Saturday, November 18, 2017

পাগল হাওয়া

একজন জিজ্ঞেস করছিল, কিন্তু ওনাকে কজন মনে রাখলো বল তো? আমি বলি, সাধারণ মানুষ তো তেমন কাউকেই মনে রাখে না। তাদের দৈনন্দিন ঝুটঝামেলার শেষে, শিল্পের চলমান ধারাকে মনে রাখার মতো সময় কোথায়! কিন্তু যারা সত্যিই সংগীতের বিবর্তন নিয়ে আগ্রহী, সংগীতের প্রকৃত গুণগ্রাহী, তারা ঠিক জানে, রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা সংগীতে যে আধুনিকতার আঘাত দেওয়াটা দরকার ছিল, সেটা সলিল চৌধুরী ছাড়া সম্ভব ছিল না। 

তাঁর গান লেখা শুরু হচ্ছে ৪০-এর দশকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাহেন্দ্রক্ষণে। বাংলায় তখন রবীন্দ্র, নজরুল বা দ্বিজেন্দ্রলালের ভারতীয় ধারার সংগীত প্রবলভাবে বিদ্যমান। সেই সময়েই চা-বাগানে বড় হওয়া এক কিশোর বাখ-মোৎজার্ট-বেঠোভেন শুনে ফেলছেন। আর শুধু শুনছেনই না, সেই পাশ্চাত্য সংগীতকে মিশিয়ে দিচ্ছেন ভারতের রাগাশ্রয়ী এবং রাবীন্দ্রিক-ঘরানার সংগীতের সাথে। কিন্তু সেইরকম সুরের মতো উপযুক্ত কথাও তো চাই। কখনো সেই কথা পাচ্ছেন সুকান্তের কবিতায়। কখনো রচনা করছেন নিজেই। 

ইউরোপিয়ান মোডাল music থেকে শুরু করে ভারতীয় রাগের modes হয়ে পাশ্চাত্যের আধুনিক scale-based music সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা সলিলের, শুধু সংগীত নিয়েই দিস্তের পর দিস্তে ভরিয়ে দেওয়া যায়, রাতের পর রাত আলোচনা করা যায়। সত্যিই ভেবে দেখুন, "রানার"-এর মতো এতো বৈচিত্র্যের গান, আর কিছু আপনি শুনেছেন কিনা! শুধুমাত্র একটি গানেই এতো ওঠা-নামা আনা যায়? এতো অনুভূতির সূক্ষতাকে একটি গানেই শুধুমাত্র সুরের বৈচিত্র্য দিয়ে ধরা যায়? সলিল সেটা ভারতীয় আঙিনায় করে দেখালেন। এবং শুধু সুরে নয়, কথাতেও করলেন। ১৯৪৩-এর কুখ্যাত বাংলার মন্বন্তরের পরে, তিনি তাঁর গানে তুলে ধরলেন "কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা"। যদিও এই গানেও তাঁকে সমালোচনা শুনতে হল, গাঁয়ের বধূর অনুভূতি এবং গানের বাস্তবরূঢ়তা নিয়ে। কিন্তু সলিলের লেখা গান মানুষকে অনুপ্রাণিত করা থামালো না। "আলোর পথযাত্রী" হয়ে মানুষকে পথ দেখালো, বললো "পথে এবার নাম সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা"। ওনার গানগুলিতে তখন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের "ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে"। গণনাট্য সংঘ (IPTA) ও কমিউনিস্ট পার্টির সভাগুলিতে হাজার হাজার মানুষ তার এই গানের সাথে গলা মেলাচ্ছেন।

প্রথম দিকে এসব গান রেকর্ড না হয়েও, মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে শুরু করলো। সলিল গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে এসব গান করেছেন এক সময়ে। দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখার্জি IPTA-এর হয়ে তাঁর সাথেই পথে নেমেছেন। তাঁরা গেয়েছেন "পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি।" এবং সে পথ তো সোজা ছিল না। স্বাধীনতার আগে ও পরে কমিউনিস্ট পার্টিকে বিভিন্ন জায়গায় ব্যান করা হয়েছে। অনেক সমস্যা সয়েছেন সলিলের মতো অনেক শিল্পীই। তবে বোধ হয়, সংগীত সলিলকে উজ্জীবিত রেখেছিল সবসময়। আর এছাড়াও তিনি ছিলেন চিরপরিবর্তনশীল। এরপরে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছেন, পারিবারিক অবস্থা খারাপ হওয়ায়। সেখানেও তিনি বদলে দিয়েছেন, নৌশাদ, খৈয়্যাম, মদন মোহনের music-এর সংজ্ঞা। "দো বিঘা জমিন", "মধুমতি", "হাফ টিকিট", "আনন্দ", "ছোটি সি বাত"-এর মতো ফিল্মের গানের মাধ্যমে এক অন্য ধরণের দমকা হাওয়া এনে ফেলেছেন আরব সাগরের তীরে। তবে এসব সাফল্যের মাঝেই তাকে শুনতে হয়েছে গঞ্জনা। কম্যুনিস্ট পার্টি (স্বভাবজাতভাবে) তাঁকে পার্টি থেকে বহিস্কারও করেছে।

