ভালো-মন্দ মিশিয়ে ২০২২ শেষ হল। প্রযুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে, এবছর যেমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রে বহু উল্লেখযোগ্য ভালো ঘটনা ঘটেছে, তেমনি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলিতে ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাইও আমরা দেখেছি। সারা বিশ্বে প্রায় ১.৫ লক্ষ লোক Tech Sector-এ চাকরি হারিয়েছেন এই বছর। এর মধ্যে প্রচুর startup দেউলিয়া হয়েছে বা বন্ধ হয়ে গেছে। এই ধরণের ব্যাপক হারে ছাঁটাই-এর পিছনের কাহিনী নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার, তাহলে প্রযুক্তির ব্যবসা ও তার কার্যপ্রক্রিয়াটা একটু হলেও পরিষ্কার হবে।
সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু করতে গেলে, COVID-19 Pandemic- কে সময়ের axis-এ রাখতেই হবে। তাই এক্ষেত্রেও ঘটনার সূত্রপাত সেই ২০২০-এর মার্চ মাসে। সেই সময় আমরা যে শুধু দীর্ঘদিনের জন্য ঘরবন্দী হয়ে পড়লাম তাই-ই নয়, প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরতাও এক ধাক্কায় বেশ অনেকটা বেড়ে গেল। তার আগেই যদিও জীবনের প্রায় সবক'টা দিকেই সফ্টওয়্যারের প্রবেশ ঘটে গেছে। বড় শিল্পে বিদ্যুৎ যেমন অপরিহার্য, বিভিন্ন কাজের জায়গাতেও সফ্টওয়্যারের ভূমিকা ঠিক তেমনই হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কোভিডের প্রকোপের ফলে, সফ্টওয়্যারের ব্যবহার কয়েক গুন্ বেড়ে গেল। এমনকি যে কাজগুলি সফ্টওয়্যার দিয়ে করা খানিকটা কষ্টকর অথবা কিছুটা অস্বাচ্ছন্দ্যের ছিল, সেগুলিও আমরা সফ্টওয়্যার দিয়ে করতেই বাধ্য হলাম। অনলাইন মিটিং, বাড়িতে বসে অফিসের কাজ, দীর্ঘক্ষণের ভিডিও কল, এমনকি জিনিসপত্র চোখের সামনে পরখ না করেই অ্যাপের মাধ্যমে অর্ডার করা - এসব কিছুই আগের থেকে অনেক বেশি মানুষ দৈনন্দিনভাবে করতে শুরু করলো। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি এতো দ্রুত সফ্টওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি কি করে এতো বিপুল পরিমান কাজের চাপ মেটাতে পারলো? সেই বিষয় নিয়ে সবার প্রথমে ভাবা যাক।
আমরা জানি যে, কোনো গাড়ি কারখানায় একদিনে কতগুলো গাড়ি তৈরী হবে, তার একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা এবং পরিমাপ থাকে। কোনো জরুরী অবস্থা তৈরী হলে, সেই সংখ্যা কিছুটা বাড়ানো যেতে পারে ঠিকই, কিন্তু রাতারাতি তাকে কয়েক গুন্ বাড়িয়ে ফেলা কষ্টকর। তেমনি যে কোনো সফ্টওয়্যারেরই সুষ্ঠুভাবে কাজ করার একটা সীমা থাকে। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার হবে। Zoom নামটার সঙ্গে আমরা এখন সকলেই পরিচিত। সেই Zoom অ্যাপ্লিকেশনটি প্রতি মিনিটে একটি সীমিত সংখ্যক ভিডিও কল একসাথে চালিয়ে যেতে পারে। ধরা যাক, সেটা ২০ লক্ষ। এবার যদি দিনের কোনো এক সময়ে প্রতি মিনিটে ২০ লক্ষের বেশি Zoom ভিডিও কলের চেষ্টা করা হয়, তাহলে Zoom-এর সার্ভারে সমস্যা হতে পারে, এমনকি সেই সার্ভার বন্ধও হয়ে যেতে পারে।
