কিছুদিন আগে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের Mar-a-lago রিসর্টে সপত্নীক এসেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট Xi Jinping. সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের স্ত্রী, মেয়ে, নাতনীরাও উপস্থিত ছিলেন। মানে অনেকটা ওই ফ্যামিলি গেট-টুগেদারের মতন। তো এরকম পরিস্থিতিতে যেরকম হয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এক নাতনী তার বাচ্চা-বাচ্চা গলায় একটা চীনের গান শোনালো। গানটার আসল মালিক হলেন চীনের খুব জনপ্রিয় গায়িকা Peng, চীনের প্রেসিডেন্ট Xi-এর স্ত্রী। এবার আবার একটু ভাবুন, ঠিক কি ঘটলো। সামরিক দিক থেকে বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্টের নাতনী, বিশ্বের একটি উঠতি দেশের রাষ্ট্রপতির স্ত্রীর গান শোনাচ্ছে। তাও এমন একটা ভাষায়, যা কিনা ইংরাজীর থেকে সম্পূর্ণ রকম ভাবে আলাদা, এবং বিশ্বের অন্যতম কঠিন একটি ভাষা, চীনা ভাষায়।
এবার আর একটা ঘটনার দিকে চোখ রাখা যাক। প্যারিসে কিছুদিন আগে হয়ে গেলো বিশ্বের গুরুত্ত্বপূর্ণ দেশের প্রধানদের নিয়ে আবহাওয়া-বিষয়ক সম্মেলন এবং আলোচনা। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বললেন যে, তারা এই সম্মেলনে সব দেশের মিলিতভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত মানবেন না। কিন্তু অন্য একটি ছোট্ট ঘটনার দিকে আমরা চোখ রাখবো। এই সম্মেলন চলাকালীন, যখন অন্তিম বক্তৃতাগুলি হচ্ছে, তখন সবকটি গুরুত্ত্বপূর্ণ দেশপ্রধানরা মঞ্চে উপস্থিত। সেখানে যখন সবথেকে গুরুত্ত্বপূর্ণ বক্তৃতাটার সময় আসলো, তখন হঠাৎই, আচম্বিতে, জার্মানির রাষ্ট্রপ্রধান Angela Merkel চীনের প্রেসিডেন্ট Xi-কে বলেন এগিয়ে যেতে। Angela-এর সাথে বাকিরাও একই কথা বলেন। Xi খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন, কারণ তিনি এই ঘটনায় একটু চমৎকৃত হয়ে গেছিলেন। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত তিনি বক্তৃতা দেন। কিন্তু এর মানেটা এই, যে বিশ্বের প্রথমসারির নেতারা আবহাওয়ার মতো গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়ে চীনকে অন্যতম প্রধান কান্ডারির দায়িত্ত্ব দিলেন, ভরা মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে ।
প্রশ্ন আসতে পারে, হঠাৎ এই দুটো আপাতভাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা কেন বললাম। কারণ দুনিয়ার power-structure-এ একটা tectonic shift যে আসতে চলেছে, এই দুটি ঘটনা তারই ইঙ্গিতবাহী। ১৯৪০-এর সময় থেকে পৃথিবীর সুপারপাওয়ারের ভূমিকা পালন করছিলো সোভিয়েত এবং আমেরিকা। ১৯৯০-এর পর থেকে সেই জায়গাটার দখল নেয় শুধুই আমেরিকা। কিন্তু গত ১০-১৫ বছরে চীনের দুর্দান্ত গ্রোথ-এর পর আপাতত সেটার পরিবর্তন হতে চলেছে। পৃথিবীকে লিড করার জায়গাটা এখন সারা বিশ্বই তুলে দিচ্ছে চীনের হাতে। সেটা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প (অনিচ্ছায়) হোক, বা জার্মানির Angela Merkel. চীনের অর্থনৈতিক অবস্থার অভাবনীয় উন্নতি চীনকে এখন এই লিড করার জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু চীন কি আদৌ প্রস্তুত এই দায়িত্বে?
