Friday, April 21, 2017

মনের ম্যানিপুলেশন - Manipulating yourself

বরফ পড়ে যেসব দেশে, সেখানে সূর্য ডুবে যাওয়ার বেশ পরেও একটা সফেদ উজ্জ্বলতা থেকে যায়। আকাশে যদি চাঁদের মায়াটা কখনো নাও থাকে, রয়ে যায় চাঁদের গরিমার মোহটা। এই সাদাটে ভাবটার রেশ থেকে যাওয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে দূরে সরিয়ে, একটু মন দিয়ে চারপাশটাকে অনুভব করলে, মনের মধ্যে একটা বেয়াড়া ইচ্ছের জন্ম হয়। মনে হয় জীবনানন্দকে এখানে এনে ফেলি। সাথে নির্মলেন্দু গুনকেও। প্রথমজন প্রকৃতির এই নিস্তব্ধ রঙ্গকে ভালোবাসবেন আর অক্ষর জুড়ে তৈরি করবেন আবেগ। আর দ্বিতীয়জন ওনার ভালোবাসাকে ভালোবাসবেন, তাতে তৈরি হবে কিছু "বরফমাখা জল"।

বরফের দেশে তো ওই হিমশীতল জলই আছে। বাকি সবকিছুতেই উষ্ণতার অভাব। তাই বোধ হয় পাখিরাও এখানে গান গায় না, ঠোঁট বেঁকায় না, গাছে বসে না। অন্য কোনো পাখি নয়, তবে একটা পাখির কথা বেশ মনে পড়ে। সকালে উঠে ডাকতো। মামাবাড়িতে কিংবা গ্রামের বাড়িতে বেশি শুনতে পেতাম। তবে আমাদের বাড়িতেও যে শোনা একদম যেতো না, তা নয়। সেদিন সকালে বাবা যখন ফোনে প্রাত্যহিক জীবনের চর্যা শোনাচ্ছে, পিছনে সেই পাখির ডাকটা শুনতে পেলাম। ডাকটা আমাকে বোধ হয় স্বস্তি দিলো, যে সব কিছু নিজের গতিময়তায় ঠিকঠাক আছে। কিন্তু মনটা তাতেও কেন জানিনা খারাপ করে এলো।

মনের কোনো দোষ অবশ্য নেই। যখন খুশি তার অসুখ হয়। কারণ মনকে তো আমরা খুব একটা আলাদা করে যত্ন করি না, বা অসুখ থেকে সরিয়ে তুলি না। শরীরকে যাও বা দায়ে পড়ে যত্ন করতে হয়, মনের বেলায় সে রকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অতএব অবহেলাই ওর প্রাপ্য হয়। কিন্তু আমাদের যত বয়স বাড়ে, এই দক্ষতাটাই বোধ হয় সব থেকে প্রয়োজনীয় হয়। কিভাবে মনকে শরীরের মতোই বুঝে নেওয়া যায় এবং তাকে পরিপূর্ণ পুষ্টি দেওয়া যায়, যত্ন করা যায়। মানে মনের ম্যানিপুলেশন।

