Saturday, April 14, 2018

বাংলা গানের আধুনিকতা । Modernism in Bengali Songs (~১৩ মিনিট)

বাংলা গানের আধুনিকতা (~ ১৩ মিনিট)
---
ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, উৎপল দত্ত। সংস্কৃতির তিনটে ধারায় এই তিন বাঙালি ঠিক কি বিপজ্জনক কাজটা করেছিলেন, তা ৭০-এর দশক থেকেই মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায়। ওনাদের সৃষ্টির মূলে যে অসন্তোষ, সে ধরণের কাজই আধুনিকতার সংজ্ঞা তৈরী করে, বারবার করেছে, সে আমরা যে যুগেই থাকি না কেন। পৃথিবীর যে কোনো জায়গার যে কোনো আধুনিক শিল্প বেছে নিলেই, এই সাহসী চিন্তাভাবনার ছোঁয়া দেখতে পাবেন। কিন্তু বাঙালির ক্ষেত্রে গত ৭০-৮০ বছর ধরে, সংস্কৃতির আধুনিকতার একটি সমান্তরাল উৎস, অনুপ্রেরণা লক্ষ্য করা যায়। অন্তরে বয়ে যাওয়া সেই আধুনিক সৃষ্টির ফল্গুধারাতেই কি খানিকটা চরা পড়েছে সাম্প্রতিক ইতিহাসে? এখনকার বাংলায় যে শিল্প সৃষ্টি হচ্ছে তা কি "আধুনিক" শিল্পের স্তরে উঠতে পারছে? বা এই শিল্প সমকালীন সমাজ বা অসন্তোষকে কি ধরতে পারছে? নেতিবাচক উত্তরের দিকেই কিন্তু পাল্লা ভারী রাখতে হচ্ছে। আরো বড় প্রশ্ন, যদি সত্যিই সেই আধুনিকতার জোয়ারে চড়া পড়ে থাকে, তার কারণটাই বা কি? এই লেখাতে সেটা খোঁজারই চেষ্টা করবো, তবে শুধুমাত্র সঙ্গীতশিল্প তথা গানের দৃষ্টিভঙ্গিতে। লেখাটা পড়া শুরু করবার আগেই বলে দেওয়া ভালো, আমি এখানে শিল্পকে আমার আধুনিকতার স্তর থেকে দেখছি, যা চারপাশের সমাজের কথা বলে, আবার মানবিকতার কথাও বলে। আধুনিকতার সামান্য অন্য সংজ্ঞাও আছে, তবে আমার সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক গানের কথাই বলতে চাইছি ; সেটা মাথায় রেখেই লেখাটা পড়া কাম্য।

একটু ইতিহাসের খোঁজে যেতে হবে আমাদের। বিংশ শতাব্দীতে বাংলা গানকে মার্গসংগীতের আড়াল থেকে বের করে এনে, রবীন্দ্রনাথ সকলের ঘরে পৌঁছে দিলেন, একান্ত ব্যক্তিগত করে। সেই সুরে রাগাশ্রয়ী সঙ্গীতের আড়ম্বর নেই। ফলে বাংলা গানের সুরের ক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথকে এক বিপ্লব বলতেই হয়। তবে গানের কথার ক্ষেত্রে আমরা পেলাম, আধুনিকতার থেকেও বেশি অন্তরঙ্গতাকে। সেই গানগুলোর চিরন্তন প্রাসঙ্গিকতা, আনুগত্য হয়তো রবীন্দ্রনাথকে চিরআধুনিক করেছে শিল্পের কোনো এক আঙ্গিকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানে সমসাময়িক সমাজকে ধরার চেষ্টা মূলত নেই; এটা অনেকাংশে মেনে নেওয়াই বাঞ্চনীয় বলে মনে হয়। তার থেকে অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, এবং সর্বোপরি কাজী নজরুল ইসলাম - তৎকালীন ভারতবর্ষের দৈন্য অবস্থা, গানের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ ও ধারাবাহিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমরা তাঁদের গানে শুনতে পাচ্ছি সদ্য জন্ম নেওয়া দেশাত্মবোধের ধ্বনি, অনেক বেশি করে। নজরুল "ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম" হয়ে বলছেন "কারার ওই লৌহ কপাট" ভেঙে ফেলার কথা। তখনকার সংগ্রামের বক্তব্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল নজরুলের সুরের বৈচিত্র্য, জটিলতা আর ধার। বিপ্লবের সমার্থক হয়ে উঠছেন নজরুল।

