Saturday, December 24, 2016

২০১৬ - 2016

ফেসবুক একটি ভিডিওর মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে আমার এই বছরের সারসংক্ষেপ। সেটা দেখতে দেখতেই মনে হল, ফেসবুকের পক্ষে তো সব কিছু জানা সম্ভব নয়। এ বছরে যে চলমান ছবিগুলো বাস্তবের সীমারেখা পেরিয়ে মনের পরিখায় আটকে গেলো, সেগুলো তো একমাত্র আমার ব্যক্তিগত হাসি-কান্নার রাংতায় মোড়া বাক্সে রাখা। সেই ছবিগুলোর কিছু কিছু, অনুভূতির রংতুলি দিয়ে লেখার মধ্যে দিয়ে এঁকে দিতে ইচ্ছে করছে। কোনো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তো এই ছবি থেকে লেখায় রূপান্তরের বিদ্যে এখনো রপ্ত করতে পারেনি। তাই এই লেখা, সেইসব ছবি, দৃশ্য এবং চিত্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্যে, যেগুলো ২০১৬-কে ফ্ল্যাশব্যাকে ধরে রাখবে।

একটা বছরের চলে যাওয়া, শুধুই একটা নতুন বছরের, নতুন শুরুর আশা নিয়ে আসে তা-ই নয়, এর মধ্যে একটা স্বস্তিও থাকে, অনেকটা পথ ক্লান্ত হয়ে হেঁটে আসার। কোনো এক বছরের শেষে, কেউ কেউ হয়তো ক্ষতবিক্ষত হয়ে থাকে, কেউ কেউ আবার জীবনের সব থেকে মধুর সময়গুলো কাটিয়ে আসে। সব মিলিয়ে একেকটা বছর, জীবনের একেকটা পাতা ওল্টানো। পুরোনো পাতার সব অক্ষরগুলোই চেনা, কিছু অক্ষরের প্রতি খুব মায়া পড়ে যায়। মনে হয় সেই অক্ষর দিয়ে তৈরি লাইনগুলোকেই বারবার আওড়াই। কিন্তু নতুন পাতাও যে অপেক্ষা করে থাকে, নতুন সম্ভাবনা, নতুন সঙ্গীত, নতুন বাক্য নিয়ে। ছোট ছোট সেসব নতুন বাক্য দিয়েই তো জীবনের গদ্য কোনো এক ছন্দে মিশে যায়। এই লেখা পুরোনো পাতার ফেলে আসা কিছু বাক্যকে এক ঝলক দেখে নেওয়ার। যদি সেই ঝলকের মধ্যে, সেই দৃশ্যপটের ভিতর কোনো কবিতার ছন্দ লেখা হয়ে গিয়ে থাকে, তার কিছুটা হয়তো উদ্ধার হবে।

--প্রথম দৃশ্য-- 
চারিদিকটা খুব কম আলো। তবে অনেক মানুষ ঘোরাফেরা করছে, সবাইকে চিনিও না। কিন্তু আমারই সব থেকে বেশি চেনা উচিত ছিল সবাইকে। আর কিছুক্ষন বাদেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। হাতের ছোট্ট চিরকুটটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। সেই চিরকুটে আমার ভয় কাটানোর জরিবুটির কিছু ফর্মুলা লেখা আছে। এসি হলের ভিতরেও কপালের বিন্দু বিন্দু ফোঁটা জানান দিচ্ছে যে, স্টেজের সামনে দাঁড়াতে ধক লাগে। শেষ পর্যন্ত এলো, স্টেজের পাশ থেকে সামনে যাওয়ার আহ্বান। 

মাইক পেলাম হাতে। নাঃ, সামনের বিশাল দর্শকরা সবাই সংখ্যায় পরিণত। তাদের নিজেদের পরিচয় নেই আর। স্টেজের ওপর একটি আলো শুধু আমার ওপরই তাক করা। আমরা আলোয় থাকলে কিভাবে অন্ধকারের মানুষগুলো স্রেফ সংখ্যায় বা স্ট্যাটিস্টিক্সে পরিণত করি, তা বুঝছিলাম। যাই হোক, তখন মনে হলো, বিশ্ব-সংসার যেন বলতে চাইছে, তোমার নামের ভার তুমি কি বুঝতে পারছো, সোহম ? এই চরাচরের বিধাতা হওয়া, তার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া এতো সহজ নয়। বিশ্ব-সংসারের হিউমার আছে বলতে হয়। আমিও বোধ হয় সেই মহাবিশ্বের ডাককে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে শুরু করলাম আমার ছোট্ট বক্তব্য। 

৩ মিনিটের সে কথা, যেন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছিলো। হয়তো যখন সকলের সামনে আমরা একা হয়ে যাই, তখন অন্য গ্রহের হিসেবমতো সময় মেনে চলি। পরে ভিডিও দেখে বুঝেছিলাম, বেশ ভালোই উৎরেছিলো সেই ছোট্ট বক্তব্য। কেউ কেউ ছবিও তুলেছিল, এবং তাতে আরো আত্মবিশ্বাসী লাগছিলো দেখে। কিন্তু কোর্ট-প্যান্ট পরে প্রায় সকলকেই তা-ই লাগে। আমার মনে হয়, কোর্ট-প্যান্ট পোশাকটা তৈরিই করা হয়েছে এই উদ্দ্যেশ্যে - যাতে বড় হয়ে গেলেও, ছোটবেলায় আমরা স্কুলে যেমন পোশাকের নিরিখে এক হয়ে যেতাম, সেইরকম খানিকটা এক হয়ে যেতে পারি। কিন্তু কোর্টের ভিতরের বেগুনি রঙের জামাটা একটা আলাদা মাত্রা দিয়েছিল যেন, পছন্দটা যদিও অন্য এক পূর্ব-প্রিয় মানুষের ছিল...

