Friday, September 21, 2018

মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা প্রলম্বিত জেটল্যাগ চলছে - Sometime it feels like a long jetlag

মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা প্রলম্বিত জেটল্যাগ চলছে। গভীর রাত্রে অনেকসময় যখন ঘুম ভেঙে যায়, তখন মনে হয়, কেন ঘুমোবো ! আমার তো এখন জেগে থাকবারই সময়। আমার নিজের যারা - বন্ধু, শত্রু, আত্মীয়, ইত্যাদি - তারা তো সকলেই এখন জেগে, দিনের ব্যস্ততম সময়ে তারা ব্যস্ততায় বন্দী। তাহলে আমি কেন এই নিকষ কালো মুক্তদশার কবলে থাকবো ! এইরকম প্রশ্নই সমস্ত ঘরজুড়ে ঘুরপাক খেয়ে প্রতিফলিত হওয়ার পরে সত্যের সন্ধানী হওয়ার ইচ্ছে হয়। সেই সত্যের খোঁজেই বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমকে আপন করে নেওয়া - গান, লেখা, কবিতা। এসব কিছুতেই সেই সত্যকে তুলে ধরার এক যারপরনাই চেষ্টা। কিন্তু সেই সত্যানুসন্ধান আসলে একটা ঢাল। প্রকৃতপক্ষে এসব শিল্প যে সৃষ্টি করছি, এগুলো পুরো ট্র্যাশ, বোগাস, গার্বেজ। স্রেফ কোনো মূল্য নেই এগুলোর। এগুলো শিল্প বলে ভাবার নূন্যতম স্তরেও পৌঁছনোর যোগ্য নয়। তাই জন্যই সত্যানুসন্ধানের একটা ভেক ধরতে বাধ্য হতে হয়, নাহলে তো সৃষ্টির কোনো সার্থকতা থাকেনা। তবে এই সত্য-মিথ্যার আড়ালেই অন্য যে উদ্দ্যেশ্য অজান্তে সাধন হয়, সেটাই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা -আত্মানুসন্ধান। আত্মায় বিশ্বাস নেই, কিন্তু তাকে সন্ধানে যথেষ্ট বিশ্বাস আছে। নিজের অন্তরটাকে খুঁড়ে বের করার মধ্যে এক পাশবিক আনন্দ যেমন আছে, তেমনি মহাজাগতিক এক তৃপ্তি আছে - হয়তো বা পাশবিক আনন্দটাতেই তৃপ্তি। তবে নিজের ভিতরে সম্পূর্ণ প্রবেশ করার মানে, গভীরে লোকানো আশঙ্কাগুলো - যা কিনা দৈনন্দিন নাওয়া-খাওয়ায় চাপা পড়ে ছিল - সেগুলোকে এক অন্ধকার ঘর থেকে সর্বসমক্ষে আলোয় নিয়ে ফেলা। মৃত্যুচিন্তা তার মধ্যে প্রথম সারির। অধিকাংশ অন্তরখননেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। সামান্য ভাবনার বারুদেও, এই চিন্তার ফুলকি বিধ্বংসী আগুনের ধ্বংসলীলা চালায়, মনের অলিতে-গলিতে, মস্তিকের পাড়ায় পাড়ায়। স্রেফ রাস্তায় হাঁটতে থাকা থেকে ল্যাম্পপোস্ট, ট্রাফিক লাইট, স্ট্যান্ডার্ড, আমেরিকা, ভারত, ইতিহাস, সমাজতন্ত্র, স্বাধীনতা, পৃথিবী, প্রক্সিমা সেন্ট্যুরি, মহাজগত, বিগব্যাং, ব্ল্যাক হোল এবং... আমি। আসলে তো আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব নেই এই ভাবনাটারও। মৃত্যুর যদিও অস্তিত্ব আছে, আমাদের একমাত্র নিশ্চয়তা। সেটারই স্থায়িত্ব নির্ধারিত। আর একটা প্রচণ্ড চিৎকার, এবং শুধুই তার থেকে যাওয়া আছে, তারও অস্তিত্ব আছে। গান, লেখা - এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই, লেখার কোনো মূল্যও নেই। কারণ লেখা অনেক সহজ, বাঁচা অনেক কঠিন।
মাঝে মধ্যে মনে হয়, একটা প্রলম্বিত জেটল্যাগের মধ্যে রয়েছি, গত চার বছর ধরে।