নজরুলের পরে একই ধরণের রাজনৈতিক মানসিকতার আবহে, সঙ্গীতের জগতে আমরা পাচ্ছি সলিল চৌধুরীকে। শুধু সলিলবাবুকে নিয়েও একাধিক প্রবন্ধ লেখা যায়। কিন্তু আমাদের বিষয়ের পরিসরে বললে, উনি বাংলা সংগীতের আধুনিকতাকে যেন নতুন মাত্রা দিলেন। আমার মতে, এখনো অব্দি কোনো বাংলা সুরকার-গীতিকার সলিল চৌধুরীর মতো বাস্তব-সচেতন কাজ করে যেতে পারেননি। সলিল চৌধুরী গান লিখছেন স্বাধীনতার ঠিক প্রাক্কালে, গণনাট্য সংঘ (IPTA)-এর সাথে কাজ করবার সূত্রে। তিনি তার বাংলা গানের সুরের মধ্যে এনে ফেলছেন বেঠোভেন, মোৎজার্টকে। সেটা যেমন নতুনত্ব, তেমনি তার কথায় উঠে আসছে চারপাশের বিপ্লবী আবহ। সলিল চৌধুরীর সুর আর কথা একসঙ্গে মিলে যে অভূতপূর্ব দ্যোতনা তৈরী করছে, তা মিটিং-মিছিলের উত্তেজক মেজাজ তৈরী করে দিচ্ছে। তার গানের কথায় আমরা সরাসরি অনুপ্রেরণা পাচ্ছি, "আহ্বান, শোনো আহ্বান"-এর মধ্য দিয়ে। তিনি আমাদের "আলোর পথযাত্রী" করছেন, ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের শত হতাশার মধ্যেও। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের একত্রিত হতে ডাক দিচ্ছেন, "পথে এবার নামো সাথী।"

কিন্তু ১৯৪০-এ সলিলবাবু তো পরিচিত কোনো মুখ নন। তাহলে তিনি উঠে আসছেন কি ভাবে? আগেই বলেছি গণনাট্য সংঘের সঙ্গীতের ধারা তাকে তুলে আনছে। কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন আন্দোলনের মঞ্চে উনি গান গাইছেন, কখনো কখনো হয়তো শুধুমাত্র একটা হারমোনিয়াম নিয়েই। হাজার হাজার মানুষ উদাত্ত কণ্ঠে একসাথে ওনার গান গাইছে। ওনার গান কিন্তু তখনও রেকর্ড হয়নি, শুধুমাত্র মানুষের কন্ঠ্যে সে গান জীবিত থাকছে। বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আধুনিক শিল্পের এই পৃষ্ঠপোষকতা, শুধু গানে নয়, ছায়াছবি, নাটক, সবেতেই ছিল। ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত এমনকি মানিক বন্দোপাধ্যায় - সকলেই একসময় সক্রিয়ভাবে কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ করেছেন। বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব বাইরের রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে, মহারাষ্ট্রে তখন IPTA-এর হিন্দি নাটক হচ্ছে। বলরাজ সাহানি, পৃথ্বিরাজ কাপুর তার সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। যাই হোক, গানে ফিরে আসা যাক। 

সলিলবাবুর গান ১৯৫০-৬০-এর দশকে রেকর্ড হলো, তার পরেও মানুষকে তৎকালীন সমাজ সম্পর্কে চেতনা যোগাচ্ছে, অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। এর মাঝে যে অন্য ভালো গান হচ্ছে না, তা কিন্ত নয়। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, নচিকেতা ঘোষ - দারুন সব সুর সৃষ্টি করছেন বাংলা ফিল্মে, কিন্তু তাঁরা গানের আধুনিকতাকে ছুঁতে পারছেন না, কথার বন্ধ্যাত্বে। এরপর ১৯৭০-এর টালমাটাল দশক পেরিয়ে আমরা পৌঁছচ্ছি ১৯৮০-এর দশকে। এই সময় একটি আমেরিকা-ফেরত যুবক চেষ্টা করছেন, আবারো বাংলা সংগীতে আধুনিকতার নতুন সংজ্ঞা যোগান দেওয়ার। ১৯৮৬ সালে "তোমাকে চাই"-এর মতো কিছু গান লেখার চেষ্টা করে অসফল হয়ে, আবারো ফিরে আসছেন ৯০-এর দশকে বাংলা সংগীতের খোলনলচে বদলে দিতে।