কোভিড-এর সময়ে বেশিরভাগ সফ্টওয়্যার কোম্পানিকেই অচকিতে আসা বিপুল কাজের চাপ সামলাতে হয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে তারা সফ্টওয়্যার উন্নত করেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই নতুন ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করে সফ্টওয়্যার আপগ্রেডও করেছেন। এবং এই কাজটা করতে হয়েছে খুব দ্রুত, যাতে আমাদের কোনো সমস্যা না হয়। কোভিডের সময় আমরা কিছু কিছু সফ্টওয়্যার নিয়ে সমস্যায় ভুগেছি ঠিকই, কিন্তু মোটের উপর আমাদের অসুবিধা হয়নি। অথচ ভাববার বিষয় এই যে, সফ্টওয়্যার কোম্পানিগুলি নতুন পরিকাঠামো তৈরির জন্য নতুন ইঞ্জিনিয়ার বা রিসার্চার নিয়োগ করার মূলধন পেলো কোথা থেকে, বা শুধুমাত্র পরিকাঠামো উন্নতি করার জন্যও যে মূলধন দরকার হয়, তার সংস্থানই বা হলো কোথা থেকে? এটা বুঝতে গেলে সফ্টওয়্যারের ব্যবসার দিকটা একটু বোঝা দরকার।
আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা, বেশিরভাগ সফ্টওয়্যার কোম্পানি কিন্তু কোনোরকম লাভের মুখ না দেখেই এগিয়ে চলে বছরের পর বছর। বরং অধিকাংশই বিপুল পরিমান ব্যবসায়িক ক্ষতি বহন করে, যাকে আমরা বলি loss-এ run করা। যেমন ধরুন, উবার (Uber)। আমরা সকলেই এদের কথা জানি, ব্যবহারও করি হরবখত, প্রত্যেকদিন। কিন্তু গত ১৩ বছর ধরে ব্যবসা চালানোর পরেও, এখনো অব্দি তারা মাত্র ১ বছরই (২০১৮) কোনো প্রফিট বা মুনাফা করতে পেরেছে। অন্যান্য বছরে তারা Billions of dollars শুধু loss করেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে এসব কোম্পানিগুলো টিকে আছে কি করে?
এরা মূলতঃ টিকে আছে ঋণ বা ডেট (debt) নিয়ে এবং এই আশায় যে ভবিষ্যতে হয়তো কখনো তারা লাভজনক হবে। এই ধরণের কোম্পানিদের কিছু আয় থাকে ঠিকই, কিন্তু এদের খরচের পরিমান এতটাই বেশি, যে ঋণ ছাড়া এদের পক্ষে চলা অসম্ভব। কিন্তু ঋণ তো কিছু নতুন নয় - আধুনিক অর্থনীতি দাঁড়িয়েই আছে ঋণের উপর - তবে অসুবিধাটা অন্য জায়গায়। সাধারণত ঋণ বা ধার নিলে, তা সুদসমেত ফেরত দেওয়ার ব্যাপার থাকে। তবে সফ্টওয়্যার-জামানায় ব্যাপারটা বেশ অন্যরকম।
সফ্টওয়্যার-সম্পর্কিত কোম্পানিগুলি বিশ্বের প্রথমসারির এবং সবথেকে বড় কোম্পানিগুলির তালিকায় ঢুকতে শুরু করে মূলতঃ ২০১০ এর পর থেকে। তার আগে Microsoft, Intel, IBM জাতীয় কিছু প্রযুক্তি কোম্পানি থাকলেও, সফ্টওয়্যার দিয়ে বড় স্কেলে ব্যবসা শুরু হয়নি। অথচ সেই ২০১০-এর আগেই সারা বিশ্বে ঘটে গেছে ২০০৮-এর Global Financial Crisis (বা Great Recession), যা আমেরিকা-সহ সমস্ত উন্নত দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ধসিয়ে দিয়েছিলো। এতো বড় মন্দা গত ৭৫ বছরে সারা বিশ্ব দেখেনি। এই ঘটনার ফলে বিশ্বের GDP এতটাই ধাক্কা খেয়েছিল, যে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমান ব্যাপক হারে কমে যায়। Economic activity নূন্যতম স্তরে চলে যায়। যার জন্য পৃথিবীর সবক'টা উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি তাদের সুদের হার (interest rate) শূন্য (০%) শতাংশ বা তার কাছাকাছি করে দিয়েছিল। যাতে সকলে অন্তত টাকা ধার করে ব্যবসাবৃত্তি করতে পারে এবং দেশে দেশে টাকার লেনদেন বাড়ে।
