Friday, March 23, 2018

Ticking Time Bomb - Part 2 (~১৫ মিনিট)


মার্ক জাকারবার্গ প্রথমে নিজেও মানতে চাননি যে, ফেসবুককে এভাবে অন্য কোনো দেশ নির্বাচনী কৌশলে কাজে লাগাতে পারে। তবে তিনি আঁচ করতে পারছিলেন ফেসবুকের বিশাল manipulating power-টাকে। এমনকি তাঁর নিজের রাষ্ট্রপতি হওয়ার বাসনা তৈরী হয়েছিল, আর তাই জন্যই ২০১৬-১৭-তে তিনি আমেরিকার ৫০টা রাজ্যের মধ্যে অধিকাংশ রাজ্য ঘুরে ফেলেন। আসলে যে দেশে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি হতে পারেন, সেখানে রাষ্ট্রপতি হওয়ার বাসনা সকলের মনেই জন্মায়। আর মার্কের হাতে তো ছিল আমেরিকার প্রায় সকল মানুষ সম্পর্কে খুব বিস্তারিত তথ্যভান্ডার। সিলিকন ভ্যালিতে কানাঘুঁষো শোনা যায়, সেই তথ্যভান্ডার ব্যবহার করেই জাকারবার্গ বুঝেছিলেন যে ট্রাম্পের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হওয়ায় তাঁরও যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। কিন্তু রাশিয়ান গ্রূপের খবর চাউর হওয়ার পর পরই জাকারবার্গ বুঝতে পারেন, ফেসবুকের সাথে যুক্ত থাকা অবস্থায় নির্বাচনের মতো বিষয়ে অংশ নেওয়াটা অসম্ভব। তাই তিনি তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার বাসনা মুলতুবি রেখে ফেসবুকে মনোনিবেশ করেন। তবে এই রাশিয়ানদের কথা জানাজানি হওয়ার পরও নাটকের কিছু অংশ বাকি ছিল।

ফেসবুকের কাছে আছে বিশাল তথ্যভান্ডার, তাতে আছে হাজারো মানুষের হাজারো গতিবিধি-সম্পর্কিত data। এবং এই তথ্য ভীষণ সেনসিটিভ। ফেসবুক জানে আপনি কার সাথে কথা বলছেন, কাকে পছন্দ করছেন। ফেসবুক তার অজান্তেই তৈরী করে ফেলেছে ভয়ানক এবং দুরন্ত একটি মাধ্যম। এই যে বিপুল পরিমাণ তথ্য ফেসবুকের কাছে গচ্ছিত আছে, তা দিয়ে যে ঠিক কি কি করা যেতে পারে, তার আর কোন সীমা নেই। আপনি ফেসবুককে data দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকছেন, কিন্তু আপনার data থেকে আপনার বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন যে প্রভাবিত হতে পারেন, সেটা ভাবেননি হয়তো। বিজ্ঞাপন থেকে নির্বাচন ম্যানিপুলেশন - সমস্ত রকম কাজেই ব্যবহার করা যায় এই data। কিন্তু এই বিপুল তথ্য কি আদৌ সুরক্ষিত?

এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের চলে আসতে হবে 2018-এর মার্চ মাসে। তবে তার আগে বলুন, আপনি ফার্মভিল খেলেছেন ফেসবুকে বা এমন কোনো কুইজ খেলেছেন যেটা বলে দেবে আপনার প্রিয় বন্ধু কে, বা আপনার প্রোফাইল কোন বন্ধু কত বার চেক করেছে - এই ধরণের কিছু? তাহলে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি - এসব আদৌ সুরক্ষিত কিনা সে বিষয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে। কেন? তার জন্য একটি ছোট্ট গল্প জানা দরকার।

