Saturday, June 26, 2021

The Lost Decade

একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের শুরুতেই আমরা মহামারী, বেকারত্ব, বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো সমস্যার সম্মুখীন। আবার এর সাথে সাথেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি মহামারীর প্রতিষেধক ভ্যাকসিন, যা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতির ফলেই এতো দ্রুত সম্ভব হচ্ছে। সাথে ট্রাম্পের পরাজয় এই নতুন দশকের শুভ সূচনা। ভালো-খারাপের এরকম আলো-আঁধারিতে আমাদের নতুন দশকে এগিয়ে চলা। আমেরিকার রাজনীতিতে আগামী দশক, বোধ হয়, আধুনিক ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই একই কথা ভেবেছিলেন সেই মানুষগুলো, যারা ২০১০-এ ওবামাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই নতুন দশকের শুরুতে পিছনে ফিরে দেখা দরকার, সেই ফেলে আসা দশকটার যে বড় বড় স্বপ্নগুলো ছিল, তাদের হাল কি হল?

এই লেখাটার শিরোনামটা একটু গোলমেলে ঠেকতে পারে, যদি আমরা কিছু cherrypick করা তথ্যের দিকে তাকাই। আমেরিকার সব থেকে ধনী ১ শতাংশ মানুষ তাঁদের অর্থের পরিমান দ্বিগুন (১৭ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে ৩৪ ট্রিলিয়ন ডলার) করেছেন ২০১০-১৯-এর দশকটিতে [1]। তাঁদের কাছে এই দশক নিশ্চয়ই কোনো "lost decade" নয়। এই মাত্র এক শতাংশ সবথেকে ধনী মানুষ ২০১০ সালে আমেরিকার total wealth-এর ২৮ শতাংশের মালিক ছিল, ২০২০-তে তাঁরা ৩০-এরও বেশি শতাংশের মালিক। এই কতিপয় কিছু মানুষকে ওবামা হোক বা ট্রাম্প - দুজনেই বেশ "দক্ষ রাষ্ট্রপতি"র মতোই সেবা করেছেন।

এবার একটু পিছিয়ে পড়া জনগণের দিকে তাকাই। ধনসম্পদের দিক থেকে আমেরিকার সবথেকে নীচের ৫০ শতাংশ লোক ২০১০-এর শুরুতে মাত্র ০.৫% সম্পত্তির মালিক ছিলেন। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন, এতটাই কম। কপর্দকশূন্য বললেও অত্যুক্তি হয়না। ২০০৮-এর ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিসের পরে এই নিচে থাকা লোকগুলোর অবস্থা পথে বসার থেকেও খারাপ হয়েছিল। তারপর থেকে ধীরে ধীরে উঠে এসে এই নিচের ৫০% লোক এখন আমেরিকার মাত্র ২% সম্পত্তির অধিকারী হতে পেরেছেন। তবুও মধ্যবিত্ত আমেরিকান আর সবথেকে ধনী ১% আমেরিকানদের মধ্যে সম্পত্তির পার্থক্য ১০০০%। জানিনা এই বৈষম্যকে কোন বিশেষণ দিয়ে জাস্টিফাই করা যায়। যে দশকে ওবামার মতো তথাকথিত "ভালো রাষ্ট্রপতি" ৬ বছর দেশ শাসন করলেন আর ডেমোক্র্যাটের মতো লিবারালরা কিছু বছর ধরে আপার ও লোয়ার হাউস নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত করলো, সে দেশেও এই অবস্থায় রয়ে গেছে।

এর কারণ নিয়ে বলতে গেলে হয়তো ওবামার নতুন বই "A Promised Land"-এর মতোই বড় একটা বই লিখতে হয়। কিন্তু তার থেকে ছোট করে সংক্ষেপেও কিছু বিষয় দেখে নেওয়া যেতেই পারে। এটা থেকে আমরা ঠাওর করতে পারবো যে, রাজনীতির অভিমুখ ঠিক কিরকম হলে এই ধরণের অর্থনৈতিক ব্যর্থতা আসতে পারে।

ওবামা আমেরিকার প্রথম কৃষাঙ্গ রাষ্ট্রপতি। ওবামাকে ঘিরে আমেরিকায় উচ্ছাস তৈরী হয়েছিল ২০০৮ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার প্রথম থেকেই। কিন্তু ওবামা ক্ষমতায় আসার পরই বড় বড় ব্যাঙ্ক এবং ফিনান্সিয়াল সংস্থাগুলোকে প্রচুর পরিমান সরকারি অর্থসাহায্য দিলেন। এদের তখন বেশিরভাগেরই দেউলিয়া অবস্থা। তাঁদেরকে বলা হল "too big to fail", মানে এরা না থাকলে আমেরিকা দেশটাই টিকবে না। সাধারণ মানুষের জীবন এসব ব্যাঙ্কগুলোর সঙ্গে এমনভাবেই জড়িয়ে যে এই ব্যাঙ্কগুলিকে বাদ দিয়ে আমেরিকা, এমনকি আধুনিক বিশ্বকেও ভাবা যায়না। কিন্তু তবুও এদের রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে ঘোষণা করার কথা ভাবা তো হলই না, উপরন্তু রাষ্ট্রীয় ট্যাক্স ডলারে এদের "বেইল আউট" করানো হল, যাতে এই ব্যাঙ্কগুলো বসে না যায় [2]। কিন্তু কার্যত দেখা গেলো, এই প্রচুর পরিমান অর্থসাহায্য পৌঁছালো ব্যাংকের CEO, CFO-জাতীয় উচ্চপদে বসে থাকা বিশাল সম্পত্তির মালিকদের হাতে [3]। এছাড়াও ওবামা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় বুশ জামানার ট্যাক্স ছাঁটও বহাল রেখে দিলেন। আর ট্রিকল ডাউন অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী মোট সম্পদের খুব সামান্যই পৌঁছালো পিছিয়ে পড়া, "ওয়ার্কিং ক্লাস" মানুষদের কাছে। ওবামা প্রথমেই যে বিশাল সুযোগ পেয়েছিলেন - আমেরিকার বিসদৃশ সম্পত্তির বৈষম্যকে মুছে দেওয়ার - উনি ওনার রাষ্ট্রপতি শাসনের প্রথম মেয়াদে তার সামান্যও করতে পারেননি।

