Friday, August 04, 2017

খামতিগুলো কি আমাদেরই? - Are those really our mistakes?

IIT-তে পড়ার সুযোগ পাইনি; Stanford বা MIT-তে apply করার সাহস হয়নি; মায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে অব্দি পড়িনি। কিন্তু এইসব জায়গার ভালো ছেলেরাও যেখানে কাজ করার স্বপ্ন দেখে, সেখানে কাজটা করার সুযোগ যখন পেলাম, তখন ভাবলাম এই লেখাটা এবারই প্রকাশ্যে আনা যেতে পারে। না না, ভাববেন না এটা কোনো, ছোট জায়গা থেকে বড় জায়গায় উঠে আসার রোমাঞ্চকর সংগ্রামের কাহিনী হবে। তার থেকে বাস্তবের কাছাকাছির কথাই বলার চেষ্টা করবো। এই লেখাটা এখনই লিখতে হতো কারণ, তা না হলে ভাওঁতাটাকে তো প্রকাশ করা যেত না, সেটা স্রেফ অভিযোগের মত শোনাতো।

আপনাদের অনেকেই হয়তো ছোটবেলা থেকে আমার মতো দুরূহ পরিস্থিতিতে বারবার পড়েছেন। যতবারই কোনো ভালো জায়গায় চাকরি বা শিক্ষার সুযোগ হারিয়েছেন, তখন নিশ্চয়ই কাছের লোকের সান্ত্বনা পেয়েছেন। কিন্তু সাথে সাথেই সমাজের থেকে নিশ্চয় পেয়ে থাকবেন, একটা ছোট হয়ে যাওয়ার দৃষ্টিমুখ। অন্যদের তুলনায় কোথাও যেন আপনি পিছিয়ে পড়েছেন বলে, আপনাকে মনে করানো হয়েছে। ধীরে ধীরে, আপনি নিজের মনেও কোথাও একটা সেটা মেনে নিয়েছেন। নিজের মধ্যে, খুব গভীরে তৈরী হয়েছে একটা inferiority complex.

এই যে আপনার মনের insecurity-এর সুযোগ নিয়ে, আপনার নিজের কাছেই, নিজেকে খানিকটা খাটো করে দেওয়া হলো - এটা ভীষণভাবে দরকার। কারণ আমরা যদি এটা প্রমান করতে না পারি, একজন অন্যজনের তুলনায় মেধা বা অন্য কোনো অংশে খারাপ, তা না হলে ঘোরতর সমস্যা। জয়েন্টের দু-তিনটে MCQ ভুল হলে আপনার কলেজ যাদবপুর থেকে যদি কোনো প্রাইভেটে পাল্টে দেওয়া না যায়, তাহলে তো খুব মুশকিল। কারণ সকল প্রাইভেট কলেজে তো যাদবপুরের মতো পরিষেবা দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু সেই ঘাটতি মানুষের কাছে নিয়ে এলে সিস্টেম চলবে কেমন করে! তাই প্রমান করা দরকার, ওই দু-একটা প্রশ্নের উত্তর ভুল দেওয়াই আপনার মেধাকে ছোট করে দেয়, অন্য একজনের তুলনায়।

এবার যেই আমরা সমষ্টিগতভাবে ভালো-খারাপের সংজ্ঞাটা শিক্ষার মতো প্রাথমিক বিষয়ে প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে পারলাম, ব্যাস, কেল্লা ফতে! এরপর আপনাকে বলা হবে, আপনি প্রমান করুন আপনার কাজের মাধ্যমে, যে আপনিও চাকরিক্ষেত্রে একজন ভালো কলেজের ছেলের সমমানের। অথচ শিক্ষাক্ষেত্রের পরেই যে চাকরিজীবনে আপনি ঢুকবেন, সেখানে প্রথমেই দেখা হবে আপনার শিক্ষাক্ষেত্র বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কুলীনতা। পরে, ধীরে ধীরে, আপনার মেধার কথাও বিচার্য হবে। কিন্তু লক্ষ্য করুন, প্রথমেই আপনাদের মধ্যে তুলে দেওয়া হয়েছে ভালো-খারাপের একটা কাল্পনিক দেওয়াল। আদপে সে দেওয়ালের প্রস্থ হয়তো সামান্যই, কিন্তু তাকেই সিস্টেম দেখাবে বিরাটভাবে। এভাবে অদৃশ্য মাপকাঠিগুলো গড়ে না তুললে তো, মানুষের মধ্যে ছোট-বড়র সংজ্ঞাটাকে বাড়তে দেওয়া যাবে না।

