বেশ আগের কথা। পেয়াঁজ কাটছিলাম। অসাবধানবশতঃ আঙ্গুলটায় ছুরি বসিয়ে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভিতর আঙ্গুল। কিছুক্ষণ পরে বাইরে এনে দেখলাম, রক্ত থামছেই না। বোরোলিনটা ইচ্ছে করেই ভারত থেকে নিয়ে আসি। একহাতেই কেটে-যাওয়া তর্জনীতে লাগালাম বাঙালীর মহৌষধী। রক্ত পড়া থামলো তাতে। কিন্তু খাবার বানানো থামালে তো চলবে না, তাহলে তো অভুক্তই শুতে হবে। বাইরে কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার মত ডলার খরচের বিলাসিতা সম্ভব নয়। তাই বোরোলিন লাগিয়ে কাছের মার্কেট থেকে এক প্যাকেট ব্যান্ড-এড আনতে হল। ঘরে ফিরে ব্যান্ড-এড লাগিয়ে, একহাতেই যেরকম পারা যায় রান্না। তারপর রক্ত-বোরোলিন মিশিয়ে জমিয়ে খাওয়া।
এরকম আরো ঘটনা আছে। একবার স্কোয়াশ খেলতে গিয়ে, স্কোয়াশ বল এসে লেগেছিল চোখে। স্কোয়াশ বলের স্পিড খুব বেশি হয় বলে, চশমা ভেঙে এক চোখ প্রায় অকেজো করে দিল কয়েক সপ্তাহের জন্য। অগত্যা একচোখেই বেশ কয়েকদিন দোকান-বাজার-রান্না। তখন আমেরিকার স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুরূহ দশাটাও বেশ বুঝেছিলাম। যাই হোক, একবার বুড়ো আঙ্গুলটা পুড়ে যেতেও এভাবেই আধা-সক্ষমতায় সপ্তাহ-দুয়েক চালাতে হয়েছিল।
তবে স্রেফ আমি তো না, আমার মতো অনেক ছাত্র এভাবেই বিভিন্ন নিত্য-নৈমিত্তিক অসুবিধার মধ্যে পড়াশোনাটা চালিয়ে যায় এখানে। দেশ ছেড়ে, বন্ধু ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে। এই তো আমারই এখানের এক বন্ধুর ৫ বছরের সম্পর্ক ভেঙে গেল, সে এদেশে চলে আসার কিছু পরেই। তাড়াহুড়ো করে এক সপ্তাহের জন্য দেশে ফিরেও কিছু লাভ হল না। তাকে দেখেছি, বেশ কষ্ট করে নিজেকে আবার ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনতে। অনেকদিন চুপিচুপি অভুক্ত থাকতেও দেখেছি তাকে। তবে যখন কোনো assignment বা অন্য কিছুর deadline থাকে, তখন আমাদের এমনিও পরপর বেশ কয়েকদিন ঠিকঠাক ঘুম-খাওয়া-দাওয়া হয় না। সময়ই থাকে না, নিজে খাবার তৈরি করার। আর নিজেকে তো একটু অবহেলা করাই যায়। নিজের প্রতিই তো অবহেলা, অন্য কেউ তো নয়।
এই অব্দি যদি পড়া হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তো ভাবতে শুরু করেছেন যে, এই কাঁদুনি গাওয়ার মানে কি। কিন্তু বাইরে থাকার উজ্জ্বল দিকগুলো দেখে যেমন সহজেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন, তার অপর পিঠটা সম্পর্কেও তো অবগত থাকতে হবে। নাহলে তো এটাও আমেরিকার War on Terror-এর মতো হয়ে যাবে।
এখন অবশ্য আর ছুরিতে আঙ্গুল কাটে না, বা গরম ভেসেলে হাত পোড়ে না, এখন এসব সামলে নিয়েছি। তবে মনটা তো চিরকালই অনিয়ন্ত্রিত, কেটে যায়, ছড়ে যায়, আঁধারেতে মিশে যায়। তবু বাইরের দুনিয়ার কাছে আমরা ভালো আছি। বন্ধুবান্ধবদের বেড়াতে যাওয়ার photo দেখে আনন্দ উপলব্ধি করছি। আমাদের আবার খারাপ থাকলে চলে নাকি! আমরা স্বপ্নের দেশে স্বপ্নের মতো আছি। তবে সেই স্বপ্নটা শুধুই যারা বেশ দূর থেকে দেখছে, তাদের কল্পিত স্বপ্ন, কিন্তু আমাদের তুলিতে রাঙানো। আচ্ছা তুলিরা কি ক্লান্ত হয়, অন্যের জন্য ছবি আঁকতে আঁকতে?
(চলবে, লেখাটা নয়, জীবনটা)
No comments:
Post a Comment