কলকাতা,
তুমি দেখলাম বেশ সেজে উঠেছ। যদিও জানি এর মধ্যে নীল-সাদা টেন্ডারের রাজনীতি আছে। কিন্তু তা নিয়ে নাহয় বাকি বছরটায় বলবো, এখন নয়। এখন তোমার কল্লোলিনী রূপে মুগ্ধ হওয়ার সময়। যে মুগ্ধতা শুরু হয়েছে কৌশানীতে হোটেল-রুমের ঠিক বাইরেই, পাহাড়ের খাঁজে ভোরের সূর্যকে উঠতে দেখে। সেই সতেজ সূর্যের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছিল, পরিশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলো পৃথিবীর সমস্ত কালিমা। সেই বিশুদ্ধতা তোমার মধ্যে নেই জানি, কলকাতা। তবু আমার চোখে শুভ্রতার ঠুলি পরে শুদ্ধতার রঙে তোমাকে একমাস রাঙাতে এসেছিলাম আমি।
এতে তোমার অনেক কিছুই ওলোটপালোট হয়ে গেলো। একটা ঝোড়ো হাওয়ার ক'দিন ধরে দাপাদাপির পরে এখন তোমার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ভীষণভাবেই এলোমেলো। তবে আমি জানি, তুমি চেয়েই ছিলে এই অবিন্যস্ত কয়েকদিন। তাই বারেবারে আমায় ডেকে বেরিয়েছ তোমার বিভিন্ন দিকে, বুঝিয়ে দিয়েছো নিখাদ ভালোবাসায় কাছে-ডাকা কাকে বলে। সেটা এয়ারপোর্টের কাছে কোনো সাজানো ফ্ল্যাটে হোক, বা আগরপাড়ার কোনো বাড়ির ছাদ, বা ঠাকুরপুকুরের নিশ্চিন্ত গোছানো কোনো নতুন সংসার। শীতকালেও তুমি এই জায়গাগুলোর কোথাও উষ্ণতার অভাব রাখোনি। কিন্তু এতো উষ্ণতার পরেও বুঝিয়ে দিয়েছো, আশঙ্কা যদি কোথাও থাকে, তবে তা টাকা-ছাপানোর জায়গাটির পর পরই শুরু হয়ে যায়। তবে আমি সে ক্লেদ একেবারেই গায়ে মাখিনি।
চার-পাঁচ বছর সাইকেল না চালিয়েও, প্যাডেলে পা পড়লে, মানুষ যেমন ব্যালেন্স করতে প্রধানত ভোলে না, মোটামুটি সোজা সাইকেল চালিয়ে চলে যায়, তোমার কাছে আমার প্রত্যাবর্তন বারেবারেই তাই। তোমার জল-হাওয়ায় আমার সাবলীল অবস্থান; তোমার বিরিয়ানি, চিকেন রোল, লস্যিতে আমার স্বর্গ। সেই তুমিই তৈরী করেছো রঙিন পানীয়ের উন্মত্ত রাত, টোয়েন্টি নাইনের পরের পর গেম বা একসাথে চারজন ছায়ামূর্তির নির্ভেজাল আড্ডা। তখন তুমি আর জব চার্ণক বা সাবর্ণ রায়চৌধুরীর টেনে দেওয়া কোনো ভৌগোলিক সীমানা নয়, তুমি তখন সমস্ত বাস্তবিকতা ছাড়িয়ে কুর্গ, নৈনীতাল বা বকখালীতে ছড়িয়ে গেছো। আমাদের বাড়িতেও তুমি এসেছো প্রচুর আত্মীয়ের সমাগমে, নিখাদ আনন্দের অবসরে। অথবা একান্তে তোমার আঁচলের তলায় গিটারের ঝর্ণা ও মা-এর গান শোনা গেছে। তুমিই বুঝিয়ে দিয়েছো ভাইয়ের ভালোবাসার মানে খোঁচা-মারা, দাদুর ভালোবাসার মানে এমন এক আলিঙ্গন, যার গভীরতা আজ পর্যন্ত কোনো আলিঙ্গন এনে দিতে পারেনি, পারবেনা। তুমিই আমার ছয় বছরের পুরোনো বন্ধুতার অক্ষত অবয়ব। তুমি আমার গানের জগৎ, তুমিই আমার সত্যিকারের বেঁচে থাকা।
কলকাতা, তুমি আমাকে ভাস্কর চক্রবর্তীর শব্দচয়নে সামান্য উল্টো প্রশ্ন করতে শিখিয়েছো। তাই আমি শীতকালকে প্রশ্ন করেছিলাম, সুপর্ণা কবে আসবে। জানো কলকাতা, সুপর্ণা এসে তোমাকে নতুনভাবে তৈরী করে দিয়েছে, পার্ক সার্কাস থেকে ঢাকুরিয়া ব্রিজ হয়ে, সল্টলেক থেকে মোহরকুঞ্জের ফুলের বাগান ছুঁয়ে। সেই ছোঁয়ায় তৈরী রয়েছে সুন্দর অথচ অজানা ভবিষ্যৎ-এর স্বপ্নের কুঁড়ি। সেই স্বপ্নকে তুমি কি অমলিন করে রাখতে পারবে, কলকাতা? সময়মতো জল, বাতাস, রোদ দিয়ে? তোমার কাছে বারবার ফিরে এসে তো আমি শান্তি পাই যে, দুনিয়ার দ্রুত বদলে যাওয়া রুক্ষ মানচিত্রে তুমি চিরকাল তোমার শ্যামলিমাময়, শহুরে অথচ শালবনের জংলী মত্ত রূপ ধরে রাখবে। যদিও তুমি আমার অস্থাবরগুলো চিরকাল ধরে রাখতে পারোনি, কিন্তু তোমার ওপর আমি এখনো বিশ্বাস রাখি, কলকাতা। কষ্ট পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনাতেও ঝুঁকি নিই। তাই তোমার কাছে আমি আবারও ছেড়ে যাচ্ছি ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি, ফেলে যাচ্ছি না। তুমি গচ্ছিত রেখো কলকাতা। তোমার ওপর আমার আস্থা আছে। তোমার কাছে ভালোবাসা ফিকে হয় না। তোমার চোখে, নাকে, গালে, কাঁধে, মুখে, ঠোঁটে আমাকে ছড়িয়ে যেতে দিও। দেখবে সময় কাটতে না কাটতেই আমি আবার তোমার কাছে ফিরে আসবো।