ঠিক এভাবেই systematic ঘাটতিগুলোকে মানুষের ঘাটতিতে চালান করা হয়। আপনার যখন চাকরি হচ্ছে না, আপনি ভাববেন যে আপনি নিজেই হয়তো যোগ্য নন। অথচ সিস্টেমের যে এটা দায়িত্ত্ব আপনাকে প্রকৃত সুযোগটা দেওয়া, এই কথাটা মাথাতেও আসবে না। এই যে দেখছেন গুগল, মাইক্রোসফট বা অন্যান্য বড় কোম্পানিতে লোকে কাজ করছে, আপনি ভাববেন, বাপরে, নিশ্চয় ওদের অসামান্য মেধার জেরে ওরা এসব জায়গায় কাজ করছে। কিন্তু সত্যিটা তো আমাকে আমারই এক সিনিয়র কয়েকবছর আগে বলেছিলেন। তাঁর নাম নেবো না, তবে তিনি বলেছিলেন, ২০০ টা মতো কোয়েশ্চেন হয় প্রোগ্রামিং-এর, ওগুলো ভালো করে তৈরী করে নে, তাহলেই যে কোনো বড় সফটওয়্যার কোম্পানিতে হয়ে যাবে। আর সত্যিটাও তাই, ওই ২০০টা কোয়েশ্চেনকেই এপাশ-ওপাশ করে প্রশ্ন করা হয় এসব জায়গায়। আর গাণিতিকভাবে বলতে গেলে, এর থেকে আলাদা ধরণের problem solve করার দরকারও পড়ে না, আমাদের কাজের ক্ষেত্রে। কিন্তু সকলেই যদি এটা রপ্ত করে ফেলে, তাহলেও সবাই কি এসব বড় জায়গায় কাজ করতে পারবে? কারণ এদের কোম্পানিতে কাজ করার লোকের চাহিদা তো সীমিত। সুতরাং, আবার দরকার পড়ে সেই তুলনামূলকভাবে ছোট করার গল্পটা।

সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা এই জিনিসটাকেই cater করে ranking, competitive exam-জাতীয় প্রতিযোগিতাগুলোর মাধ্যমে। আমাদের মনে প্রোথিত করে দেওয়া হয়, যে আমরা হয়তো খারাপ অন্যদের থেকে, তাই আমরা সুযোগ পাচ্ছি না বা আমাদের মাইনে কম অন্যদের তুলনায়। কিন্তু আইনস্টাইনই বলেছেন, "Everybody is a genius. But if you judge a fish by its ability to climb a tree, it will live its whole life believing that it is stupid." আমরা সাধারণরা বেশিরভাগই কেউ আইনস্টাইন বা রবীন্দ্রনাথ নই। কিন্তু আমাদের নিজেদের মতো করে যে বিশেষত্বগুলো আমাদের ভিতরেই আছে, সেগুলোকে তো আমরা বাড়তেই দিতে পারি না। সমাজের এলিটিজমের ফাঁকফোকর দিয়ে গলে যায় আমাদের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া-ভালোলাগা-প্রতিভাগুলো। তাই যেখানেই ওই এলিটিজমের ছোঁয়া দেখবেন, বুঝবেন লোকানো রয়েছে সিস্টেমেরই কোনো গাফিলতি। আর এভাবেই সিস্টেমটা survive করতে পারে। এখানে আপনার survival-এর উপায় হলো, এই সিস্টেমের খুঁটিনাটি জেনে, তার সাথেই ধূর্ততার খেলায় নামা। শুধু খেয়াল রাখা দরকার, সেই খেলায় নেমে, আপনি নিজে যেন সিস্টেমের তৈরী করা ট্র্যাপগুলোকে কোনোভাবেই বড় করতে সাহায্য না করে ফেলেন। অন্তত এটুকু চাহিদা সমাজ আপনার কাছে রাখে।


পুনশ্চঃ আমার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান কিছু বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় এখনো বিভিন্ন জায়গায় এই চাকরির সংগ্রামটা চালিয়ে যাচ্ছে, একটু ভালো চাকরি বা মাইনের আশায়, একটু ভালো ভবিষ্যতের আশায়। আমি যে প্রিভিলেজগুলো পেয়েছি, সেগুলো তাদের অনেকেই পায়নি। তাদের কারো কারো সাথে এখন কথা বলে বুঝতে পারি, কিভাবে তারা নিজেদের যোগ্যতাকেই প্রশ্ন করে! তাই এক ভিতরের তাড়না থেকেই লিখতে বাধ্য হলাম এই লেখাটা। আশা করবো, যারাই সাফল্য পাচ্ছেন, মনে রাখবেন যে তারা ঠিক কোন advantage-এর জায়গা থেকে শুরু করছেন, এবং কি কি সুবিধাগুলো পেয়ে আসছেন, যার জন্য আপনার এই সাফল্য। আর একটু খেয়াল রাখবেন, সমাজের কাছে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে দিতে, আপনার কাছের বন্ধুবান্ধবগুলো যেন নিজেদেরকে হারিয়ে না ফেলে।

No comments:

Post a Comment