Tuesday, December 25, 2018

জৈবিক নোটস

প্রত্যেকদিন, প্রতি মুহুর্তে একইভাবে দেখে চলেছি পৃথিবীটাকে। মোটামুটি ছ'ফুট উপর থেকে যেভাবে দেখা যায়। একরকম ভাবে দেখতে দেখতে দুটো আলাদা দিনের মধ্যে তফাৎ কমতে থাকে ধীরে ধীরে। কিন্তু যদি কয়েক হাজার ফুট উপরে চলে যাওয়া যায়, তাহলে আর একেকটা দিনকে সূক্ষভাবে আলাদা করার দরকার পড়ে না। তখন বিমূর্তভাবে আরো বড় সময়ের স্কেলে ঘটনাপ্রবাহকে দেখা যায়। সেই সময়ের স্কেলে, অন্ততপক্ষে একটা বৈচিত্র্য ফুটে ওঠে - কিন্তু সেই বৈচিত্র্য-এর উদ্দেশ্য কি - তা ঠিক বুঝতে পারিনা। 

একটা ফুটপাথ দিয়ে বাড়ি ফিরছি, চারপাশে অল্প কিছু ছাত্রছাত্রীরাও হাঁটছে। আমি ক্লান্ত কিন্তু পরিতৃপ্ত সারাদিনের কাজের পরে। তাহলে কি এটাই সব? এরই জন্য এতো আয়োজন? এরই জন্য সকাল ৬টায় তাড়াতাড়ি মুখ-ধোওয়া? তারপর জলদি সাইকেল করে সাড়ে ছ'টার মধ্যে গেস্টকিন বাজারে ফিজিক্স পড়তে ঢোকা? এরই জন্য সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার ফাঁকা হলদিয়া লোকালের জন্য বাগনানে অপেক্ষা করা? চেঙ্গাইলে দিলখুশ ওঠার জন্য আশা করা? এরই জন্য নন্দন, নিউটাউনে হলুদ আলোয় স্নান? এই হেঁটে ফেরার জন্যই এতো কিছু নাকি, এই হেঁটে ফেরার আগে অতো কিছু? কয়েকহাজার ফুট উপর থেকে জীবনের স্কেলে বৈচিত্র্য দেখতে পেলেও উদ্দেশ্য পাচ্ছি না - কেন হচ্ছে এসব! এই সবগুলোই তো নাহলে চলতো।

আমি এখন লেখাটা না লিখলে, আমি জয়েন্ট না দিলে, আমি চাকরি না করলে - বেশ চলতো। কিন্তু তারপরেও এসব হল, আমি আমার এখনকার "আমি" হলাম। আমি আছি, আমি থাকছি, আমি থাকবো। বুঝতে পারছি এর পরে কি হবে, বন্ধুরা দেখিয়ে দিচ্ছে - বিয়ে হচ্ছে, একটা সংসার হচ্ছে, তাতে বাদলবাবুর "মানবী"-ও হয়তো থাকছে, পরবর্তী প্রজন্ম হচ্ছে। একটা ফর্মুলায় খেলা চলছে, আমি সেই ফর্মুলা মেনে খেলছি। "এক-দুই-তিন।" চাকরি করা, চাকরি ছাড়া, পড়াশোনা, ঘুরেবেড়ানো! ফর্মুলা-ভাঙার যে ফর্মুলা সেটাকেও প্রয়োগ করতে ছাড়ছি না। "দুই-এক-তিন"। কোথাও গিয়ে বেশ রঙীন লাগছে পৃথিবীটাকে, কি বিচিত্র এই পার্থিব জীবন ! কিন্তু বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে হঠাৎ আবার ঢুকে পড়ছি সেই একঘেয়েমি কল্পচিত্রে। কারণ সবটাই তো সেই ফর্মুলার বৃত্তে আবর্তিত। আর এই একঘেয়েমিই আমার অতীত পেরিয়ে বাস্তব ছুঁয়ে আবার অতীত হবে। কিন্তু ঠিক সকলের আর পাঁচটা অতীতের মতোই তার পরিচিতি। তার মধ্যে বিশেষ কোনো স্বকীয়তা নেই, নিজস্বতা নেই, আছে সময়ের প্রতিফলন, সমসাময়িক সমাজের এক চলচ্ছবি। আমি একটা সমাজ, আমার জীবন একটা সমাজ, আমার ছ'ফুটের দৃষ্টিভঙ্গি একটা সমাজ, মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, আর আমি সেই সমাজে আবদ্ধ জীবাশ্ম!