বিটকয়েন এর নাম হয়তো অনেকেই শোনেননি। যারা শুনেছেন এবং শোনেননি, সকলের জন্যই লেখাটা। শেষ পর্যন্ত লেখাটা সাধারণ অর্থনীতির দিকে নিয়ে গিয়ে শেষ করবো। যারা এ সম্পর্কে শোনেননি, তাদের উৎসাহ যোগানোর জন্য বলি যে, এখন মাত্র একটি বিটকয়েন-এর মূল্য ১৪-১৬ হাজার ডলারে পৌঁছেছে। কি করে এই অবিশ্বাস্য ব্যাপার হল, সেটা কিছু পরেই বোঝা যাবে। তার আগে এর সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক।
বিটকয়েন একটি ডিজিটাল কারেন্সি। মানে এর কোনোরকম ফিজিকাল অস্তিত্ব নেই। এই কারেন্সি যদি কিনতে চান, তাহলে আপনাকে অনলাইনেই কিনতে হবে। আপনার একটি প্রাইভেট পাসওয়ার্ড দ্বারা সেই কারেন্সি সুরক্ষিত থাকবে। কিভাবে এটা সুরক্ষিত থাকছে, সেটা বলার জন্য আর একটা লেখা লিখতে হবে। এমন দুর্দান্ত কিছু থিওরি নয়, এবং এই সম্পর্কিত একটি লেখা কিছুদিন পরে পাবেন। তবে এখন আপাতত এটুকু জানলেই চলবে যে, কিছু unsolved mathematical problem-এর জেরেই, আপনার পাসওয়ার্ডের দ্বারা ওই ডিজিটাল কারেন্সি, বিটকয়েন, সুরক্ষিত থাকার ব্যবস্থা আছে। যেমন আপনার সাধারণ টাকা ব্যাংকে সুরক্ষিত থাকে, অনেকটা তেমন করেই। কিন্তু বিটকয়েন শুধু এই নিরাপত্তার জন্য এবং ডিজিটাল হওয়ার কারণেই স্পেশ্যাল, তা নয়। এর একটা অন্য কারণ আছে।
এই বিটকয়েনকে কোনো সেন্ট্রাল অথরিটি নিয়ন্ত্রণ করছে না। এর মানে হলো, কোনো রিজার্ভ ব্যাংক বা সরকার নেই, যে বলে দিচ্ছে কত বিটকয়েন মার্কেটে থাকবে। অথবা কেউ কোনো অর্থনৈতিক নিয়ম তৈরী করে দিচ্ছে না, যাতে বিটকয়েনের যোগান কন্ট্রোল করা যায়। ফলে বিটকয়েনের মূল্য নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় সরকারের কাছে নেই। এ বিষয়েই পরে আর একটু আলোচনা করবো। কিন্তু তার আগে বিটকয়েনের পিছনে আর একটি প্রযুক্তি কাজ করছে, সে ব্যাপারে জানা প্রয়োজন।
যেহেতু কোনো সেন্ট্রাল অথরিটি বিটকয়েনকে কন্ট্রোল করছে না, তাই এটা বোঝা তো খুব শক্ত যে কার কাছে কত বিটকয়েন আছে! অথবা কেউ অন্য কাউকে বিটকয়েন যদি ট্রান্সফার করে, তাহলে আদৌ সেই বিটকয়েনগুলি ভ্যালিড কিনা এটা যাচাই করার উপায় কি? এর পিছনে আছে একটি নতুন টেকনোলজি, blockchain। আরো সোজা ভাষায়, একটি পাবলিক ledger সিস্টেম। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে হাজার হাজার মেশিনে কপি করে রাখা আছে, একটি public ledger. এই পাবলিক ডেটাবেস বা লেজারে জমা রাখা হচ্ছে সমস্ত transaction বা লেনদেনগুলো। এই public ledger-এ কোনো transaction তখনই ভ্যালিড বলে গণ্য হবে, যখন একটি নূন্যতম সংখ্যক মেশিন (যথাযত সংখ্যাটা বলাটা একটু জটিল) সেটাকে মান্যতা দেবে। এই মান্যতা দেওয়ার পদ্ধতিও বেশ অভিনব। এই মান্যতা দেওয়ার জন্য প্রত্যেক মেশিনকে করতে হবে কিছু সময়সাপেক্ষ জটিল গাণিতিক ক্যালকুলেশন। যখন নূন্যতম সংখ্যক মেশিন ক্যালকুলেশনগুলি করার পরে কোনো transaction-কে মান্যতা দিলো, তখনই সেই transaction পাবলিক লেজারে বৈধ হিসেবে স্থান পাবে। সেই ক্যালকুলেশনগুলো করতে, আপনার বা আমার সাধারণ ল্যাপটপ বা কম্পিউটার অনেক বেশি সময় লাগিয়ে দেবে। কিন্তু দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের বেশ পাওয়ারফুল মেশিনগুলো তুলনামূলকভাবে কম সময়ে এই ক্যালকুলেশন করতে পারে। এই পাওয়ারফুল মেশিনগুলোকে সমষ্টিগতভাবে কিনেছে আমার বা আপনার মতোই সাধারণ মানুষেরা। তারা এই জটিল ক্যালকুলেশনের পুরস্কারস্বরূপ কিছু নতুন বিটকয়েন পাবেন, এবং এভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে নতুন বিটকয়েনগুলি।