যদি প্রেম করার অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে সেই ভীতকে সম্বল করে এই নিজেকে ম্যানিপুলেশনের গেমে একটা advantage নিয়ে শুরু করা যায়। এই খেলাটা নিজের সাথেই খেলতে হয়, নিজের স্বার্থেই। আর এই খেলায় শরীর পালন করে আপনার পক্ষে থাকা এক বন্ধুর ভূমিকা। ঠিক কোন হরমোনগুলো মনের ঠিক কোন জিনিসটা হরণ করে, শরীর তার খোঁজ রাখে। যেমন ধরুন চকোলেট, এটা খেলে এমন এক হরমোন ক্ষরণ হয়, যা আপনার মনকে খুশি করবে। সুতরাং, মনের কোনো অকারণে খারাপকরা সময়ে এই ওষুধ কাজ করে যেতে পারে। আবার খুব অবসাদ বা আলস্যের সময়, একবার ঈষদুষ্ণ জলের তলায় যদি শরীরটাকে ভিজিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে কিছুটা স্বস্তি মেলে। একটা জমাট ঘুমও মনকে বেশ খানিকটা সতেজ করে তোলে, আর ঘুমের ভিতরে মন নিজের মতো করে অনেক কিছু সাজিয়ে-ঘুছিয়েও নেয়। আবার কনফিডেন্স বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য নিজে যে কাজটায় বেশ পারদর্শী বা যে কাজটা করতে বেশ পছন্দ, সেরকম কিছু করে নেওয়া যেতে পারে। নিজের যে কোনো নতুন সৃষ্টিই মনের মধ্যে একটা আলাদা আরাম বয়ে আনে। এসব ছাড়াও খুব খারাপ লাগলে, স্রেফ প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলেও, নিজের অস্তিত্বের একটা নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। এই বিশ্ব-সংসারে সবকিছুর সাথে একাত্ব হওয়ার অনুভূতিটা কিন্তু কম কিছু নয়।

তবে যখন মন কোনো কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন তার রোগ নির্ণয় করে তাকে সঠিক ওষুধ বাতলানোটাই প্রকৃত চ্যালেঞ্জ। আর সবার জন্য তো ওষুধ এক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু যদি নিজেদের মধ্যেই একটা দ্বৈত স্বত্ত্বা তৈরি করে মনকে নজর রাখা যায়, তাহলে কিন্তু মনের আলাদা করে খেয়াল রাখা যায়। অন্তত মনের ভিতরে কি চলছে, তার হালহকিকতের একটা আভাস মেলে। সেটুকুই যথেষ্ট মনের যত্ন নেওয়ার শুরু করার জন্য। শুরুটাই হোক, সু-মনে থাকার। বরফের দেশের রাতে সূর্যের অনুপস্থিতিতে সবকিছুই খুব হতাশাজনক লাগতে পারে, কিন্তু তখনও তো থেকে যায় সূর্যের ফেলে যাওয়া আলোর রেশ। তা দিয়ে তো জীবনানন্দের মতো কেউ রোমাঞ্চও তৈরি করতে পারেন। তাই এই আশাটুকুই থাকুক না!

Saturday, April 15, 2017

বাংলা সঙ্গীতের নয়া হাইপ - New hype in Bengali Music

ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ ১৮৬১-তে জন্মেছিলেন, তাই ২০১১-এর আশপাশ থেকে শুরু হয়েছিল ওনার জন্মের সার্ধশতবর্ষ পালনের হিড়িক। আর বাংলা সঙ্গীত সেই সুযোগে আরো কিছুদিন ওনার কাঁধে ভর করে বেঁচে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন প্রায় ৫ বছরের ওপর কেটে গিয়েছে সেই হাইপের। এখন বাজারের নতুন হাইপ লোকসঙ্গীত। পল্লীগীতিগুলোকে নতুন প্যাকেজে বাজারে আনা। বেশ অনেকদিন থেকে চলছিল এই ব্যাপারটা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জন্মের ১৫০ বছর পালনের সময়টা কেটে যাওয়ার পর অতীতে-বেঁচে-থাকতে-চাওয়া বাঙালির "নতুন" অতীতচারণের দরকার পড়লো। সুতরাং বাজারে নতুন মোড়কে ছাড়া হল ফোক গানকে।

ফকিরার ইতরপনা অ্যালবাম দিয়ে শুরুর দিকটা বেশ সুন্দর হয়েছিল। এখনো সে গান নেশার মতো কানে লেগে আছে। কিন্তু কোনো ফর্মুলা যদি মার্কেটে খেটে যায়, সেটাই বারবার ব্যবহার করে মুনাফা করার নিয়ম। সুতরাং সব্বাই সেটা করতে লাগলেন। আর বাঙালি কে পায় কে? পাওয়া গেছে "আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম", ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে সেটাই শোনা চালু হল। স্বাধীন সঙ্গীত যে কত বছর থেকে শোনা হচ্ছেই না, সেটার কোনো খেয়ালই আর কেউ করলো না। অথচ এর মধ্যে যে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক হয়নি, তা নয়। কিন্তু সেগুলো কোনো জায়গাই পায়নি। এর মধ্যেই অনুপম রায় পুরো ব্যাপারটাই বুঝলেন।