সেই সময়ই, সফ্টওয়্যারও বিশাল আকার ধারণ করতে শুরু করে, কারণ প্রযুক্তি ততদিনে তৈরী ছিল। আর যেহেতু সুদের হার ছিল শূন্য শতাংশ, তাই ঋণ নেওয়ার জন্য অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেওয়ার কোনো ব্যাপার ছিল না। সফ্টওয়্যার ব্যবসা একেই মূলধন করে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায় বা scale করে। এছাড়া সফ্টওয়্যার ব্যবসার এক বিশেষ সুবিধা হল, সেটা একবার তৈরী হয়ে গেলে খুব দ্রুত অনেক জায়গায় বিপুল সংখ্যক ক্রেতার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। এবং কিছু ক্ষেত্রে তাই-ই হলো। আমেরিকার সবথেকে বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে তেল, ব্যাঙ্ক, বীমা - এসব সেক্টরকে পিছনে ফেলে প্রথমে চলে এলো Apple, Google, Microsoft, Amazon, Facebook-এর মতো নতুন কিছু নাম।
২০২০-এর কোভিড লকডাউনের সময়, এসব প্রযুক্তি কোম্পানির ব্যবসা স্বাভাবিকভাবেই আরো বেড়ে গেলো। মুশকিল শুরু হল দুই বছর বাদে, ২০২২-এ। ইউক্রেনে যুদ্ধ, কোভিডজনিত supply chain-এর সমস্যা এবং চিনের লকডাউনের জন্য দ্রব্যমূল্য বাড়তে শুরু করলো। এছাড়াও গত দু'বছর ঘরবন্দি থাকায়, মানুষের খরচ করার সুযোগ ছিল কম। ফলে ২০২২-এ মানুষ বেশি হারে তাদের জমানো মূলধন খরচ করছিল। এই ধরণের বিবিধ কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ জায়গাতেই শুরু হল মুদ্রাস্ফীতি (inflation)। দ্রব্যমূল্য যখন প্রায় ৮-৯ শতাংশ হারে বাড়তে শুরু করলো, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো বাধ্য হল, সুদের হার শূন্য থেকে বাড়িয়ে তুলতে। বেশ অনেক বছর বাদে এই প্রথম বার সুদের হার অনেকটা বেশি বাড়তে শুরু করলো। এবং এখন ২০২২-এর ডিসেম্বরে সেই হার প্রায় ৪.৫%।
সফ্টওয়্যার কোম্পানিগুলি তাদের জন্মলগ্ন থেকে কখনোই এইরকম বেশি সুদের হারের সময়ে ব্যবসা করেনি। তারা শুধুই ভেবেছে কি করে নতুন ব্যবহারকারীদের (user) কাছে পৌঁছনো যায়, তা সে ব্যবসায় লাভ হোক বা না হোক। তারা ভেবেছে বিশাল সংখ্যক কাস্টমারের ভিত্তি তৈরী করতে পারলে, কোনো না কোনোদিন লাভ ঠিক হবে। সেই জন্য তারা বিশাল আকার ধারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের ধারণা নেই, এই রকম অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলাতে কিভাবে হয়, কি রকম পরিকল্পনা করতে হয়। উপরন্তু কোভিডের জন্য অতিরিক্ত কাজ সামাল দিতে, তারা অনেক অনেক বেশি কর্মী নিয়োগ ও পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ করেছে, যা এ লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে। এই সমস্ত কারণে, তাদের বেশিরভাগের পক্ষেই এই অতিরিক্ত খরচ চালিয়ে যাওয়া এই সময়ে আর সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে তাদের খরচ কমানোর প্রথম পদক্ষেপই হল কর্মী ছাঁটাই।
Tech কোম্পানিগুলোর এই দিশেহারা দশার জন্য প্রথমে ভুগতে হচ্ছে সেই কর্মীদেরই। কারণ এই কোম্পানিগুলোর পাওয়ার স্ট্রাকচার সামান্য আলাদা হলেও, ম্যানেজমেন্ট স্ট্রাকচার মোটামুটি অন্য সেক্টরের কোম্পানিগুলোর মতোই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। কিন্তু এখানে এ কথা উল্লেখযোগ্য যে, এর মধ্যে অনেক কোম্পানিই কর্মীদের পিঙ্ক স্লিপ দেখানোর সময়, তাদের প্রায় ৩ থেকে ৬ মাসের স্যালারি এবং অন্যান্য আরো কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পথ বাতলেছে - এটা একটুখানি সিলভার লাইনিং। ২০২৩ হয়তো দেখাবে, সফ্টওয়্যার ব্যবসা কিভাবে বিবর্তিত হয় এই অনবরত বদলে চলা প্রযুক্তির দুনিয়ায়।