Sunday, September 16, 2018

মন তরে কেবা পার করে

ভীষণ গোলাপী মতন হয়ে আকাশের গায়ে সন্ধ্যের ছায়া পড়তে শুরু করেছে। বোম্বে রোড ধরে চলে এসে কিছুক্ষনের ভিতরেই কলকাতাকে পেরোনো হয়ে গেছে। সেখানকার মেকী মনুষ্যত্ব, নাক-উঁচু স্বভাব গা থেকে ঝরে গেছে। মাটির কাছাকাছি, খুব খুব কাছাকাছি যাওয়া হচ্ছে। আকাশ গোলাপী রঙে সেজে উঠে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। যে নদীকে একটু আগেই অচেনা মহিলা লেগেছিল, এখন সে যেন কত চেনা পুরনো বান্ধবী। এইভাবে শ্রান্ত সন্ধ্যের মাঝে ওর সাথে বসে থাকতে থাকতে, হয়তো এই পুরনো বান্ধবীর প্রেমে পড়বো। এরই তো প্রেমে পড়া যায়। কি হবে আর বন্ধুত্বের দূরত্ব রেখে! ওই তো, একটা নৌকো দেখা যাচ্ছে। ওতে করে বেরিয়ে পড়ছি দুজনে মিলে। এরই মধ্যে,  ভাটিয়ালি গান শুরু হয়েছে। মাঝিভাই এক প্রান্তে বসে গানের ভেলায় দাঁড় বাইছেন। আমি আর নদী একদিকে শুয়ে আছি, পাশাপাশি। অকূল দরিয়ার গান শুনতে শুনতে উপরে দেখছি, কিভাবে তারারা একের পর এক কালো হতে থাকা আকাশের প্রান্তরে অবিন্যস্ত ভাবে দাঁড়াচ্ছে। এরই মাঝে আমার সদ্য হওয়া প্রেমিকা নদী গেয়ে উঠছে, "মাঝি তোর নাম জানিনা, আমি ডাক দিমু কারে, মন তরে কেবা পার করে"। এত বেদনা, কিন্তু তার মধ্যেও জীবনতরী বেয়ে চলার কি ভীষণ আর্তি! নদীর কণ্ঠ্যে যে কি আছে! দেহে শিহরণ হচ্ছে, কিন্তু চোখে জল, ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নদীকে জিজ্ঞাসা করতে গেলাম, "মেঘে ঢাকা তারাতে এই গানটা..."। নদী গান থামাল না, সদর্থক মাথা নাড়লো। আকাশ থেকে দূরে পাড়ের দিকে চোখ নেমে এলো, ছোট্ট ঘুপচির ভিতর টিমটিমে হলদে বাল্ব গুলো জ্বলে উঠছে, একের পর এক। কেউ হয়তো তুলসিতলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ দিচ্ছে, আজান শেষে কেউ ঘরে ফিরছে। শাঁখ বাজলেও শব্দ এসে পৌঁছায় না নদীর মাঝখানে।