মনে করুন, প্যারিসে কিভাবে চীনের প্রেসিডেন্ট অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন, ইতস্তত করছিলেন লিডারের ভূমিকা পালন করতে। ঠিক সেভাবেই, চীন খুব অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন। একাধারে তারা আজ পর্যন্ত কোথাও আমেরিকার মতো বড়দার ভূমিকা পালন করেনি। তারা যেসব আগ্রাসী নীতি ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর, বা জাপানের কাছাকাছি নিয়েছে, তার বেশিরভাগই নিজেদের রক্ষার্থে। সেক্ষেত্রে তাঁদের আমেরিকার মতো লিড করার কোনো ইচ্ছে আছে বলে মনে হয় না। এটা পৃথিবীর সামগ্রিক কূটনীতির দিক থেকে যেমন ভালো খবর, তেমনি থেকে যাচ্ছে কিছু প্রশ্নচিহ্নের জায়গা।
আমেরিকার কাছে এমন একটা শক্তি আছে, যা চীনের ভাণ্ডারে প্রায় নেই। আপনি আমেরিকার সিনেমার কথা শুনতে পাবেন, আমেরিকার গানের কথা শুনতে পাবেন। আমরা বব ডিলান শুনি, Martin Scorsese-র ছবি দেখি, লিওনার্ডো-ডি-ক্যাপ্রিও কে ভালোবাসি। কিন্তু বলুন তো আপনি চীনের শেষ কোন সিনেমাটি দেখেছেন? বা চীনের শেষ কোন গানটা আপনার ভালো লেগেছে? ঠিক এই জায়গাটাই চীনের ক্ষেত্রে খুব আশংকাজনক। আমরা তাদের কালচার সম্পর্কে খুব কম জানি। ফলে, তাদের কাছে আমেরিকার মতো soft-power-টা প্রায় অনুপস্থিত। এই ধরণের রক্ষণাত্মক অবস্থান নিয়ে পৃথিবীকে লিড করা খুব কষ্টকর। কিন্তু চীনের ইতিহাসটাও এক্ষেত্রে জানা প্রয়োজন। যে জাতিটা বারবার বাইরের শক্তিগুলোর দ্বারা সম্পূর্ণ রক্তাক্ত হয়ে নিঃশেষ হওয়ার দোরগোড়ায় পৌঁছেছিল, যে জাতিটা আবহাওয়ার খামখেয়ালি গ্রাসে বারবার বিধ্বস্ত হয়েছে, তারা যে রক্ষণাত্মক নীতি থেকে খুব সহজে বেরোবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
আর সব থেকে বড় উদ্বেগের বিষয় হল চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি। এরা এমনই একটি পার্টি, যার ভিতরের কার্যকলাপ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান শূন্য। আমরা শুধু জানি, এরা meritocracy-তে বিশ্বাস করে, এরা দেশের মধ্যে অনেক সোশ্যালিস্টিক পলিসি নিয়েছে জমি, স্বাস্থ্য এসব বিষয় নিয়ে। আবার আমরা এটাও জানি, এই পার্টিই আমেরিকার উদারবাদের অন্যতম ফায়দা তুলেছে। স্টেট্ ক্যাপিটালিজমের সুযোগ নিয়ে তাঁদের দেশকে এক ধাক্কায় অনেকটা এগিয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই পার্টির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ ব্ল্যাঙ্ক, কারণ এই পার্টি একদমই স্বচ্ছ নয়, বাইরের জগতের পরিপ্রেক্ষিতে। এরা কি আদৌ এদের ম্যানিফেস্টো মেনে চলবেন, নাকি সম্পূর্ণ অন্য দিকে চীন তথা বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, সে সম্পর্কে আমরা কিছুই জানিনা। এরই মধ্যে আরো উদ্বেগের খবর - চিনে গত এক বছরেই মিলিয়নিয়ারের ভালো রকমের সংখ্যাবৃদ্ধি। (যদিও ক্যাপিটালিজমে সেটাই প্রত্যাশিত)
সুতরাং সব মিলিয়ে চীনের এই আবছায়া অবস্থান আপাতত বিশ্বের ভবিষ্যৎটাও বেশ আবছা করে রেখেছে। সামনের কয়েক বছরে ওদের দিকেই আমরা তাকিয়ে থাকবো খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্তের জন্য। তার মধ্যে সব থেকে আগে থাকবে, আবহাওয়ার বিষয়টি। চীন ইতিমধ্যে renewable energy-তে বিপুল ইনভেস্টমেন্ট আরম্ভ করেছে, সেটা আরো অনেকটা বাড়ানো দরকার। এছাড়াও middle-east-এর অনন্তকাল ধরে ঘটে যাওয়া কনফ্লিক্টগুলোর প্রতি চীন কি অবস্থান নেয়, সেটা খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ। চীন আফ্রিকার দিকেও নজর দেওয়া শুরু করেছে, যদিও সেটা ব্যবসার স্বার্থে, কিন্তু আফ্রিকার গরিবদের দারিদ্র্য ঘোচাতে ব্যবসাও সহায় হলে সেটা মানুষগুলোর মঙ্গলেই হবে বলে মনে হয়। আর সর্বোপরি আশা করা যায়, চীন আমাদের আর একটা আমেরিকা হয়ে দেখা দেবে না।
No comments:
Post a Comment