--দ্বিতীয় দৃশ্য-- 
ফ্যানটা বেশ জোরে ঘুরছিলো। বসন্তের সকালের মৃদু বাতাস মুখে মেখে এসে, ওই সিলিং ফ্যানের কৃত্তিম হাওয়ার গায়ে এসে পড়াটা মেনে নিতে সামান্য অসুবিধে হচ্ছিলো। কিন্তু মনের ভিতরের উথালপাথালকে শান্ত করতে, ফ্যানের হাওয়ার কৃত্তিম আদরটাই সাহায্য করছিলো। কিছুক্ষন বসে বসে ঝড়ের প্রতীক্ষা করলাম। অবশেষে সামনে এলো, পর্দার পিছনের মানুষরা। শুরু হলো আমার সাথে তাদের এক অসম আলোচনা। 

অসফল সেই আলোচনার শেষে বিদায় নিলো অদৃশ্য পর্দায় আবৃত সেই ছায়ামানুষগুলো। পড়ে রইলাম, আমি, ফ্যানটা, আর আমার অস্বস্তি। তারা আর কতক্ষন দূরে থাকতে পারে ! আমার ডান-বুকে নেমে এলো অস্বস্তির বারিধারা। আমার মাথা তখন হিমশীতলের মতো ঠান্ডা। হয়তো সেই প্রথমবার মাথা বুঝতে পেরেছিলো, আজ মনের কোণে মরুভূমির তপ্ত বালি আছড়ে পড়ছে, তাই ভারসাম্য রাখতে তাকে ঠান্ডা থাকতে হবে। আমার বুকে নেমে আসা বারিধারা, আমার হৃদয়কে অদ্ভুতভাবে, বেশ উষ্ণ করে তুলেছিলো। কিছুক্ষন আমি যেন এক নিরাকার পাথরের মতো বসেছিলাম। আমার নিজের অস্তিত্বের মানে বুঝিনি। মনে হচ্ছিলো, হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে কিছু সযত্নে রাখা অস্থাবর। 

মনে পড়ে, এর পরে আমাকে খেতে বসতে বলা হয়েছিল। গলার কাছে দলা, আর মুখের কাছে ভাত - সেই প্রথম একসাথে খেয়েছিলাম। অবশেষে সন্ধ্যে নাগাদ, কোনো এক রাস্তার ধারে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। তখন দেখেছিলাম, নিচে রেললাইন, আর উপরে সেতু, সে সেতু মিশে যাচ্ছে আর একটা সেতুতে, সারি সারি গাড়ি এসে নামছে নিচের রাস্তায়, আবার সেতুতে উঠে যাচ্ছে। নিয়ন আলোয় বিরিয়ানির গন্ধ, মেশিনে ছেপে যাচ্ছে অজস্র টাকা, আর তারই পাশ দিয়ে, দু'টো পা হেঁটে যাচ্ছে। বুঝিনি কি করে সেই পা দু'টো আমাকে বয়ে নিয়ে চলছিল। সকালের সেই ফ্যানটা তখনও ঘুরছিলো কিনা জানিনা, তবে আমি চলছিলাম।

--তৃতীয় দৃশ্য-- 
আবার চারিদিকটা অন্ধকার, কিন্তু চারপাশে চেনা শুধু চারজন। সামনে ড্রাইভারদা আছেন। গাড়িটা জঙ্গলের নিস্তব্ধতার সঙ্গে কিছুটা ঝগড়া করেই এগিয়ে চলেছে। তবে তাতে গাড়ির গতিতে কোনো খাদ পড়েনি। আবহাওয়ার মাদকতা, যে কোনো পানীয়ের মাদকতাকে ম্লান করে দিতে পারে, সেটা বেশ বুঝতে পারছি। বর্ষাকালের পাহাড়ে গাড়ির জানালায় যে হাওয়াটা পাওয়া যায়, সেই হাওয়াটা আমার মুখে ঝাপ্টা দিয়ে যেন বলছে, স্নিগ্ধতার সংজ্ঞা এখান থেকেই অভিধানে লেখা হয়েছিল। আমিও ভেসে যাচ্ছি প্রকৃতি আর আমার চার বন্ধুর সাহচর্যের এক নিশ্চিন্ত সান্নিধ্যে। সেই দুরন্ত অমানিশায় আলো বলতে ছিলাম বোধ হয় আমরা ওই পাঁচজন।

এরপরে আমি হয়ে গেলাম অন্য চারজনের একজন। সেখানে একটা বড় ঘর, দুটো বিছানা। খুচরো নস্টালজিয়া, আর দু-একটা আফশোসকে আমরা কাঁচের গ্লাসে ঢালছি। পেটের ভিতরে গিয়ে সেগুলো এক মুখ থেকে অন্য মুখে ছড়িয়ে পড়ছে। সামনে রাখা টিভিটাও সেটা টের পেয়ে পুরোনো দিনের গান শোনাতে শুরু করলো। আমরা কিন্তু সেদিনই দিনের বেলা এক চূড়ায় উঠেছিলাম। তাই সেই রাতের গল্পের শেষও হয়েছিল, কোনো অন্য চূড়ায় আবার দেখা হওয়ার অঙ্গীকার করে। 