কিন্তু এসবের জন্য তাঁর ধ্যানধারণা কখনো পাল্টায়নি। ছোটবেলায় চা-বাগানে থাকার সময় থেকেই মানুষের সম্মিলিত শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। মানুষের অনুপ্রেরণার জন্য গান, কবিতা লিখে গেছেন। মার্ক্স্ পড়ার সাথে সাথেই চারপাশের জগৎটাকে সূক্ষভাবে চেনবার চেষ্টা ছিল তার মধ্যে। সংগীতের এক বিরাট পারদর্শিতা কখনো সেই চেনায় খাদ আনতে পারেনি, বরং সহায়তা করেছে। নিজেকে নিরন্তর বদলাতে গিয়েই অবহেলায় বলতে পেরেছেন, "যাক যা গেছে তা যাক"। তাই জীবনের পরের দিকে সুর দিয়েছেন "মন লাগে না", "ও মোর ময়না গো", "ধিতাং ধিতাং বোলে"-এর মতো গানে। এই ধরণের চিরআধুনিক মানুষেরই অনুগামী হতে ইচ্ছে করে। আমি কোনোকিছু নিয়েই খুব একটা গর্ব বোধ করি না। কিন্তু সলিলের এই চিন্তাভাবনার অনুগামী হতে-পারার একটা গর্ব যেন কোথাও অনুভব করি। নিজেকে বামপন্থী মনে করি আর না-ই করি, সলিলপন্থী মনে করা যায়। ভেবে ভালো লাগে যে, নিজের মধ্যে একটুকরো সলিল চৌধুরীকে নিয়ে চলছি আমি। যে সলিল শুধু ঝড়ের কাছেই নিজের ঠিকানা রেখে যান, ঠিক "পাগল হাওয়া"র মতো।

Sunday, November 12, 2017

একলা বিকেলের - Lonely afternoon's

Boston, 12-Nov-2017, 3:19 AM
একলা বিকেলের সূর্য ছুঁলো
মন কেমনের বাঁক।
জানলা বেয়ে শীতল রোদে
স্মৃতির অভিঘাত। 

নিজের সাথে নিজের লড়াই,
নিজের স্বার্থ ত্যাগের বড়াই,
দুঃখসারি পার করে দেয়
নিজের সান্তনা-ই।

হলদে ডায়রির কবিতারা,
ঘরের সন্ধান চায়। 
প্রথম পাতায় তোমার লেখা
ভীষণ যন্ত্রনায়। 
হঠাৎ হাওয়ায় শব্দবন্ধ
নতুন দিশা পায়। 
ফেলে আসা ছায়ার ছবি
ধূসর কল্পনায়। 

অতীতের বাইপাস পেরিয়ে,
সুমনের গান সাথে নিয়ে,
আমার প্রিয় কলকাতারই
কাছে ফিরে যাই।

সন্ধ্যে নামে শহর জুড়ে,
যানবাহনের ভিড়।
প্রেমের শেষে আমরা সবাই
শুধুই পৃথিবীর।

Friday, November 10, 2017

ভালো মানুষ - Good Man (~৩.৫ মিনিট)

"Good" বলে একটি ড্রামা দেখলাম আজকে। একটি ভালো জার্মান লোকের গল্প। আদতে সে ভালই ছিল, সুখী ছিল। সুন্দরী স্ত্রী, দুটো সন্তান। স্ত্রী যদিও ঘর গুছিয়ে রাখতে পারে না ঠিকঠাক, কিন্তু যেহেতু আদপে লোকটা ভালো, তাই তার কোনো অভিযোগ নেই স্ত্রীকে নিয়ে। মাঝে মাঝে গান মাথায় আসতো তার। সেই গান মাথায় নিয়ে সে কলেজ যেত, ছাত্র পড়াতো। সে আবার মনের ডাক্তারও ছিল, তাই রোগীও দেখতো মাঝেসাঝে। নিজের বৃদ্ধা মায়েরও যথাসাধ্য খেয়াল রাখতো। পরকীয়ার সুযোগ পেয়েও তাতে জড়াতে পারেনি, কারণ সে তো ভালো মানুষ।