অনুপম দেখলেন এমনি নিজের গানগুলো আলাদা অ্যালবাম করে বার করা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে চলে গেছে। সুতরাং, নিজের গানগুলো চালান করে দিলেন সিনেমার গানে। সাথে ফি-বছর একটা করে নিজের অ্যালবাম করার কনট্র্যাক্ট আদায় করে নিলেন। কিন্তু সেটা অনুপমের স্ট্র্যাটেজি আর সাফল্য অনুযায়ী খেটে গেলো। বাকিরা সেটা করতে পারলেন না। ফলে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক পিছিয়েই পড়লো।

ইতিমধ্যে ফোক সঙ্গীতের জনপ্রিয়তা এখনো বিদ্যমান। আর যাহা কিছু মার্কেটে খাটে, তাহাকে আরোই মার্কেটে লাগাও। এই ফর্মুলাই ব্যবসায়ীরা বোঝেন। তাই ফোক সঙ্গীত ঢুকে পড়লো ছায়াছবির গানেও। অনেকদিন ধরে একটু একটু করে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিলো। প্রাক্তনে "ভ্রমর" ব্যবহার করা হল। কিন্তু "দূর্গা সহায়" বললো অতো রিস্ক নিয়ে লাভ নেই,যা আছে যত পারো ঢুকিয়ে দাও। তাই ফোক গানের মেডলি তৈরী করে ফেললো (https://www.youtube.com/watch?v=8PaCWoL31Yg)। কপিরাইট যখন নেই, আর মানুষ যখন খাচ্ছে, তখন চালিয়ে দিতে তো অসুবিধে নেই।

পুরোনো জিনিসের নতুন মোড়ক - ব্যাপারটা খুব একটা খারাপ না। এতে পুরোনো জিনিসেরই কদর নতুন প্রজন্মের কাছে বাড়ে। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, সেই নতুন মোড়কটাই যখন পুরোটা বাণিজ্যের স্বার্থে চলতে থাকে। যেটা রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে হয়ে গেলো। একটা সময় এত্ত ভীষণ পরিমান রবীন্দ্রসঙ্গীত বেরোতে শুরু করেছিল, যে মান পড়তে লাগলো। এই পল্লীগীতির নতুন মোড়ক নিয়েও একই শুরু হয়েছে। তাই পুরোনোকে নতুন করে আনার সহাবস্থান থাকুক, শুধু সেটা যেন বাণিজ্যের খাতিরেই না হয়। তার মধ্যে শিল্পটাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলবেন না। ফোক সঙ্গীত তো শিল্পের অকৃত্তিম চরিত্রের কথাই তুলে ধরে, সেটাই থাকুক না!

Thursday, April 06, 2017

প্রযুক্তি ও তার ভবিষ্যৎ ২ - Technology and its future 2

জীবনবিজ্ঞান পড়তে কোনোকালেই ভালো লাগতো না। বরাবরই বায়োলজিকে সাবজেক্ট হিসেবে এড়িয়ে এসেছি। কিন্তু কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পরে দেখলাম, শেষে কিনা প্রযুক্তির এই দুর্নিবার গতি আসলে বায়োলোজিকেই অনুসরণ করছে! আমরা যেভাবে ভাবি, কাজ করি, সিদ্ধান্ত নিই, সেগুলোকেই একটা যন্ত্রকে দিয়ে করাতে চাইছি আমরা। আর তার উদ্দেশ্যেই হয়ে চলেছে কম্পিউটার সায়েন্সের বেশিরভাগ গবেষণা। এই গবেষণা এগোচ্ছে বেশ দারুন গতিতে সফলভাবেই। তবে এই সফলতা যে মানবজাতির ভালো কাজেই আসছে, তা নয়। সফলতার পরিণাম হিসেবে আমরা পাচ্ছি বিপুল সংখ্যক মানুষের বেকারিত্ত্ব এবং "termination of employment"। এই লেখার মূল উদ্দেশ্য, কম্পিউটার সায়েন্সের যে বিভাগটা এই আমূল পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, সেই বিজ্ঞানটা কিভাবে আমাদের চারপাশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে, তার খোঁজ করা। 