তারপরে আবার অন্য এক দলের অংশ হয়ে গেলাম। মেঘের আলয়ে আলো যে এতো কারবার করে, সেটা তার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিপত্তি না দেখলে, কোনোদিন বুঝতে পারতাম না। তবে অবাক হয়ে দেখলাম, কিভাবে মেঘ আর আলো - দুজনে একসাথে সংসার করে। সংসারে দুই বিপরীতের এক আশ্চর্য সহবাস। একটুকরো মেঘ আমি ধার করে এনেছি, আমার বস্টনের সূর্যকে দেব বলে। ওরা দুজনেও বন্ধু পাতাক, আমি জানালায় বসে ওদের প্রেম দেখবো। যে প্রেমের রং শুধু নীল নয়, লাল, মেরুন, আকাশি, হলুদ, তুঁতে, সবুজ দিয়ে ঘেরা। যেভাবে মন্দারমণীর মতো সমুদ্রপাড়ে, "পাহাড়তলী"-এর বাতাস বিভিন্ন রঙে ধোয়াঁশা হয়ে থাকে। আমরা সেই ধোঁয়া হয়ে আসা আশায় গানের সুর বসাই। আর সেই গান শুনে ওখানকার গাছগুলোও আনন্দে আত্মহারা হয়, যেন নতুন করে প্রাণ পায়। আমরাও তারপরে একরাশ প্রাণ নিয়ে কলকাতা ফিরে আসি। 

--চতুর্থ দৃশ্য--

বেশ দেরি করে সকালে উঠেছি। প্রায় ন'টা বেজে গেছে। রিসার্চের জীবনটা যদিও এরকমই। সময়টা যেন আমার নির্দেশ মেনে চলবে। যত বলি একটু নিজের নিয়ম, জগতের নিয়মের খেয়াল রাখতে, সে প্রকৃতই আমার দাস। মনিব হতে আমার ভালো না লাগলেও, *সময়ের* ওপর এই দাসত্ব ফলাতে মন্দ লাগে না। সেই পোষ মেনে যাওয়া মিষ্টি সময়, যখন বিছানার সাথে আপোষের আর কোনো সুযোগ দিচ্ছে না, তখন উঠতেই হয়। শেষ পর্যন্ত শবাসন শেষ করে, উঠে বসলাম। তখনই আমার মোবাইল জানান দিলো, পৃথিবীর কোনো প্রান্তে আমার প্রসঙ্গ উত্থাপন হয়েছে। একটি উড়োচিঠি আমার মোবাইলে তার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। এই চলমান অবিশ্রান্ত বার্তাগুলোই আমাদের স্থবিরতাকে আজকাল টুঁটি টিপে মেরে ফেলে। আমিও নিজের আরামদায়ক অবস্থান ছেড়ে হাতে তুলে নিলাম ছোট্ট পৃথিবীকে, খুললাম ইমেইলটি।

আমার দৈহিক শক্তির যদি একটি মাত্রা করা যায় ১ থেকে ১০০ অব্দি, তাহলে ঘুম থেকে ওঠার সময় সেই শক্তির মান ছিল ঋণাত্বকভাবে ২০ (-২০). যখন হাতের মুঠোতে ফোনটা ধরি ইমেইল দেখার জন্য, সেই শক্তির মাত্রা ছিল +১০. আর ইমেইলটার প্রথম দু'লাইন পড়ার পরে সেই মান গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় +১১৫. এবং বিছানা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, বিছানাতে ৩টে ঘুসি মারি সজোরে। ঠিক যেভাবে অরিন্দম "নায়ক" সিনেমাতে বলেছিল, "I will go to the top, the top, the top." ফেব্রুয়ারির সেই দু' তারিখে পেয়েছিলাম প্রথম PhD-র জন্য admission letter. top না হোক, একটা ভীষণ বড় relief. বুক থেকে একটা পাথর নেমে যাওয়া, মাথা থেকে একটা ভার সরে যাওয়া। তারই দৈহিক প্রকাশ ঘুসিগুলো। যদিও সেই University পরে join করিনি, কিন্তু ওই অনুভূতিটার কোনো বিকল্প হয় না। বছরের সেরা মুহূর্তও বোধ হয় ওইটেই।

Friday, December 16, 2016

শেষ দৃশ্য - The last scene

ফ্যানটা বেশ জোরে ঘুরছিলো। বসন্তের সকালের মৃদু বাতাস মুখে মেখে এসে, ওই সিলিং ফ্যানের কৃত্তিম হাওয়ার গায়ে এসে পড়াটা মেনে নিতে, সামান্য অসুবিধে হচ্ছিলো অমিতের। কিন্তু মনের ভিতরের উথালপাথালকে শান্ত করতে, ফ্যানের হাওয়ার কৃত্তিম আদরটাই সাহায্য করছিলো। কিছুক্ষন বসে বসে সে ঝড়ের প্রতীক্ষা করলো। অবশেষে সামনে এলো পর্দার পিছনের মানুষরা, মানে অমিতের প্রেমিকার মা আর বাবা। শুরু হলো অমিতের সাথে তাদের এক অসম আলোচনা।

অসফল সেই আলোচনার শেষে বিদায় নিলো অদৃশ্য পর্দায় আবৃত সেই ছায়ামানুষগুলো। ছায়ামানুষদের তো আসল আকৃতি বা গঠন হয় না। শুধু তাদের অবয়বটা বোঝা যায়। সেই অবয়বগুলোই ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে মিলিয়ে গেলো। পড়ে রইলো - অমিত, ফ্যানটা, আর অমিতের অস্বস্তি, মানে সুনয়না। তারা আর কতক্ষন দূরে থাকতে পারে! অমিতের ডান-বুকে নেমে এলো অস্বস্তির বারিধারা।