মূলত এই হচ্ছে বিটকয়েন সিস্টেম। এই সিস্টেমে কাউকে identify করা খুব কষ্টকর এবং প্রায় অসম্ভব বলা যায়। কারণ পুরো লেনদেনটাই হচ্ছে অজ্ঞাতপরিচয়ে। ফলত কারোর জানার ক্ষমতা নেই, কার কাছে কত বিটকয়েন আছে। এই বিটকয়েনের মূল্য মূলত নির্ধারিত হচ্ছে এর যোগানের অভাব থেকে। এখনো অব্দি মোটামুটি ১৬ মিলিয়ন বিটকয়েন তৈরী করা হয়েছে এবং বাজারে আছে। তবে বিটকয়েন সর্বাধিক তৈরী হতে পারে ২১ মিলিয়ন। গাণিতিক ফর্মুলার জেরেই তার থেকে বেশি বিটকয়েন তৈরী হওয়া আর সম্ভব নয়। ফলে একটা সীমা থেকে যাচ্ছে সর্বমোট বিটকয়েনের। (অনেকটা সোনার সাথে এক্ষেত্রে তুলনা করা যায় বিটকয়েনকে) এখানে যদিও হ্যাকিং বা চুরির সমস্যা আছে। কিন্তু সেই সমস্যা যে কোনো অনলাইন ডিজিটাল মিডিয়ামের থেকে বেশি কিছু নয়, বরং খানিকটা কমই।
তবে বিটকয়েনের সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যটা হল নিয়ন্ত্রণহীনতা। যেহেতু সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই যারা Free Market Capitalism-এর সমর্থক তারা এ ব্যাপারে ভীষণ উৎসাহী। এই কারেন্সির মূল্য ঠিক করে দিতে পারে শুধুই বাজার এবং সেখানের চাহিদা-যোগানের সমীকরণ। সে কারণে তাদের উচ্ছাসের যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু পুঁজিপতিদের সমস্যাও যদিও সেখানেই, নিয়ন্ত্রণ-না-থাকা নিয়ে। কারণ সরকার শুধুমাত্র একটি যন্ত্র, যা পুঁজিপতিদের লাভ বাড়াতে সাহায্য করে। তাই সেই নিয়ন্ত্রণটুকু চলে গেলে, পুঁজিপতিরা কিভাবে তাদের লভ্যাংশ বাড়িয়ে চলবেন, সেটা বড় চিন্তার কারণ হতে পারে।
যারা anarchy পছন্দ করেন, তাঁদেরও কাছেও যথেষ্ট আকর্ষণীয় এই বেলাগাম মুদ্রা। কারণ যে established currency-গুলি আছে, সেগুলোর বাধা এড়িয়ে এই মুদ্রাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। আর সে কারণে এই মুদ্রা বিকল্প অর্থনীতির একটা দিক খুলে দিতে পারে। অলরেডি আন্ডারগ্রাউন্ড অর্থনীতিতে এর ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু কোনোভাবেই এই মুদ্রা আমাদের সম্পদের চরম অসামঞ্জস্যকে কমাতে পারবে বলে, আমার মনে হয় না। এখনকার অর্থনীতিকে সাময়িক আঘাত দেওয়া ছাড়া, একে পরিবর্তনের জন্য বিটকয়েনের দিকে না তাকানোই ভালো। বরং এখনকার রাজনৈতিক সিস্টেমের প্রতি মানুষের আস্থা কতটা কমে গেছে, বিশেষত ২০০৮-এর ফিনান্সিয়াল ক্র্যাশ-এর পরে, তার একটা প্রতিফলন পাওয়া যায় বিটকয়েনের মতো সিস্টেমের বিপুল জনপ্রিয়তায়। শেষ পর্যন্ত আমরা তাকিয়ে থাকবো, বিটকয়েন গ্লোবাল কারেন্সি হিসেবে আন্তর্জাতিক বেড়াজাল ভেঙে দিয়ে কতটা সফল হতে পারে, সেই দিকে।
No comments:
Post a Comment