কোগান নামের একজন বিজ্ঞানী মনস্তত্ব নিয়ে গবেষণা করছিলেন বিশ্বখ্যাত কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে কয়েক বছর আগে। যারা গবেষণা করেন, তাদের জন্যে ফেসবুক এক ধরণের স্পেশাল অ্যাপ্লিকেশন (app) তৈরি করার পারমিশন দিত। রিসার্চাররা গবেষণার খাতিরে প্রচুর তথ্য ফেসবুক থেকে ডাউনলোড করতে পারেন সেই app-এর মাধ্যমে। তবে শর্ত একটাই, গবেষণা শেষ হওয়ার পরে সব তথ্য মুছে ফেলতে হবে। কোগান তাঁর রিসার্চের জন্য একটি অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেন, ফেসবুকের ভিতরে, অনেকটা ফার্মভিল গেম অ্যাপ্লিকেশন বা ওই কুইজ অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মতো, যেগুলো আপনারা অবসর সময়ে খেলে থাকেন। তিনি একটি নিরীহ প্রশ্নোত্তর app তৈরি করেন। কোগান তাঁর research grant থেকে কিছু টাকাও বরাদ্দ করেন কিছু লোকের জন্য, যারা প্রশ্নগুলোর সম্পূর্ণ উত্তর দেবেন। প্রায় ২,৭০,০০০ জন মানুষ সেই অ্যাপ ব্যবহার করেন।

এই অ্যাপ যখন কেউ ফেসবুকে খেলবে, সে তার নিজের ফেসবুকের data access-এর পারমিশনও দিয়ে থাকে সেই অ্যাপ টিকে। ফলত কোগান শুধু প্রশ্ন আর উত্তর নয়, সব অ্যাপ ব্যবহারকারীর ফেসবুক ডাটা-ও access করতে পারেন। বলা হচ্ছে, কোগান-এর সাথে এই সময়েই যোগাযোগ হয় একটি কোম্পানির, যার নাম Cambridge Analytica. এই কোম্পানিটি বিভিন্ন দেশে ভোটারদের প্রভাবিত করার কাজ করে থাকে, রাজনৈতিক দলগুলোর হয়ে। তারা কোগানের গবেষণার স্বার্থে ডাউনলোড করা ফেসবুক data কিনে নেয়। তবে তারা মাত্র ২৭০, ০০০ জন মানুষেরই data পেয়েছিলেন, তা নয়।

সেই সময়কালে ফেসবুকের সুরক্ষায় আরো গাফিলতি ছিল। কোনো একজন user-এর data-access permission পাওয়া গেলে, তার প্রায় সমস্ত বন্ধুদের অনেক তথ্যই পাওয়া যেত ফেসবুক থেকে। ফলত ২,৭০,০০০ জন মানুষের বন্ধুবান্ধবের নেটওয়ার্ক মিলিয়ে প্রায় ৫ কোটি মানুষের data কোগান ডাউনলোড করে ফেলেন। Cambridge Analytica এই বিপুল তথ্য পাওয়ার পরে, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে খুব সুক্ষভাবে ভোটারদের প্রোফাইল, তাদের রাজনৈতিক পক্ষ সম্পর্কে ধারণা তৈরী করে। এর জন্য তারা সাইকোলজির আর এক প্রফেসরের গবেষণাকেও কাজে লাগায়, যাতে প্রায় নিপুনভাবে বলে দেওয়া যায়, কোন ভোটার মোটামুটি কি রকম ভাবছে। এর পরে যারা swing voter (নিরপেক্ষ অথবা দ্বিধাগ্রস্থ), তাদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া হয় কার্যকরী বিজ্ঞাপন। Cambridge Analytica officially ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইলেকশন ক্যাম্পেইন-এ কাজ করে। আর এর ফল আমাদের সবার প্রাপ্য ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে Cambridge Analytica বলছে, তারা শুধু আমেরিকা নয়, অনেক দেশেই তাঁদের data model-কে কাজে লাগিয়েছে, যেমন ব্রেক্সিটের সময় ব্রেক্সিটের পক্ষে, এমনকি ভারতেও।