অমিত তার একটু আগেই সুনয়নাকে শেষবারের মতো জানতে চেয়েছিলো যে, সুনয়না শুধু তাকেই ভালোবাসে কিনা! উত্তরে সুনয়নার চোখের জলের মানে বুঝতে অমিত ভুল করেনি। অমিতের মাথা তখন হিমশীতলের মতো ঠান্ডা। হয়তো সেই প্রথমবার মাথা বুঝতে পেরেছিলো, আজ মনের কোণে মরুভূমির তপ্ত বালি আছড়ে পড়ছে, তাই ভারসাম্য রাখতে তাকে ঠান্ডা থাকতে হবে। অমিতের বুকে নেমে আসা সুনয়নার বরফের মতো ঠান্ডা চোখের জল, তার হৃদয়কে অদ্ভুতভাবে বেশ উষ্ণ করে তুলেছিলো। কিছুক্ষন সে যেন এক নিরাকার পাথরের মতো বসেছিল, হয়তো উষ্ণতার এই অবাঞ্ছিত তারতম্যের জেরেই। সে নিজের অস্তিত্বের মানে বোঝেনি। অমিতের মনে হচ্ছিলো, তার হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সযত্নে রাখা কিছু অস্থাবর। তবুও অমিত সুনয়নার চোখের জলকে তার বুকে নিবিড় স্থান দিয়েছিলো।

অমিতকে এর পরেও সুনয়নার মা খেতে বসতে বলেছিল। উনি তখনও জানতেন না, ওনারা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কি হয়েছে। উনি বা সুনয়নার বাবা কেউই জানতেন না - অমিতের হৃদয় সদ্য ভেঙে গিয়ে এক নদীর জন্ম হয়েছে, সুনয়নার চোখের জলেই যে নদী সম্পৃক্ত। গলার কাছে দলা, আর মুখের কাছে ভাত - সেই প্রথম অমিত একসাথে খেয়েছিল।

অবশেষে সন্ধ্যে নাগাদ, কোনো এক রাস্তার ধারে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল অমিত। তখন সে দেখেছিল - নিচে রেললাইন, আর উপরে সেতু, সে সেতু মিশে যাচ্ছে আর একটা সেতুতে, সারি সারি গাড়ি এসে নামছে নিচের রাস্তায়, আবার গাড়িগুলো সেতুতে উঠে যাচ্ছে। নিয়ন আলোয় বিরিয়ানির গন্ধ, মেশিনে ছেপে যাচ্ছে অজস্র টাকা, আর তারই পাশ দিয়ে দু'টো পা হেঁটে যাচ্ছে। অমিত বোঝেনি কি করে সেই পা দু'টো ওকে বয়ে নিয়ে চলছিল। সকালের সেই ফ্যানটা তখনও ঘুরছিলো কিনা জানা নেই, তবে অমিত চলছিল।

Thursday, December 15, 2016

খুচরো দর্শন - Scrambled Philosophy

দ্বন্দ্ব আমার নিজের কাছে বাড়তি হয়ে যায়,
চলতি রেখার কোন্ প্রান্তে - খুঁজতে শুধু চায়।
কখনও সে খুব দুরূহ, লোকের চোখে উঁচু,
কখনও বা সবের মাঝে, স্পষ্ট সব কিছু।
দু-একটা দিন চলে যায়, মেঘের নিচে চাপা,
"যেমন করে গাইছে আকাশ", রিড ধ'রে সা-পা।
রবি ঠাকুর বুর্জোয়া নয়, গান কিছু হয় মিথ্যে,
বাস্তব আর কল্পনারা - ঘুরপাক খায় বৃত্তে।
বাদলবাবুর ইন্দ্রজিৎ - আমিই কেন হলাম !
স্যার বলতেন, সুখ হবে না, আমার পায়ের গোলাম।
ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখা - সবার দ্বারা হয় না,
কিছু মানুষের বুদ্ধি কিন্তু সময় দিয়ে কেনা।
কিছু লেখা হাততালি পায়, বুড়ো আঙুল ছাড়,
মুখোশ-মোড়া ছবির নিচে, সেই আঙুলের ভার।
বাতিল টাকা পুড়তে পারে, বণিক রাজা হয়,
সাদা-কালো মুছে-দেওয়া মন, প্রেমের জন্য নয়।

Thursday, December 08, 2016

অন্য সনেট - A Different Sonnet

Boston, 8-Dec-2016, 6:05 PM

একাকী জানালার পারে, তুমি কি আজ নীরবে দাঁড়িয়েছিলে?
জানালার পারে নীরবে একাকী, তুমি কি আজ দাঁড়িয়েছিলে?
নীরবে জানালার পারে আজ, তুমি কি একাকী দাঁড়িয়েছিলে?
আজ তুমি একাকী দাঁড়িয়েছিলে জানালার পারে, নীরবে কি?
নীরবে একাকী তুমি কি আজ, জানালার পারে দাঁড়িয়েছিলে?
নীরবে জানালার পারে আজ একাকী দাঁড়িয়েছিলে, তুমিই কি?


[অনুপম রায়ের এক কবিতা, এবং তারও আগে এক ইংরেজি কবিতার প্যাটার্ন থেকে এই আঙ্গিকটি অনুপ্রাণিত। ]

Wednesday, December 07, 2016

Dear Zindagi - Movie Opinion

#DearZindagi এতো আদর করে কখনো জীবনকে ডেকেছেন কেউ? বোধ হয় এভাবে সরাসরি ডাকেননি, কিন্তু অন্য অনেক ভাবেই এই আদর আগেও ফুটে উঠেছে। যেমন শিলাজিত যখন "ও জীবন রে" গেয়ে ওঠেন, তিনি তো পরম মমতা দিয়েই জীবনকে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধার আহ্বান করেন (মমতা কথাটার মমত্ব কিন্তু এখনো ফুরিয়ে যায়নি)। তবে যাই হোক সিনেমায় ফেরা যাক।