এহেন ভালো মানুষটিরই ছিল এক Jews (ইহুদী) বন্ধু। তাদের বন্ধুত্বও বেশ দৃঢ়। এমন সময়েই জার্মানিতে নিদান এলো, যে Jews-রা নাকি নিম্নশ্রেণীর মানবপ্রজাতি। প্রথমটা সে care করেনি অতটা। ভেবেছিল, হিটলার নামক পাগল রাষ্ট্রনায়ক বেশিদিন মসনদে থাকতে পারবেনা। সে ভালো মানুষের মতোই বই লিখছিল, অধ্যাপনা করছিল। কিন্তু তাকে সকলে উপদেশ দিতে শুরু করলো, নাৎসি সোশ্যালিস্ট পার্টিতে নাম লেখাতে। সে ভাবলো, নাম লেখাতে তো কোনো বাধা নেই। সে নিজে তো আর সেই পার্টির সব ধারণা মেনে চলে না। তাই সে নাম লেখালো, নাৎসিদের বিরুদ্ধে কিছু বললো না। তার ইহুদী বন্ধু তাকে কৈফিয়ত চাইলে, সে বললো, এটা একটা জাতীয় উন্নয়নের যজ্ঞ। একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে।

এদিকে তার কলেজে এসে তাকে একসময় বলা হল, কিছু বই পুড়িয়ে ফেলতে। কার্ল মার্ক্স-সহ বিখ্যাত লেখকদের বই পুড়িয়ে ফেলতে, সে প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু সে যুক্তি সাজলো যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা আরো hands-on হওয়া উচিত। বইয়ের কি দরকার! তাই নিজে হাতেই সে বইগুলো পুড়িয়ে ফেললো। তাকে এরপর একটি মনগড়া রিসার্চ পেপার লিখতে বলা হল, এটা প্রমাণ করতে যে ইহুদীরা মনোস্তত্বগতভাবে নিচু জাতির মানুষ। যদিও সে জানতো যে, তার নিজের ইহুদী বন্ধু-সহ আরো অনেক চেনাজানা ইহুদীই খুবই বুদ্ধিমান এবং মর্মস্পর্শী, কিন্তু সে ভাবলো, এটুকু করলে তেমন তো ক্ষতি নেই। তার নিজের বন্ধু হয়ত ব্যতিক্রম। আর আইনস্টাইনও ইহুদী হলেও, সে তো নিজে আইনস্টাইনের বই পড়ে দেখেনি। সুতরাং জাতীয় স্বার্থে, এই রিসার্চ পেপারটা লেখা যেতেই যেতে পারে। সে তো নিজে কিছু খারাপ করছে না, কোনো ইহুদীকে মারতে যাচ্ছে না।

এভাবে ধীরে ধীরে সে সমগ্র পার্টি মেশিনারির অংশ হয়ে গেল। নৈতিকতাকে নিজের মতো সাজিয়ে নিয়ে নিজের কাজগুলোকে জাস্টিফাই করতে শিখে গেল। তবে সে কিন্তু ভালো লোক ছিল, সুখী ছিল। কোনো খারাপ কাজ করেনি। কিন্তু একদিন ওরা ওর ইহুদী বন্ধুকেও মেরে ফেললো। তখনও কিছু করতে পারেনি সে। বন্ধুকে বাঁচাতে পারেনি। তখন তার মাথায় শুধু বেঠোভেনের কোনো এক সিম্ফনি বেজে উঠেছিল। তারস্বরে। তবু লোকটা ভালো থাকার চেষ্টা করেছিল, হয়ত ভালই ছিল। যেমন আপনারা আছেন।

কোনো ডাক্তারকে সাসপেন্ড করা হয়েছে? তাতে কি? আপনি নিজে বা আপনার কোনো আত্মীয় তো ডাক্তার নয়। সাংবাদিককে মেরে ফেলছে? তাতে কি? আপনার জানাশোনা কেউ তো নয়। আর যদি জানাশোনা কেউ সরকারি চাকরি করেও, সে তো সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলছে না। আর যদি বলেও, ফেসবুক বা পাবলিক প্লেস-এ তো বলছে না। আর যদি তাও বলে, সরকার তো এখনও জানতে পারেনি। আর সরকার জানলেও, আগের আমলেও নিশ্চই এমন কিছু একটা ঘটার উদাহরণ পাওয়া যাবে। তাই আপনি ভালোই আছেন। আপনি ভালো থাকছেন। খাওয়া দাওয়া করছেন। ইনস্টাগ্রামে ছবি পোস্ট করেছেন। WhatsApp গ্রুপে meme শেয়ার করছেন। আপনি একজন ভালো নাগরিকের মত ভালো আছেন। কিন্তু জানেন তো, একজন সচেতন আর দায়িত্ববান নাগরিক হওয়াটা বোধহয় এই সময়টায় একটু বেশি দরকার ছিল! তবু চিন্তা করবেন না, এরকমই থাকুন। কারণ সেই জার্মান লোকটার মত, আপনিও একজন "ভালো" মানুষ। তবে পরবর্তী ক্রিকেট ম্যাচটা দেখার পরে কিছু সময় পেলে, সেই "ভালো"-র সংজ্ঞাটা একবার যাচাই করে নেবেন।