সুমনের মতো প্রিয়তমকে অভিবাদন জানানোর আগে মনে রাখতে হবে, ৯০-এর দশকের আগেই কিন্তু সুমনের সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশোনা হয়েছে, ৬০-৭০-দশকের নকশাল আন্দোলনে উনি প্রভাবিত হয়েছেন, লাশ বয়ে যেতে দেখেছেন কলকাতার মাঝে খাল দিয়ে। উনি আবারো শিল্প সৃষ্টি করছেন, বাস্তবের মধ্যে থেকেই, কিন্তু তার সাথে এক জীবনদর্শনও তার গানে ধরা পড়ছে। যে দর্শন একসাথে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বলে, শিহরিত হয় "লাল নিশান" দেখে, আবার এই স্বপ্নও দেখে যে "সেনাবাহিনী বন্দুক নয়, গোলাপের তোড়া হাতে কুচকাওয়াজ" করবে। আর এই গানকে প্রথম তুলে ধরছে সিপিএমের রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল। শুভেন্দু মাইতির মতো কমিউনিস্ট আদর্শের মানুষ সুমনকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করছেন, গান গাইবার মঞ্চ তৈরী করে দিচ্ছেন। এরপর ধীরে ধীরে সারা বাংলায় একটু একটু করে, সমস্ত ৯০-এর দশক জুড়ে ঘরে ঘরে আলোচনার বিষয় হয়ে যাচ্ছে, "মরবো দেখে বিশ্ব জুড়ে যৌথ খামার।" মনে রাখতে হবে, তখন সোভিয়েত ভেঙে গেছে, নকশাল আন্দোলন শেষ, কিন্তু তবুও বাঙালি সমাজ-বদলানোর গানকে স্বাদরে গ্রহণ করছে।

২০০০ সালের কিছু আগে, সুমনের পরে বাংলা ব্যান্ডের উত্থান হচ্ছে। সেখানে আমরা নতুন করে পাচ্ছি ৭০-৮০-এর দশকে তৈরী হওয়া কিছু গান, মহীনের ঘোড়াগুলির পৃষ্ঠপোষকতায়। বাংলার সমস্ত বিখ্যাত ব্যান্ডই স্বীকার করে যে, তাদের উত্থানের পিছনে মহীনের ঘোড়াগুলির প্রতিষ্ঠাতা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ই অনুপ্রেরণা। সেই গৌতমবাবু আবার ৭০-এর দশকে কংগ্রেস সরকারের তাড়া খেয়েছেন নকশাল আন্দোলনের জন্য। তাঁর এবং রঞ্জন ঘোষালের গানেও যে "ওরা কাজ করে, গ্রামে বন্দরে, শুধুই ফসল ফলায়, ঘাম ঝরায় মাঠে-প্রান্তরে"- এসবের কথা উঠে আসবে, তা খুব স্বাভাবিক। বাংলা ব্যান্ডের উঠে আসার পিছনেও আমরা একই ধরণের সমাজতান্ত্রিক দর্শনের ছোঁয়া পাচ্ছি। 

এছাড়া সিপিএম পার্টি থেকেও কিছু ক্ষেত্রে (পার্টির স্বার্থেই) আমরা আধুনিক শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা দেখতে পাচ্ছি, আরো বিশেষভাবে নচিকেতার উঠে আসার মাধ্যমে। সুভাষ চক্রবর্তী নচিকেতার গানকে সামনে আনতে সাহায্য করছেন; যদিও সুমনকে রোখার জন্যই নাকি নচিকেতাকে তুলে আনে সিপিএম - এমনটা শোনা যায়। কিন্তু পরে আবার নচিকেতার গান "আমি সরকারি কর্মচারী" - ব্যানও করছে সিপিএমের সরকার। একই কাজ হয়েছে সলিল চৌধুরীর ক্ষেত্রেও। তাঁকেও পার্টির পক্ষ থেকে বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়েছে। কিন্তু এই যে বিকল্প শৈল্পিক ভাবনা গঠন করা এবং তাকে তুলে ধরা - এটা অসংগঠিতভাবে কমিউনিস্ট-ভাবধারার মধ্যে থেকে বাঙালি আত্মস্থ করেছিল। সংগঠিত এবং "রাষ্ট্রীয়" কমিউনিস্ট পার্টি পরে বারবার এই শৈল্পিক ভাবধারার বিরুদ্ধে গেলেও, বাঙালি তাঁর দর্শনটা হারায়নি। কোথাও যেন খুব অন্তরে, বাঙালি সামাজিকতার দর্শনকে লালন করেছে, যে দর্শন সমষ্টির কথা ভাবতে বলে, নিজের স্বার্থের থেকেও বড় উদ্দেশ্যের জন্য। তাই বারবার আধুনিকতার নতুন সংজ্ঞা আমরা পেয়েছি, কখনো তার নাম সুমন, কখনো সলিল, কখনো গৌতম। কোনো একটা উৎস ছিল এই সমসাময়িক এবং আধুনিক শিল্পের বিকাশ ঘটার। 