নিউজ এজেন্সি চ্যানেল-৪ বলে একটি মিডিয়া এই সব তথ্য ফাঁস করে এই মার্চ মাসে, মাত্র কয়েক দিন আগেই। ফেসবুকের মার্কেট ভ্যালু এর পরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার নিচে নেমে যায় (যদিও শোনা যাচ্ছে, এসব আগে থেকে বুঝে মার্ক জাকারবার্গ তাঁর অংশের শেয়ারগুলি বেচে দিয়েছিলেন কিছুদিন আগে )। এই ঘটনার পরে মার্ক জাকারবার্গ একটি নিরামিষাশী ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। অবশ্য এর থেকে বেশি আর করারও কিছু নেই। কারণ ফেসবুক এই পুরো ঘটনা সম্পর্কে অনেক দিন আগে থেকেই জানতো। তারা নাকি Cambridge Analytica-কে "অনুরোধ"-ও করেছে বারবার data delete করে দেওয়ার জন্য। Cambridge Analytica এখন বলছে যে, তারা সেটা delete করেও দিয়েছেন। এই ছেলেভোলানো কথায় মার্ক ভুলতে পারেন, কিন্তু আপনি ভুলবেন কি? এতো সূক্ষাতিসূক্ষ মানুষের প্রোফাইলিং data কেউ মুছে ফেলবে? ডেমোক্রেসিকে নিয়ন্ত্রণ করার এতো সহজ উপায় হাতছাড়া কেউ করবে?

এই ঘটনায় ফেসবুকের data সুরক্ষা তো প্রশ্নের মুখে পড়েছে বটেই। কিন্তু ফেসবুকের হাতে যে এতো বৃহৎ একটা সম্পদ এসেছে, এর ঠিক ভবিষ্যৎটা কোথায়, আমার মনে হয় সে সম্পর্কেও ভাবার সময় এসেছে। আসলে ফেসবুক নিজেকে ধীরে ধীরে এতটাই বৃহৎ একটি মেশিনারিতে পরিণত করেছে যে, ক্রমশঃ তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করেছে। ফেসবুক শুধু এখন যোগাযোগের মাধ্যম তো নয়ই, এখন ফেসবুক দাঁড়িয়ে আছে মানসিক ব্যবহার ও গতিবিধি সম্পর্কে বিপুল তথ্যের সাগরের মাঝে। এই তথ্যের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকা উচিত? কোন বেসরকারি সংস্থা - ফেসবুকের মত? তাহলে তার অবস্থা তো এরকম হবে, সে তথ্য বেচে দেবে নিজেদের মুনাফার স্বার্থে। তাহলে কি সরকার এই তথ্য নিয়ন্ত্রণ করবে? তাহলে তো সে তার নিজের জনগণকেই ম্যানিপুলেট করতে কাজে লাগাবে এই তথ্যকে? তবে এই তথ্যের সঠিক অধিকারী কার হওয়া উচিত? কোনো নন-প্রফিট, জনগণের একত্রিতভাবে অধিকৃত সমবায় সংস্থার? কিন্তু তার পরিচালন পদ্ধতিই বা কি হবে? এমনকি আরো বড় প্রশ্ন সমাজে ফেসবুকের ভূমিকাটা ঠিক কি হওয়া উচিত?