যেসব আবিষ্কারগুলো এ যাবৎকাল ধরে মানুষের সভ্যতার গতি-প্রকৃতি আমূল পাল্টে দিয়েছে, তাদের কয়েকটা হল - আগুনের আবিষ্কার, বিদ্যুৎ, পারমাণবিক বোমা। আর আগামী কয়েকবছরে যে আবিষ্কারটা সভ্যতার বেশ খানিকটা পরিবর্তন ঘটাতে চলেছে, তা হল: Machine Learning (মেশিন লার্নিং বা ML) এবং Artificial Intelligence (আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স বা AI).

প্রথমে বলা যাক, মেশিন লার্নিং ঠিক কি? খুব ছোট্ট কথায়, কম্পিউটারের কাছে সাধারণত যে বিপুল পরিমাণ তথ্য থাকে, তা থেকে কিছু আকর্ষণীয় বা গুরুত্ত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে অথবা ফলাফলে আসার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির নাম মেশিন লার্নিং। যদিও আমি এখানে চূড়ান্ত অ-বৈজ্ঞানিক একটা সংজ্ঞা দিলাম। যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তারা জানেন, এই মেশিন লার্নিং-এর পিছনে লুকিয়ে আছে খুব নিগূঢ় কিছু গাণিতিক থিওরি। কিন্তু যেহেতু এই লেখাটা বিজ্ঞান আর অর্থনীতির সম্পর্ককে ধরতে চাইছে, তাই এরকম একটাই সংজ্ঞাই আপাতত সঙ্গত মনে হল।

যাই হোক, এখন যে প্রশ্নটা মাথায় আসতে পারে, তা হল - কম্পিউটার তাহলে তার সঞ্চিত তথ্য থেকে কিভাবে কিছু দুর্দান্ত সিদ্ধান্ত বা কিছুটা অজানা তথ্যের সন্ধান দেওয়ার চেষ্টা করছে? প্রায় সেভাবেই, যেভাবে আপনি আপনার মস্তিষ্কে করে থাকেন। আপনার মাথায় যেমন আছে একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক, যেটা বোঝার চেষ্টা করে, লাল সিগনাল জ্বলছে মানে আমাকে ট্রাফিকে দাঁড়াতে হবে, অথবা সেই জাতীয় কিছু সেরিব্রাল কাজ; ঠিক সেরকমই কম্পিউটার তৈরি করছে তার ভিতরে একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক। আমরা যা যা জানি, যে যে বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য আছে - তা দিয়ে এরকম নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন নিউরাল নেটওয়ার্কের উদ্দেশ্য আলাদা হতে পারে। যেমন, কোনো নিউরাল নেটওয়ার্ক শুধুই চালক-বিহীন গাড়ি চালানোর কাজে লাগানো যেতে পারে। আবার কোনো নিউরাল নেটওয়ার্ক শুধুই দুর্দান্ত দাবা খেলার কাজে আসতে পারে। দাবার কথা বললাম, কারণ দাবা সবথেকে কঠিন খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু সেই কঠিন খেলাতেও মানুষের থেকে বেশি পারদর্শী হয়ে একটি কম্পিউটার মানুষকে হারিয়ে দিচ্ছে। এখানে এটা বোঝা খুব জরুরি যে, এই নিউরাল নেটওয়ার্ক এইসব কিছু নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য মানুষের থেকেও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। কারণ মানুষের যে সব সীমাবদ্ধতা, যেমন খুব বেশি তথ্য মনে রাখতে না পারা বা ক্লান্ত হয়ে যাওয়া, এই সমস্যা কিন্তু কম্পিউটারের প্রায় নেই। ইতিমধ্যেই দাবার থেকে কঠিন প্রেডিকশানের খেলাগুলোতেও, যেমন পোকার বা চীনের গো নামক খেলাগুলোতে, বিশ্বের চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে দিয়েছে কম্পিউটারে বসে থাকা মেশিন লার্নিং সিস্টেম। এবার এই সিস্টেমকে জীবনের অন্য ক্ষেত্রের সমস্যা সমাধানে প্রয়োগের পালা।