নাসিরুদ্দিন শাহ একটা ইন্টারভিউতে বলছিলেন, সিনেমাকে দুভাবে দেখা যায়: এক, খুব সহনীয়ভাবে। মানে খুব একটা ক্রিটিক্যাল না হয়ে, সমালোচনা না করে। দুই, বিপরীতটা, মানে সিনেমাটার শৈল্পিক দিকগুলো বোঝার চেষ্টা করে। দুটোরই ভালো-খারাপ আছে। তবে প্রথম পথটা যদি কেউ অবলম্বন করে, তাহলে মুশকিলটা হচ্ছে, একটা সিনেমায় যে underlying emotion-টা আছে, সেটা অনেকসময় সে মিস করে যাবে। বরং যদি সে একটু ক্রিটিক্যাল হয়ে দেখতো সিনেমাটা, হয়তো আর একটু বেশি appreciate করতে পারতো।

তাই আমরা যদি সকলে একটু সন্দিহান মন নিয়ে সিনেমা দেখি, তাহলে সেটা আমাদের নিজেদেরই ভালোলাগাকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করবে। যারা সেই ভালোলাগা বাড়াতে চান না, তাদের কিছু বলার নেই। আমি এই ব্যাপারটা বোঝার পর থেকে, এই ভালোলাগাটা পাওয়ার চেষ্টা করি, তাই আজকাল একটু ক্রিটিক্যাল দর্শক হিসেবে সিনেমা দেখার চেষ্টা করছি। নোলান inception-এ actually কি বলতে চাইছে, না বুঝতেই পারি, কিন্তু কেন কোনো সিনে একটা চরিত্রের পিছনে transparent কাঁচের background ব্যবহার করছে, সেটা বোঝা গেলে কিন্তু এক অদ্ভুত ভালো লাগা চেপে বসে। তার আলাদা এক ধরণের নেশা আছে। তবে Dear Zindagi নিয়ে যা বলবো, তা সিনেমা দেখে শুধুই আমার মনের ভিতর কি ধরণের অনুভূতি নাড়াচাড়া দিয়েছে তা-ই বলবো। এটা কোনো রিভিউ বলে ভুল করবেন না। এই জন্য মাঝেসাঝেই সিনেমা থেকে বেরিয়ে অন্য বিষয়েও ঢুকে পড়বো।

শাহরুখ খানের শেষ যে সিনেমাটা হলে দেখেছিলাম, সেটা বোধ হয়, চেন্নাই এক্সপ্রেস। তখন লিখেছিলাম, "হালকা মনে দেখলাম, ভাল লাগলো।" তবে তার এক-দুদিন আগে শিপ অফ থিসিয়াস দেখে ফেলায়, চেন্নাই এক্সপ্রেসের পর নিজেকে খুব দুর্ভাগ্যের শিকার মনে হয়েছিল। কিন্তু আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে শাহরুখের যারপরনাই ফ্যানদের সংখ্যা প্রচুর, তাই তাদের জ্বালাতন সহ্য করতেই হয়। তবে এবার Dear Zindagi দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্য গৌরী শিন্দে এবং ছবিটার ট্রেলার। খুব একটা হতাশ হয়েছি বলা যায় না, তবে খুব একটা সন্তুষ্টও হতে পারিনি।

আজকাল আমরা মনের রোগ নিয়ে অনেক কথাবার্তা বলে থাকি। তবে সমাজে, একটা নাক-সিঁটকোনো ভাব থেকেই গেছে এ ব্যাপারে। দীপিকা পাড়ুকোন এ নিয়ে মাঝে একটু শোরগোল ফেলায়, এই গোঁড়ামি থেকে সামান্য মুক্তি এসেছে ভারতে, তবে অনেকটা পথ চলা বাকি। এই সিনেমার বেশিরভাগটাই আলিয়া ভটের "মনের রোগ" সারানোর কাহিনী নিয়ে, যেখানে শাহরুখ খান মনের রোগ সারানোর ডাক্তার, নাম জাহাঙ্গীর খান। আমি কয়েকবার এরকম মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেছি, কখনো নিজের সূত্রে, কখনো আত্মীয়ের জন্য। কোথাও জাহাঙ্গীরের ঘরের মতো সাজানো গোছানো চেম্বার দেখিনি। কিন্তু আমরা মধ্যবিত্ত মানুষেরা যে ধরণের ডাক্তারের কাছে যাই, সে ধরণের ডাক্তার জাহাঙ্গীর না-ই হতে পারেন। আলিয়া ভটের মতো সিনেমায় সিনেমাটোগ্রাফারের ভূমিকায় অভিনয় করা মানুষেরা একটু উচ্চবিত্ত ডাক্তারের কাছেই যাবেন, সেটা নিয়ে তাই বেশি সন্দিহান হলাম না। সহনীয় থাকা গেলো।

কিন্তু এরকম কোনো মনোবিদ আছেন কিনা জানিনা, যিনি রোগীদের সমুদ্রের ধারে বেড়াতে নিয়ে যান, বা সাইকেল চড়াতে নিয়ে বেরোন। কিন্তু পদ্ধতিটা খারাপও নয়। তাছাড়াও, আরো একটু সহিষ্ণু হওয়া যাক, কারণ ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে বেশি intolerant হওয়া উচিত নয়। তাও আবার শাহরুখ খানের মতো কেউ যখন সিনেমায় অভিনয় করেছেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর কত উচ্চমানের মনোবিদ সেটা বোঝা যায়, এটা দেখে যে, আলিয়া ভট যখন শাহরুখের প্রেমে পড়ছেন বলে আমরা দর্শকরাও বুঝতে পারছি, সেখানে শাহরুখ সামনে থেকেও এবং মন নিয়ে কারবার করেও বুঝতে পারছেন না। আর শুধু তা-ই নয়, তিনি আলিয়া ভট-এর রোগ সারানো এমন সময়ে বন্ধ করে দিলেন, যখন আলিয়ার শাহরুখের প্রতি আসক্তি তৈরী হয়েছে। তিনি সেই অধরা, স্বপ্নিল নায়ক হয়ে থেকে যাওয়ার লোভ কি করে সামলাতে পারেন ! আমার শুধু জানতে উচ্ছে করে, গৌরী শিন্দে নিজে এই প্লট সম্পর্কে কতটা স্বচ্ছন্দ্য ছিলেন।