এবার এখনকার যুগে চলে আসুন। আমাদের সামনে এখন কেন্দ্রীয় সরকারে শুধু নয়, রাজ্যেও খুব বড় ক্রাইসিস। অথচ তার বিপক্ষে সংগীতের তেমন কোনো চলন নেই। ভালো গান হচ্ছে না, তা নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সময়টাকে ধরার বাসনাটা নেই। অথচ এখন YouTube-জাতীয় মিডিয়ামের মধ্যে দিয়ে গানের ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আরো বেশি। কিন্তু সেই ধরণের শিল্পীকে আমরা যেন পাচ্ছি না। দীপাংশু প্যারোডি লিখছেন, বহু মানুষ শুনছেন। এর মানে, মানুষ কিন্তু সরকারের সমালোচনাটা শুনতে চাইছে। কিন্তু সেই শিল্পিত প্রকাশের পরিসরটা যেন কমে গেছে।

আমার মতে, এর একটা বড় দায় সিপিএমেরও। অনেকে ব্যঙ্গ করতে পারেন এই বলে যে, পশ্চিমবঙ্গে সবকিছুর দায়ই তো সিপিএমকেই নিতে হয়। কিন্তু আগে যেভাবে গণসংগীত বা অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে দিয়ে সিপিএম সংস্কৃতিগত আধুনিকতার ধারক ছিল, সেই জায়গাটা সিপিএমের গণসংঠনগুলো হারিয়ে ফেলেছে। ৩৪ বছরের শাসনের জন্য সিপিএমের এই চলমান গতিতেও, মনে হয়, কোথাও যেন জং ধরে গেছিল। তাই একটা খুব বড় শূন্যস্থান তৈরী হচ্ছে, সমসাময়িক এবং আধুনিক শিল্পের।

সেটার আর একটা কারণ হতে পারে বিশ্বায়ন এবং individualism. সমগ্র পৃথিবীতে, এখন সকলেই খুব বেশি করে নিজের ব্যক্তিগত চাহিদা এবং আশাপূরণের কথা ভাবছে। সেখানে সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাভাবনা বড়ই দুর্লভ। বাংলাও এই বিশ্বজুড়ে চলা ট্রেন্ডের বাইরে নয় আর। তাই মানুষের মনে অসন্তোষ থাকলেও তা দানা বাঁধছে না, তা জমে কালো মেঘের গর্জনে পরিণত হচ্ছে না, যে মেঘ চিৎকার করে আহ্বান করতে পারে। যা সলিল করেছিলেন, যা শুনে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। তবে সময় এখনো যে চলে গেছে তা নয়, এই লেখাটার পরেও হয়তো আশার সূর্য আছে। সুমনের গান সকলের সামনে আসতে প্রায় কয়েক বছর সময় লেগে গেছিলো। কে বলতে পারে? হয়তো কোনো নতুন "সুমন", অন্য কোনো নামে, নিজের ঘরে গিটার বাজিয়ে দুঃসাহসী কোনো কথাকে সুরের জ্বালে বাঁধছেন না? অপেক্ষা করছি, আশা করছি, কেউ আবারো জেগে উঠবে, গেয়ে উঠবে:

"যখন প্রশ্ন ওঠে যুদ্ধ কি শান্তি,
আমাদের বেছে নিতে হয় নাকো ভ্রান্তি,
আমরা জবাব দিই শান্তি শান্তি শান্তি।
আর রক্ত নয় নয়!"