কিন্তু তার আগে আর একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। এই যে মেশিন লার্নিং-এর সাহায্যে নতুন প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে আরো সহজ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে, সেটা কি খুব নতুন কিছু? মেশিন লার্নিং আর তাকে কাজে লাগিয়ে আমরা যে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা গড়ে তুলছি যন্ত্রের ভিতরেই - তার সাহায্যে আমরা ঠিক কোন ধরণের কাজগুলোকে আরো সহজে করে ফেলতে পারবো? সেই কাজগুলো, যেগুলোতে আমাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা লাগতো। মানে ধরুন, আমাদের কাছে আছে - প্রচুর রোগীর ব্যক্তিগত তথ্য ও তাদের যে রোগ হয়েছিল, তার প্রাথমিক symptom কিরকম ছিল, তার একটা ইতিহাস। সেই তথ্য শুধু দিয়ে দিতে হবে কোনো মেশিন লার্নিং সিস্টেমকে। এর পরে ওই সিস্টেম তার পারদর্শিতা দেখাতে শুরু করবে।  সিস্টেমকে এর পরে শুধু বলতে হবে কোনো নতুন এক রোগীর প্রাথমিক symptom-গুলো।  তাহলে সেই সিস্টেম বলে দিতে পারে, খুব সহজেই, কোনো নতুন রোগীর ঠিক কোন রোগটা হয়ে থাকতে পারে। এই কাজটা কোনো ডাক্তারও হয়তো বিশ্লেষণ করে করতে পারেন, কিন্তু একটা মেশিনেরও সেই ক্ষমতা জন্মাচ্ছে। এর মানে এই নয় যে, কাল থেকে আর ডাক্তারদের দরকার হবে না। ডাক্তাররা চিরকালই আমাদের সমাজে মূল্যবান, কিন্তু তাদের একটা অল্টারনেটিভ থাকছে। আরো বড় আকারে বললে, আমরা বিশ্লেষণী ক্ষমতার কাজগুলোকে হয়তো মেশিনের সাহায্যেই করতে শুরু করছি।

এতদিন যাবৎ আমরা মূলত কায়িক শ্রমের কাজগুলোকে মেশিনের মাধ্যমে করানোর চেষ্টা করছিলাম। ফোর্ডের গাড়ি কারখানাতে, গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ একটা কনভেয়ার বেল্টে পরের পর জুড়ে যাচ্ছে। একটা গাড়ি তৈরি করার জন্য, মানুষের সাহায্যের দরকার প্রায় হচ্ছেই না। এই দৃশ্য আমরা এতদিন দেখে আসছি। কিন্তু এবার, যে সব কাজে analytical ability লাগতো, সেগুলোতেও মানুষের থেকে দক্ষ বিকল্প আসা শুরু হয়েছে। এই পরিবর্তন এখনো খুবই শুরুর দিকে, কিন্তু একে বলা হচ্ছে Industrial Revolution 4.0। যেহেতু কম্পিউটার এখন নিজেই মানুষের থেকেও বেশি বুদ্ধিমান হয়ে যেতে চলেছে, তাই প্রযুক্তির উন্নতিতে এর পরের প্রগতিটা হয়তো খুব দ্রুত হবে। কিন্তু আমরা কি তৈরি এই পরিবর্তনটার জন্য? অর্থনৈতিক ভাবে?

