী "পা" আর "মা" -কে নিয়ে নতুন দ্যোতনা তৈরী করবেন এবং ইমন গাইবেন,
"""
তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার ।
শ্রাবণবরিষনে একদা গৃহকোণে
দু কথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার ॥
"""
কিন্তু সত্যিই কি কিছু যাবে আসবে না? তোমার বর্তমান প্রিয়তম কি মেনে নেবে এই সুস্থ সরল বাক্যালাপ? আমার বন্ধু-বান্ধবী আর মনের কাছের মানুষ কি মেনে নেবে তোমার-আমার এই বাঁধনছাড়া কাব্যের আলিঙ্গন? জানি তারা খুব ভালোবাসে আমায়; তোমার ক্লেদাক্ত অবয়বটার কাছে আমায় যেতে দিতে চায় না। কিন্তু তুমি তো আজ "এমন দিনে", তোমার সমস্ত গ্লানি মুছে শুধু স্বচ্ছতার প্রতিমূর্তিতে আবির্ভূত - এ কথা আমি তাদের বোঝাতে পারি না। নিজেকেও বোঝাতে বড় কষ্ট হয়। আমিও তো জানি, যে "তুমি"-কে আজ আমি কল্পনা করছি এখন, অথবা আগেও করেছি, তার কোনো বাস্তব অস্তিত্বই নেই। ভালোবাসা তো আসলে অন্তরে চাওয়া মানুষটির স্রেফ প্রতিফলন। পৃথিবীতে কোনো মানুষেরই ভালোবাসার বাস্তব প্রতিরূপ বলে তো কিছু হয় না। পুরোটাই কাল্পনিক মূর্তি-গড়া। রবিবাবু ভালোবাসার এই অসম্ভবতা অনুধাবন করলেন এবং ইমন গাইলেন,
"""
ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়,
বিজুলি থেকে থেকে চমকায় ।
"""
এখানে আবার রবিবাবু উঁচু স্বরের আশ্রয় নিলেন উদ্বেলিত বাতাসকে বয়ে আনতে, অসম্ভবকে প্রকাশ করতে। তা'ও আমাদের এই কাল্পনিক দেখা হওয়া তো মিথ্যে হতে পারে না, হোক না সে যতই অস্বাভাবিক। আবহাওয়া আর বিশ্ব-সংসারের বিদ্রোহেও, আমরা একে অন্যকে জানালাম আমাদের নিজেদের দিকগুলো, ভুলগুলো-ঠিকগুলো।
"""
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়–
""""
মন আমাদের বহুকালই শান্ত হয়েছিল, আমরা বোধ হয় এবার পরিশ্রান্ত হলাম। আমরা আবারও বুঝলাম, দোষারোপের ভার সময়েরই নেওয়া দরকার, আমরা যে স্রেফ তার গোলামের কাজ করছিলাম। ভালোবাসা আমাদের গভীরে থাকলেও, কবর খুঁড়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল।
আকাশের দিকে তাকিয়ে এই নাট্যচিত্র দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলাম যে, তুমি, টেবিল, মোমবাতি - সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আর যেন কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চোখে আর্দ্রতার অস্বচ্ছতা ঘনিয়ে আসছে। ইমন তখন গান শেষ করছেন,
"""
এমন ঘনঘোর বরিষায়
এমন দিনে তারে বলা যায়।।
"""
পুনশ্চ: আমাদের এই কথোপকথনের পরেও একটা গান হওয়া প্রয়োজন ছিল, তাই "আমার ভিতর ও বাহিরে" শুরু হল। যেন বলে গেলো, চিঠিগুলো যেন আমরা আকাশের উদ্দেশ্যেই লিখি, একে-অপরকে নয়।