আচ্ছা নদী, ওপারে যাওয়া যায় না? - আমার কৌতুহল। নদী বলছে, "আমি তো যাই। আমার তো তোমাদের মতন বাঁধন নেই। আমি স্বাধীন।" - নদীর মুখে মৃদু হাসির স্রোত খেলে গেল। কিন্তু সেই স্রোতই আমার মনের ভিতর কি ভীষণ রকম মোচড় দিচ্ছে। এতগুলো মানুষকে একটা পেনের আঁচড়ে ঘর ছাড়া করে দেওয়া হল, আলাদা করে ভেঙে দেওয়া হল। চাইলেও আর যাওয়া যাবে না, শুধু হয়তো কিছু ঘুপচির ক্ষীণ, শান্ত, নিরস্ত্র আলো দেখা যাবে, এপার থেকে। তবু যেতে আমাকে হবেই; তাই উপায় বের করে নদীর দেহে ডুব দিচ্ছি আমি, নদীর সাথে মিশে যেতে। তখন তো আর কোনো বাধা থাকবে না। নদী তো আমার প্রেমিকা, আমাকে নিশ্চই ফিরিয়ে দেবে না। দিচ্ছেও না, ডুবে যাচ্ছি আমি। মুক্তি হচ্ছে আমার, দেশীয় বাধা, বন্ধন, পার্থিব শৃঙ্খল থেকে মুক্তি, কি ভীষণ আনন্দ, কি দারুন পরিতৃপ্তি! কি মিঠা জল, কি শীতল, কি স্নিগ্ধ! আমি বুঝতে পারছি, আমার মৃত্যু হচ্ছে, আরো গভীরে চলে যাচ্ছি নদীর, কিন্তু কোন কষ্ট হচ্ছে না। সমস্ত দুঃখ আমাকে, এই প্রথম বোধ হয়, ছেড়ে চলে যাচ্ছে। গলার কাছে বিশালাকৃতির দলাটা নেমে যাচ্ছে। কিন্তু নিশ্বাস নিতে পারছি না যে! দমটাই শুধু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জৈবিক বাস্তবতা আঁকড়ে ধরছে আমায়। কেউ আমাকে একটু অক্সিজেন দিন না, দাদা একটু অক্সিজেন? - আমি ভিক্ষা চাইছি। কিন্তু কেউ যে নেই নদীতে, সকলে কোনো না কোনো পাড়ে ঠাঁই নিয়েছে, কাউকে পাচ্ছি না। দাদা একটু কেউ সাহায্য করুন না, প্লিজ। দাদা আমি যে বাঁচতে চেয়েছিলাম, দাদা আ আ আ আ আ.... 

উঠে বসলাম, হাঁপাচ্ছি, ভীষণ ভয় করছে, চারিদিক অন্ধকার, শুধু বিছানার একটা কোণে রিডিং ল্যাম্পের আলোটা তাক করা আছে। চারিদিক অন্ধকারের ভিতরে, বিছানায় রাখা বুকমার্ক করা বইটার ওপর ল্যাম্পের আলোটা পড়ে, বইটার নামটা যেন একটু বেশি জ্বলজ্বল করছে, "পূর্ব-পশ্চিম" - আমাদের অবশিষ্ট আইডেন্টিটি।

Wednesday, September 05, 2018

তোমার আছে, তোমার নেই

Boston, 05-Sep-2018, 11:00 PM

তোমাদের সব আছে,
গাড়ি আছে, বাড়ি আছে,
নতুন কেনা ফ্ল্যাট আছে।
আলমারিতে সোনা-দানা,
সেবার পুজোর জহর খানা,
যত্ন করে রাখা আছে।
বছরে দুবার বিদেশ আছে,
ঘরের কাছেও ফ্লাইট করে
গোয়া কিংবা জয়পুরে
সময় পেলেই ঘোরা আছে।
সপ্তাহেতে দুবার করে,
রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে,
মুভি হলে সিনেমা আছে,
লাইভ শোয়ের টিকিট আছে।

কিন্তু তোমার সবুজ নেই,
শ্যামল মাঠের খোলা হাওয়ার
মাতাল করা সুবাস নেই,
মাথার ওপর নীল নেই। 
ঘরের ভেতর আরাম ক'রে,
নিখাদ একটা আড্ডা মারে -
এমন কোনো বন্ধু নেই। 
ঘোরা আছে, চেনা নেই,
শিল্প আছে, চর্চা নেই,
সত্যজিৎ খানিক আছেন,
শেষের কোনো কবিতা নেই।
রাস্তার পাশে ফুচকাওয়ালা-
শেষের ফাউটা দিতে বলার
ইচ্ছে আছে, উপায় নেই। 
"অনুপম" তো চিরন্তন,
গানের স্রোতে ভাসা নেই,
তোমার নতুন ভাষা নেই,
তোমার কেবল আমি আছি,
তোমার আসলে তুমি নেই।