আমরা কেউই ঠিক জানিনা। ফেসবুক বলেছিলো আমাদেরকে আরো বেশি যুক্ত করবে একে অপরের সাথে। কিন্তু ফেসবুকের filter bubble-এর জেরে, আমরা একে অপরের আরো দূরে সরে গেছি। শুধু পছন্দ করছি যে মতাদর্শগুলো আমাদের মনোপূতঃ। আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে তৈরি করেছি আরো বৈরিতা হিংসা ঘৃণা indifference। ফেসবুক যারা তৈরী করেছিলেন, (মার্ক বাদে) তাঁদের অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন ফেসবুক ছেড়ে দেওয়ার। ফেসবুক সামাজিক ও ব্যক্তিগত মানসিক দিকেও তর্কসাপেক্ষে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এখানে আমরা নিজেদের ইগোকে এক অসম উচ্চতায় নিয়ে চলেছি। অতীতকে পিছনে ফেলে ভবিষ্যতের দিকে সাধারণ অগ্রগতিকে রোধ করে দিয়েছি। মাঝে মাঝেই ফিরে যাচ্ছি অতীতের প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে, যাদের অনেকদিনই ফেলে আসা উচিত ছিল, তারা এখনো পড়ে থাকছে জীবনে। আর এসবের মাঝে ফেসবুক গুঁজে দিচ্ছে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী, রাজনৈতিক সংস্থার প্রোপাগান্ডা। আপনি আপাতভাবে ভাবছেন যে আমার data নিয়ে ফেসবুকের কিছুই করার নেই। অথচ, ফেসবুক তার থেকে ঠিক খুঁজে বের করে নিচ্ছে কোনটা দরকারি। আমাদের সামগ্রিক সামাজিক অগ্রগতির পথে ফেসবুক ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা কেউ জানিনা। তবে এতো বিপুল তথ্যের মালিক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার বিড়ম্বনাটা বোঝা যাচ্ছে।

আর বোঝা যাচ্ছে যে, বোমাটা কিন্তু আমরা তৈরী করে ফেলেছি। ক্রমাগত শান দিয়ে চলেছি সেই বোমায়, যাতে ওটা আরো শক্তিশালী হয়। চীনারা এই বোমাটা এড়াতে পেরেছে, কিন্তু বাকি বিশ্ব এই বোমার মোহতে এগিয়ে চলেছে। আর আমরা সবাই অপেক্ষা করছি এর পরের বিস্ফোরণটা কখন হয়। তবে ম্যাজিকটা এখানেই যে, এই বোমার বিস্ফোরণের তীব্রতা খুব বেশি হয়েও, এটি অতি সুক্ষভাবে মানবসভ্যতাকে আক্রমণ করছে। তাই এই বোমাটা সঠিকভাবে যখন তার ভয়াবহ রূপ দেখিয়ে ফাটবে, তখন আমরা বোধ হয় নিজেদেরকে বোঝার অবস্থাতেও থাকবো না। ঠিক যেমনভাবে আমেরিকানরা পারেননি। স্রেফ অপেক্ষা করে যাবো পরবর্তী বিস্ফোরণটার জন্য।

Ticking Time Bomb - Part 1 (~১১ মিনিট)

চলুন একটা গল্প বলি। গল্পটার বাস্তবতাটা যদিও খানিকটা বেশিই, তবুও এটাকে গল্পের ছলে সামনে আনাই শ্রেয়। সময়গত দিক থেকে সামান্য অবিন্যস্তভাবে গল্পটা বলবো। যারা ক্রিস্টোফার নোলান-এর স্টোরিটেলিং স্টাইলের সাথে পরিচিত, তাদের কাছে এই সময়ের দৌড়াদৌড়ি নস্যি। তবে বাকিরাও সহজে মানিয়ে নিতে পারবেন বলে মনে হয়।

যে সময়কালটা ধরবো, তা মোটামুটি ২০০৪-০৫ থেকে এই ২০১৮-এর মার্চ অব্দি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, বেশ সাম্প্রতিক অতীতের কথা, তাই মাঝে মাঝেই গল্প তার কল্পনার বেড়া পেরিয়ে বাস্তবের আঙিনায় ঢুকে পড়বে। আর আপনারাও তখন আপনাদের বাস্তবের খাড়া-বড়ি-থোড় থেকে কল্পনার থোড়-বড়ি-খাড়ায় ঢুকে পড়বেন। 