কিন্তু এসব কিছুই আমি খরচের খাতায় ফেলে ignore করলাম। এবার সিনেমাটার একটু দর্শনের দিকটা নিয়ে ভাবা যাক। কারণ সিনেমাতে এদিকটা ছোঁয়ার একটা চেষ্টা আছে। আলিয়া নিজে অনেক প্রেমের সম্পর্ক করেছেন এবং বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে তার অসুবিধে হচ্ছে বলেই তার জাহাঙ্গীর খানের মতো মনের ডাক্তারের কাছে আসা। এখানে বলে রাখা ভালো, মনোবিদরা প্রেম ভাঙার এই সমস্যাটি নিয়ে খুব পরিচিত। তারা জানেন যৌবনে এই ধরণের সমস্যা অনেকেরই আসতে পারে, অনেক রোগীই আসেন। তাদের কাছে মেথডিক্যাল উপায়ও থাকে, সেই রোগ সরিয়ে তোলার।

এসব জানা সত্ত্বেও জাহাঙ্গীর মেথডকে বুড়ো আঙ্গুল দেখালেন। সেটা বোধ হয়, আলিয়ার মতো কেউ রোগী হওয়ার জন্যই। আলিয়ার রাতে ঘুম না হওয়ার *কারণ* সম্পর্কে, জাহাঙ্গীর খান প্রায় কিছুই বলেন না, অনুসন্ধান করার তেমন চেষ্টাও করলেন না। তিনি তাকে জীবন সম্পর্কে overall অনেক কিছু উপদেশ দেন। খুব অদ্ভুতভাবে নিজের জীবনের কিছু অংশ, কিছু insecurity আলিয়ার সামনে প্রকাশ করেন। আমি সত্যিই জানিনা, আজ পর্যন্ত কজন মনোবিদ এরকম করেছেন, এবং তা আদৌ করা উচিত কিনা। একজন ডাক্তার তার রোগী সম্পর্কে নির্লিপ্ত না হয়ে যদি তাঁর নিজের insecurity share করতে আরম্ভ করেন, তাহলে কি তিনি effectively অন্য মানুষটাকে সাহায্য করতে পারেন? এছাড়া, একজন মনোবিদের কাজ, একজন শিক্ষকের মতো শুধু সমস্যা-সমাধানের রাস্তাটাই বলে দেওয়া নয় কি? নাকি যে শিক্ষকরা সমাধানটা পরিষ্কার বলে দেন, তারাই ভালো? জানিনা - এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয় এখানে, দিলামও না !

প্রেম ভাঙার পরই, ডক্টর খান নতুন সম্পর্ক করার ক্ষেত্রেও আলিয়াকে বাধা দেন না, খুব অদ্ভুতভাবে হলেও। কারণ সাধারণত মনোবিদরা বলে থাকেন একটা passionate সম্পর্ক থেকে বেরোনোর পরে, মানুষের নিজের সাথে একটু সময় নেওয়া উচিত, অন্য কোনো সম্পর্কে যাওয়ার আগে। হঠাৎ করে নতুন সম্পর্কে চলে যাওয়াটাকে রিবাউন্ড রিলেশনশিপ বলে। যে শব্দটা সিনেমাতে কিছুক্ষনের জন্য ব্যবহার করা হলেও, তা নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য করা হয় না। সেটা বোধ হয় আলি জাফরকে যাতে দেখানো যেতে পারে, তাই জন্য। ওরকম cute একজন ছেলে, এতো সুন্দর গান গায়, তাকে গৌরী শিন্দে বলে কেন, আমি হলেও সিনেমায় cast করতাম-ই। আচ্ছা আলী জাফর পাকিস্তানী না? এটা নিয়ে, ভারতবর্ষে আজ আর কারো প্রবলেম নেই বোধ হয়, তাই না? যদিও ভারতীয় ভাষায় এসব বিব্রত করার মতো প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। তার থেকে প্রশ্ন করি, বাগো মে বাহার হ্যায়?

আলিয়া ভট সিনেমাতেও একজন আকর্ষণীয় মেয়ে, তাই গৌরী শিন্দে আলিয়ার একটা প্রেম শেষ হওয়ার পরে, তাঁকে *একা* দেখাতে চাননি। তাই তিনি প্রেম ভাঙার পরে নতুন প্রেমের সন্ধানে চেয়ার খোঁজার মতো বেরিয়ে পড়েছেন। যদি *একটা* ছেলেকে পাওয়া চায়, যার সাথে প্রেম করা যায়, মানে নতুন চেয়ারে যদি বসা যায় (pun unintended). আমার খুব কৌতূহল হয় একটা *ছেলের* প্রেম ভাঙার পরে, সে যদি এরকমই *চেয়ারের* মতো মেয়ে খুঁজতে বেরোতো, তখন কি আমরা নারীজাতিকে চেয়ারের সাথে তুলনা করে objectify করার জন্য, শোরগোল তুলতাম?