এর পরবর্তীকালে ওবামা কিছু মানুষের জন্য, যাঁদের বেশিরভাগ বৃদ্ধ ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মী, প্রায় নিখরচায় স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু করলেন, যাকে আমেরিকান মিডিয়া বিপ্লবী বলে আখ্যা দিতেও পিছপা হয়নি [4]। কিন্তু তারপরেও আমেরিকার প্রায় ১০% বা ৩ কোটি মানুষের কোন স্বাস্থ্যবীমাই ছিল না, এখনো নেই। তাছাড়াও স্বাস্থ্যবীমার বিষয়টি মানুষের চাকরির সঙ্গে যুক্ত হয়েই থেকে গেলো - মানে যতদিন ভালো চাকরী আছে, ততদিন বীমা আছে, নচেৎ নয়। অথচ এটা এখন প্রায় সবার জানা কথা, এবং বিভিন্ন গবেষণা বলেছে যে, বেশিরভাগ মানুষ গরীব থেকে আরো গরীব হয়ে যায় মূলত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত খরচ সামলাতে না পেরে। আর এটা একটা রিকার্সিভ ফাংশনের মতো, যেখানে টাকা-পয়সার সমস্যার কারণে অনেকেই ঠিক করে নিজের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে পারেন না, খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক করতে পারেন না, ওষুধ কিনতে পারেন না। ফলে তাঁরা আরো বেশি করে রোগে ভুগতে থাকেন। যার ফলে তাঁরা বেশি বেশি করে দেনার কবলে চলে যেতে থেকে থাকেন।

এরপর আর একটি পয়েন্ট বলে আপাতত শেষ করবো। ওবামা এবং ওনার ডেমোক্র্যাটিক পার্টি যা তথাকথিত লিবারাল পার্টি হিসেবে পরিচিত, তাঁরা নিজেদের cultural বামপন্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এতো সচেষ্ট ছিলেন, যে অর্থনৈতিক দিকে তাঁদের প্রায় কোনো নজরই ছিল না। cultural leftist issue গুলো মূলত freedom of abortion বা "pro-choice", gay marriage, কৃষাঙ্গদের অধিকার - এসবকে কেন্দ্র করে তৈরী করা হয়েছিল। এগুলো একটা উন্নত সমাজে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যখন একটা রাজনৈতিক মঞ্চ শুধুমাত্র এই ইস্যুগুলোকে কেন্দ্র করেই তৈরী হয়, তখন সেই রাজনীতি থেকে বৃহত্তর জনগণের পাওনা বলে কিছু থাকেনা। ফলত আমরা শেষ দশকের শেষার্ধে দেখতে পেতে থাকি, "me too" মুভমেন্ট। যা আদতে মেয়েদের বহু বহু বছর ধরে নিপীড়ত থাকার দরুন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। আমরা ট্রাম্পকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে পাই আমেরিকায়। আমরা দেখতে পাই ব্রিয়োনা টেলর বা জর্জ ফ্লয়েডকে মারা যেতে হয় পুলিশের হাতে, হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্টদের হাতে। এতো সবের পরেও ট্রাম্প সাড়ে সাত কোটি ভোট পান ২০২০ সালে। তাই অর্থনীতি ব্যতিরেকে যে সাংস্কৃতিক উদারবাদ বা বামপন্থা হতে পারেনা - আধুনিক ইতিহাসে এই দশকই তার সেরা উদাহরণ এবং আমাদের কাছে শিক্ষনীয়। 

ভীষণ আশা জাগিয়েও এই দশকের শেষে যে করুণ হাল আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিতে গেলে বলা যায়, আগের দশকের রাজনীতি সাংস্কৃতিক উদারবাদের সাথে অর্থনৈতিক উদারবাদের ছায়াযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। অর্থনৈতিক উদারবাদ সমাজে যে ভীষণ মেরুকরণ তৈরি করছে, তাকে মেনে নিতে পারছে না প্রগতিশীল সমাজ। অথচ অর্থনৈতিকভাবে প্রগতিশীল নীতিগুলো - সবার জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, বাসস্থান, সমবায়ের মাধ্যমে কোম্পানি পরিচালনা, গ্রিন এনার্জিতে বিনিয়োগ - সেগুলোকেই আমরা শুরু করতে পারছিনা বা রাজনৈতিক ইস্যু করে তুলতে পারছিনা। এসব নীতির ওপর ভিত্তি করেই যে আমরা অন্য প্রগতিশীল ইস্যুগুলোকে ছুঁতে পারবো, সেটা আশা করি পরবর্তী দশক আমাদের বোঝাবে, আর আমাদের রাজনীতিও সাংস্কৃতিক উদারবাদের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে।


[1] https://www.federalreserve.gov/releases/z1/dataviz/dfa/distribute/chart/#range:2009.4,2019.4

[2] https://money.cnn.com/2009/01/06/news/economy/where_stimulus_fits_in/

[3] https://abcnews.go.com/Business/story?id=8214818&page=1

[4] https://www.foxnews.com/transcript/bill-oreilly-obamacare-and-socialism