প্রথমেই, আমরা ফিরে যাবো ২০০৪-০৫ সালে। এখন ঠিক যেখানে বসে গল্পটা লিখছি, তার খুব কাছাকাছিই এই গল্পের শুরু, খোদ বস্টন শহরে। এই শহরের লক্ষ লক্ষ ছাত্রের মধ্যে থেকে মাত্র ৪-৫ জন ছাত্রের মাথা থেকে বেরোনো এক আইডিয়া, সারা বিশ্বের এক বৃহৎ সংখ্যক মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলে দিল, শুধু ব্যক্তিগত স্তরে নয়, আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক স্তরেও। আপাতভাবে খুব নিরীহ একটি আইডিয়া। কলেজে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের ছবি ও ব্যক্তিগত কিছু তথ্য-সম্বলিত একটি ওয়েবসাইট তৈরী করা হবে। সেই ওয়েবসাইটে এসে যে কেউ তার সহপাঠী বা সহপাঠিনী সম্পর্কে তথ্য জানতে পারবে।

কলেজ চত্ত্বর থেকে বেরিয়ে ২০০৬-০৭ সালে ধীরে ধীরে যখন এই ওয়েবসাইটটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, তখনও তা বেশ নিরীহই। ফেসবুকের কথা তখন বিশ্বের মানুষ সবে জানতে শুরু করেছেন। সকলে তাদের ব্যক্তিগত ভালোলাগা, মতাদর্শ এ সম্পর্কে তথ্য দেওয়া শুরু করেছেন। পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে পেতে শুরু করছেন। আবার যোগাযোগ হয়ে যাচ্ছে পুরোনো স্কুলের হারিয়ে যাওয়া সহপাঠীর সাথে, যার সাথে টিফিনবেলায় ঝগড়া হতো; আর স্কুল ছুটির পরে চুড়ান ও ফুচকা খেয়ে বাড়ি ফেরা হতো। তবে না, নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করা এই লেখার উদ্দ্যেশ্য নয়। তাই বেরিয়ে আসুন, আমরা এবার চলে আসবো ২০১২ সালে। 

সারা দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশে ফেসবুক ছড়িয়ে পড়েছে। ফেসবুক শুধু আর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম নয়, ফেসবুক একটা স্টাইল, খবরাখবর পাওয়ার জায়গা, বিজ্ঞাপনের আস্তানা, আবার গ্রূপে আড্ডা মারার জায়গাও বটে। তার কিছু আগে থেকেই, পশ্চিমবঙ্গেও ফেসবুক গ্রূপে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে ফেসবুক থেকে শুরু হতে থাকলো সংগঠিত আন্দোলন, যেমন Jasmine Revolution। বিভিন্ন মিডিয়া গোষ্ঠী ফেসবুকে তাদের নিউজ দিতে আরম্ভ করলো। ফেসবুক এগিয়ে যেতে থাকলো নতুন দিগন্তের পথে। সোশ্যাল মিডিয়াই শুধু নয়, এক আদ্যন্ত মিডিয়া হয়ে উঠলো ফেসবুক। 