এই পরিবর্তনটার অর্থনৈতিক দিকটা নিয়ে একটু গভীরে ভাবা যাক। যখন কায়িক আর বিশ্লেষণী ক্ষমতা দরকার, এমন কাজগুলো একটা কম্পিউটারই করতে পারবে, তাহলে মানুষের জন্য ঠিক কোন ধরনের কাজ পড়ে থাকবে? মূলত, তিন ধরণের। প্রথমত, কোনো শিল্পীর শৈল্পিক এবং স্বতন্ত্র কাজগুলো। যদিও কম্পিউটার এখনই নতুন ধরণের গান-বাজনা নিজেই তৈরী করতে পারছে, তবুও আমার মনে হয় শিল্পের জায়গাটা মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে যেমন ছিল, তেমনি ভবিষ্যতেও থেকে যাবে। কারণ শিল্পটা শুধুমাত্র তথ্যের ওপর ভিত্তি করে হয়না। তার জন্য সৃজনশীলতা লাগে, যেটা কোনো কৃত্তিম নিউরাল নেটওয়ার্ক আপাতত দিতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, একজন রিসার্চারের নতুন উদ্ভাবনী কাজগুলো। মূলত আগের বলা কারণেই কম্পিউটার এখনো স্বতন্ত্রভাবে নতুন উদ্ভাবন করার ক্ষমতা ধরে না। এবং আগামী ৫০ বছরে সেরকম নতুন idea নিজে গড়ে তোলার ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। আর তৃতীয়ত এবং শেষ, কোনো সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে অন্য মানুষকে convince করার কাজটা। মূলত MBA যারা করেন, যারা কোনো সংস্থার leader বা মানুষের psychology বা মনস্তত্ব নিয়ে যারা কারবার করেন, তাদের কাজটা আপাতত বেশ কয়েকবছর কম্পিউটারের পক্ষে করা অসম্ভব। কারণ কোনো রোবট বা মেশিন লার্নিং সিস্টেম মানুষের সাথে তর্কে জিততে পারেনা।

এই যে কতিপয় কাজ পড়ে থাকবে, তাতে অনেক মানুষ তো কাজ হারাবেন। তাহলে কি আমাদের সমাজ ভেঙে পড়বে? এতটা সহজে নয়, কারণ এই প্রযুক্তির আশীর্বাদেই আমরা পৌঁছবো আমাদের উৎপাদন ক্ষমতার শিখরে। মেশিনরা এখনই এত সুদক্ষ যে আমাদের সারা পৃথিবীতে যা খাবার উৎপাদন হয়, তা দিয়ে পৃথিবীর সকলের অন্ন-সংস্থানে কোনো অসুবিধাই হওয়া উচিত নয়। অনেকেই হয়তো জানেন, যে অন্ন-সংস্থানের থেকেও মূল সমস্যাটা অন্ন-ভাগ করে দেওয়ার। আর মেশিন লার্নিং আমাদের এমন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে শুধু বর্তমান নয়, আমরা ভবিষ্যতের খাদ্য এবং অন্য সামগ্রী সংকুলানের নিশ্চয়তা দিতে শুরু করেছি। কিন্তু মুশকিল হয়ে যাচ্ছে, সেই একটাই জায়গায়। এই সমস্ত সিস্টেমের দখল থাকছে খুব কম কিছু মানুষের হাতে। ফলে বর্তমান বা ভবিষ্যতের যে নিশ্চয়তা আমাদের আয়ত্ত্বে আছে, তা আমরা সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পারছিনা। সুতরাং, প্রযুক্তির এই কুক্ষিগত হওয়ার প্রবণতাকে বন্ধ না করতে পারলে, আমরা কখনোই এর সুফলগুলো উপলব্ধি করতে পারবো না। মানুষ এখন যেমন বেশি সংখ্যক হারে কাজ হারাচ্ছেন, সেটাই বাড়তে থাকবে। অর্থ জমা হতে থাকবে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছেই, যেমনটা এখন হচ্ছে। 