আমরা যারা সাধারণ ঘরের মধ্যবিত্ত, সেসব মানুষেদেরও এরকম একটা আকাঙ্খা থাকে - প্রেম ভাঙার পরেই নতুন আর একটা প্রেম হবে বেশ, শুধু প্রেমের পরে প্রেম আর প্রেম, আবার প্রেম। কিন্তু সেটা বোধ হয় মনের স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যতের সম্পর্কের স্বাস্থ্যের জন্যও খুব একটা ভালো ওষুধ নয়। রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে যেটা করে গেছেন, সেটা খুব ভালো করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, আমাদের কি করা উচিত। এই যে প্রেম ভাঙার পরের অনুভূতিটা, এটা কিন্তু একটা খুব মৌলিক অনুভূতি। সকলের জীবনে খুব আলাদা করে, আলাদা ভাবে আসে। অথচ বাইরের লোকের দৃষ্টিতে এই অনুভূতিটা খুব একঘেয়ে - মানে যাদের প্রেম ভাঙে, তাদের সবারই যেন একই রকম অনুভূতি হয়, বলে অন্য মানুষেরা মনে করে। কিন্তু আদপেই তা নয়, সবার নিজের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে অনুভূতিটাও বদলে যায়। কেউ বরফের মতো শীতল, কেউ আবার মরুভূমির বালির মতো উত্তপ্ত - তাদের পূর্ব সম্পর্কের প্রতি। এই অনুভূতিটাকেই আমরা বিভিন্ন দিকে চালিত করতে পারি। কারণ প্রেম চলে যাওয়ার পরে যে অন্ধকার তৈরী হয়, তার জেরেই তো আলোকে সঠিকভাবে চেনার শুরু। তবে শুধু প্রেম কেন, যে কোনো ধরণের ভাঙ্গনের পরের অন্ধকার থেকেই আমাদের আলোর দিকে যাত্রা শুরু হয়। অন্ধকার ঠিক কি, সেটা না জানলে, কি আমরা গেয়ে উঠতে পারতাম, "আরো আলো, আরো আলো, এই নয়নে, প্রভু, ঢালো" !

ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, এই অন্ধকারের সময়টাতেই, মানুষ বোধ হয় সবথেকে productive হয়ে ওঠে। প্রাথমিক একটা কান্না থাকে, প্রচন্ড দুঃখ থাকে, গলায় দলা পাকিয়ে আসা থাকে, পৃথিবীর এতো রূপ-রস সবকিছুকে অস্বীকার করার একটা প্রবল হতাশাজনক ইচ্ছে থাকে, হঠাৎ হঠাৎ পুরোনো কথা, মুখ মনে পড়ে যাওয়া থাকে, নিজেকে খুব ছোট ভাবা থাকে। কিন্তু সেটা আত্মস্থ করে নেওয়ার পরেই আসল খেলা শুরু করে, সেই দুঃখের অনুভূতিগুলো। কেউ হয়তো দুনিয়ার বিভিন্ন প্রদেশের গান শুনতে আরম্ভ করলো। কেউ হয়তো দুঃখের গান শোনা শুরু করলো, বাঙালি হলে তো ফসিলস-এর প্রাক্তনের উদ্দ্যেশ্যে গানের ছড়াছড়ি, রবীন্দ্রনাথও কম যান না। কেউ আবার লেখালেখি শুরু করলো, কত বাঙালির *সিরিয়াস* কবিতা লেখার শুরু তো সেখানেই। আবার কেউ কেউ হয়তো শুধু গদ্যও লিখতে আরম্ভ করেন। দুনিয়ার দিকে একটু ভালো করে তাকাবার, আরো সময় পায় কেউ কেউ। প্রকৃতিকে আপন করে নিতে কেউ গেয়ে ওঠে, "আজ যেমন করে গাইছে আকাশ।" আমরা সবাই *নিজের* দিকে আরো ভালো করে দৃষ্টি দিই। একা হয়ে গেলে, আমাদের জগৎটাও তো মূলত নিজেদেরকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। তখন আমাদের নিজেদেরকে বোঝার শুরু হয়। নিজেদের ভালো লাগা, খারাপ লাগা, চাহিদা, পছন্দ - এগুলো যেন একটা অন্য মানুষের চোখ দিয়ে দেখতে আরম্ভ করি। আবার সেই অন্য মানুষটাও যেহেতু আমরা নিজেরাই, তাই সেই দৃষ্টিতে কোনো অহেতুক ফাঁক থাকে না, মিথ্যে থাকে না, শুধু স্ফটিকের মতো স্বচ্ছতা থাকে।

এই নিজেকে উন্নত করার প্রক্রিয়াটার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পরেই, আমার মনে হয়, মানুষ নিজেকে নিজের মতো করে খুঁজে পায়। আর তখনই সে কাছাকাছি আসে, তার আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে এমন মানুষটার, যাকে অনেকে soulmate বলেন। যে মানুষটা তাকে challenge করতে পারবে, এই উন্নত হওয়ার প্রক্রিয়াটা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। রবীন্দ্রনাথ হয়তো এটাকেই বলেছেন, "আরো প্রেমে, আরো প্রেমে, মোর আমি ডুবে যাক নেমে।" এর কারণ মানুষ যতদিন নিজেকে না বুঝছে, সে বুঝবেই বা কি করে, যে অন্য মানুষের থেকে তার কি কি চাহিদা হতে পারে ! আমরা সাধারণত আমাদের সমস্ত চাহিদাগুলো, *একজন* মানুষের ওপরই আরোপিত করে দিই। কোনো ভালোবাসার সম্পর্কের ক্ষেত্রে, সেটা বোধ হয় খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়। তাই নিজেকে চেনার সেই কঠিন সময়ের পরেই, আমরা হয়তো তৈরী হতে পারি, আমাদের জীবনে নতুন এবং সঠিক মানুষের জন্য। জাহাঙ্গীর এই কথাটাও খানিকটা বলেছেন সিনেমায়, কিন্তু এসব ব্যাপার নিয়ে তিনি বেশি বলতে চাননি।