এর পাশাপাশি যেটা হতে থাকলো, বিজ্ঞাপনের স্বার্থে ফেসবুক সংগ্রহ করতে লাগলো আমাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আরও আরও তথ্য। আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কি খাচ্ছেন, কোন ব্র্যান্ডের পোশাক পড়ছেন, কোথা থেকে জামাকাপড় কিনছেন, কি পছন্দ করছেন, কি ভিডিও দেখছেন, কাকে কী বলছেন - সব তথ্য জমানো শুরু করলো। এমনকি আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ ঠিক কি রকম হতে পারে, তা আপনি ফেসবুককে সরাসরি না বললেও, সে আপনার আচার আচরন দেখে মোটামুটি প্রেডিক্ট করতে শুরু করলো। মানুষের ব্যবহার সম্পর্কে এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যভান্ডার - বিশ্ব ইতিহাসে আগে কোথাও কোনও দিন তৈরি হয়নি। ফেসবুকের মধ্যে তৈরী হতে থাকলো World's largest social data bank। এই বিপুল তথ্য ফেসবুক ব্যবহার করে সেই ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপনের জন্য। ফেসবুকের পারদর্শিতা এখানেই যে, সে একদম সঠিকভাবে সঠিক লোককে উপযোগী বিজ্ঞাপনটা দেখাতে পারে, কারণ সে খুব সুক্ষভাবে জানে আপনার পছন্দ ঠিক কোন ধরণের প্রোডাক্ট। এর ফলে ফেসবুকে বিভিন্ন কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিয়ে লাভবানও হল। আপনি বিজ্ঞাপনে দেখা কোম্পানির জিনিস কিনলেন, বা সেই রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে গেলেন। এতক্ষন পর্যন্ত ব্যাপারটা মোটামুটি ঠিকই ছিল। কিন্তু বিজ্ঞাপন কি শুধুমাত্র consumer product-এরই হয়?

এই প্রশ্নের খুব সরাসরি উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের এবার চলে আসতে হবে ঠিক 2016 সালে। আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। সেই সময়কালে ফেসবুকের একজন প্রাক্তন-head লক্ষ্য করলেন, একটি আপাতভাবে-মনে-হওয়া Bernie Sanders-এর প্রচারের পেজ থেকে কিছু অদ্ভুত ধরনের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে ফেসবুকে। মানে যে বিষয়গুলোর বিপক্ষে Bernie Sanders কথা বলেন, ঠিক সেগুলোরই পক্ষে প্রচার করা হচ্ছে, অথচ ওনার স্বপক্ষে প্রচারের পেজ থেকে। পরে বোঝা যায়, কিছু লোকজন মিলে Sanders-এর বিপক্ষে তারই নাম দিয়ে উল্টো প্রচার করছিল। ততদিনে শুরু হয়ে গেছে ফেক নিউজের জমানা। যে নিউজ সত্যি নয়, তাকেই সত্যের মোড়কে জনগণের সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। আর ফেসবুক হয়ে উঠলো সেই ফেক নিউজের মূল কারখানা।

2017-তে জানা যায় আরও একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য, Russian কিছু গ্রুপ ফেসবুকে প্রায় লক্ষাধিক ডলার ব্যয় করে আমেরিকান প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে প্রচারের জন্য।  তারা অন্য প্রার্থীদের বিপক্ষেও প্রচার করেছিল। যে রাষ্ট্রটি এতদিন অন্য দেশের নির্বাচনে নাক গলিয়ে এসেছে, তাদেরই নির্বাচনে তাদেরই দেশের একটি সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে মানুষকে যে ম্যানিপুলেট করা যেতে পারে, এটা অনেকেরই ধর্তব্যের বাইরে ছিল। রাশিয়ান গ্রুপগুলি ফেসবুকের বিজ্ঞাপন-মাধ্যমকে ব্যবহার করে। ফেইসবুকের কাছে যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম data আছে প্রচুর মানুষের সম্পর্কে, সেই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে নিপুন দক্ষতায় ভোটার টার্গেট করা হয়। মানে ধরুন আপনি conservative কোনো ideology-তে বিশ্বাস করেন, তখন আপনাকে দেখানো হয় Republican party-র বিজ্ঞাপন বেশি বেশি করে। বা আপনি যদি দ্বিধাগ্রস্থ অথচ সামান্য-হিন্দু-ঘেঁষা ভোটার হন, তাহলে আপনাকে BJP-এর বিজ্ঞাপন দেখানো হবে। ফলাফল আমরা দেখতেই পাই, 2016 সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু এই গল্প শুধু বিজ্ঞাপনেই শেষ হয় না।

- বাকিটা পরের পার্টে