এবার চোখ ফেরানো যাক, আমাদের চারপাশের হালহকিকত নিয়ে। ভারতের ইনফরমেশান টেকনোলজির সেক্টরে গত প্রায় ১৫-২০ বছরে যে বিপুল জোয়ার এসেছিলো, তা হঠাৎই ধাক্কা খেয়েছে, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। Cognizant, Wipro, Infosys থেকে শুরু করে প্রায় সব বড় Services সেক্টরের কোম্পানিগুলো তাদের কর্মীদের ছেঁটে ফেলছেন। এবার ওপরে যে নতুন সিস্টেমের আবির্ভাবের কথা বললাম, সেটার কথা চিন্তা করুন। গত কয়েক বছরে ওই সিস্টেমের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কারণ এতো বিশাল পরিমান তথ্য রাখার এবং তাকে দ্রুত প্রসেস করবার মতো computing power আমাদের কাছে ছিল না। কিন্তু এখন যখন এসব সম্ভব হচ্ছে, তখন এই বিশাল সংখ্যক IT employee-দের কোম্পানিগুলোর দরকার হচ্ছে না। তারা নতুন সিস্টেমের সাহায্যে আরো সস্তায় নিজেদের কাজগুলো করে ফেলতে পারছেন। মানুষের সাহায্যের দরকার পড়ছে না, যেমন একসময় ফোর্ডের দরকার পড়েনি, তাদের গাড়ি তৈরী জন্য নতুন শ্রমিকের। সুতরাং, এটা বুঝতে হবে যে, এই মুছে-যাওয়া কাজগুলো কিন্তু আদৌ আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। বরং আরো আরো বেশি হারে, এই IT-Services সেক্টরে কর্মীসংখ্যা কমতে চলেছে। কম্পিউটার নিজেই নিজেকে খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আশা করবো ফোর্ডের দরুন যে করুন দুর্দশা ডেট্রয়েটের হয়েছিল, তা ভারতে হবে না। ডেট্রয়েট যদিও এখন ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে, কিন্তু ধুলোয় মিশে যাওয়া সেই ডেট্রয়েটের স্বাদ, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে খুবই তিক্তভাবে ধরা দিতে পারে।

তবে আমরা কি অন্ধকার কোনো ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে চলেছি? এতো সম্ভাবনা সত্ত্বেও? সত্যিই, এই মুহূর্তে মেশিন লার্নিং এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্সকে মোকাবিলা করে', নতুন ধরণের কাজ তৈরী করার মতো কোনো সমাধান আমাদের সিস্টেমের কাছে কিন্তু নেই। সারা পৃথিবী জুড়ে সকলেই চাইছেন, নতুন কাজ সৃষ্টি করতে। কারণ নতুন কাজ ছাড়া মানুষ টাকা উপার্জন করতে পারবেন না। ফলে যে সব সামগ্রী উৎপাদন হচ্ছে, সেগুলো কেনবার লোকও পাওয়া যাবে না। এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেরই সম্মুখীন আমরা, আবারো। এই দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়, ১৯৩০, ১৯৭০, ২০০০, ২০০৮ - বারবারই এই দ্বন্দ্বের জন্যই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ দুর্দশাগ্রস্থ হয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেকবারই জোড়াতালি দিয়ে আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি, কিন্তু সমস্যাটাকে সমূলে আঘাত করা হয়নি। এবারের সমস্যাটা আরো আলাদা কারণ এর আগে কোনোবারই মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে কোনো চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হয়নি। এই কারণেই এবারের এই সমস্যা এতো প্রলম্বিত, ২০০৮ সাল থেকে আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি। 

আমরা যদি সামগ্রিকভাবে নতুন করে না ভাবতে পারি, যদি সমষ্টির কথা না ভাবতে পারি, তাহলে দুর্গতি আরো বাড়তে বাধ্য। সমষ্টিগতভাবে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে রাখতে পারলে, তবেই প্রযুক্তির সুষম বন্টন সম্ভব হবে, নচেৎ নয়। তাই যদি পারেন, এই সার্ভিসেস সেক্টরের কবল থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরোনোর চেষ্টা করুন, নাহলে পরবর্তী পিঙ্ক স্লিপটি আপনার নামে আসতে চলেছে।