ছবিতে জাহাঙ্গীরের জীবনের এই দর্শনগুলো নিয়ে বক্তব্য খুব একটা ছিল না। উনি আলিয়ার সাথে মজা করেছেন, সময় কাটিয়েছেন, কিন্তু আলিয়াকে নিজের মধ্যে সংগঠিত হওয়ার জন্য তেমন সাহায্য করেননি। শুধু নিজের পরিবারের সাথে সম্পর্ক মিটিয়ে নেওয়ায় সাহায্য করেছেন, যেটাও খুব দরকারি, কিন্তু একমাত্র দরকারি নয়। আমার মনে হয়, এই কারণেই সিনেমাটিতে জীবনের দর্শন নিয়ে অনেক কিছু বলার সুযোগ থাকলেও, তা শুধুমাত্র কিছু ডায়লগে গিয়েই শেষ হয়ে যায়। আমার একটু অন্য আশা ছিল সিনেমাটা থেকে। কিন্তু বলিউডের ছবিগুলোর থেকে, এর বেশি কিছু আশা করা উচিত কিনা, সেটা আমার নিজেরই ভাবা উচিত ছিল।

সিনেমার কিছু টেকনিক্যাল দিক নিয়েও বলতে হচ্ছে। শাহরুখ এবং আলিয়ার বেশিরভাগ দৃশ্যগুলো shot-reverse-shot-এ shoot করা (মানে একবার আলিয়ার উপর ফোকাস, একবার শাহরুখের ওপর). এখানে আমার একটু সমস্যা হয়েছে। আমার পার্সোনালি মনে হয়, আমরা যদি দুজনকে একই ফ্রেমে আরো দেখতে পেতাম, কিংবা shot-reverse-shot-এই যদি একটু বৈচিত্র্য থাকতো, তাহলে ওনাদের তখনকার অবস্থার সাথে রিলেট করতে সুবিধে হতো। কিন্তু তার জন্য বেশ confident actor দরকার হয়, সেটা আলিয়া কতখানি সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। তাছাড়াও এধরণের shooting style-এ খুব ভালো script-ও দরকার হয়। যেমন ধরুন, Good Will Hunting-এ ম্যাট ডেমন আর রবিন উইলিয়ামস-এর কথোপকথন-গুলো। একবারের জন্যও একঘেয়ে লাগে না, অথচ সেই shot-reverse-shot. ওখানে ক্যামেরা কিন্তু অনেকসময় angle বা focus চেঞ্জ করছে। তবে এই মতামতটা একান্তই আমার, আমি সিনেমাটাকে visualise করলে কি রকম করতাম, তা বলা। তাই এই যুক্তি তেমন খাটে না। কারণ পরিচালক তাঁর দৃষ্টি নিয়েই সিনেমা বানাবেন। আমি শুধু বলতে পারি এটুকুই, আমার সামান্য অসুবিধে হয়েছে দেখতে।

আলিয়ার অভিনয় বেশিরভাগ সময়েই ভীষণ মেকী লেগেছে, ওনাকে অভিনয়টা করতে হয়েছে বোঝা যাচ্ছে, অভিনেতাদের বুঝতে দেওয়া উচিত নয়। যেমন ধরুন, যখন আলিয়া প্রথমবার তার সমস্যা বলছেন শাহরুখকে, বোঝা যাচ্ছে কিভাবে ওনার অস্বস্তি হওয়ার অভিনয় *করতে* হচ্ছে। এখানে মনে হচ্ছিলো আলিয়ার কানে জোরে জোরে বলে আসি, "ক্যামেরার সামনে অতি অভিনয় চলে না, একটু বাড়িয়েছো, দশ গুন্ বেড়ে যাবে।" শাহরুখের চরিত্রটাই আবার এমন হালকা চালে বোনা হয়েছে, যে ওনার নতুন করে তেমন করার কিছু ছিল না। শুধু কিছু ডায়লগ ওনার জন্য লেখা হয়েছিল। তবুও মনে থেকে যাবে ওই দৃশ্যটা, যেখানে আলিয়ার কান্নার পরেও শাহরুখ খুব নিশ্চল একটি প্রতিক্রিয়া দিলেন, একজন মনোবিদের যা দেওয়া উচিত।

গান নিয়ে বলার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু গানকে একটু অন্য ভাবে দেখার চেষ্টা করছি আজকাল। বোঝার চেষ্টা করছি, কেন আমাদের অনেকেরই, একই সাথে, শ্যামল মিত্র, কোহেন, কোল্ডপ্লে, পিঙ্ক ফ্লয়েড আর অমিত ত্রিবেদী ভালো লাগে। এটা কি কোনো chord-এর খেলা, নাকি মনের মধ্যে কোনো বিশেষ ধরণের সুরের বসে যাওয়ার খেলা? এর মধ্যেও কি কোনো pattern আছে? যাই হোক, তবে অমিত ত্রিবেদী এবারেও বেশ ভালো। অনেকটা লেখা হলো, এবার থামা খুব জরুরি। এই সিনেমা থেকে এটাই প্রাপ্তি যে, শাহরুখ মনে হয় অনেকদিন পর নিজের জন্য কোনো সিনেমা করলেন। এটা বেশ ভালো লেগেছে। কিন্তু ওনার নতুন সিনেমার ট্রেলার দেখে, সন্দেহ লাগছে, ঠিক কতদিন সেই ট্রেন্ড বজায় রাখবেন..