Monday, April 20, 2020

শিল্পকলা নিয়ে নোটস - ৪ | Notes on Arts - 4

শিল্পের উৎস নিয়ে ভাবনার কথা হয়েছিল। সেই উৎস বা অনুপ্রেরণায়, শিল্পকে প্রাথমিকভাবে মানুষের অনুভূতির প্রকাশ হিসেবেই দেখা যায়। এই ফর্মে শিল্প বাস্তবতা, সমাজ, সময় কোনোকিছুকেই তোয়াক্কা না করতে পারে। অথচ এই সমাজ ও সময়েই তো শিল্পের অবস্থান, তাই তাদের প্রভাব শিল্পের ওপর পড়েই। এবং বিপরীতে সমাজ ও সময়কে শিল্পের পরোক্ষে কিছু ফিরিয়ে দেওয়া থাকে, কিছুটা প্রভাবিত করা থাকে। এই ধরনের এক দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে দিয়ে শিল্প, সমাজ ও সময়ের একটা সিম্বায়োটিক সম্পর্ক তৈরি হয়।

খুব ইন্টারেস্টিংলি, সমাজের ঐতিহাসিক যাত্রা যখন প্রগতির দিকে, শিল্পের একটা বড় অংশ সমাজ এবং সময়ের অন্ধকার দিকগুলোর ওপর ফোকাস করে। এটা হয়তো causation, correlation নয়। হয়তো সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশগুলোর বেদনাদায়ক বিবরণী আমাদের সেই খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে বেশি করে অবহিত করে রাখতে চায়। আমাদের মনে সচেতনতা, সতর্কতা যোগায়, সাবধানবাণী দিয়ে যায়। শিল্প যেন প্রানবন্তভাবে বুঝিয়ে দিতে চায় সমাজের সেই দুরুহ অবস্থার তীব্রতা ঠিক কতটা। যাতে সমাজ সেই অন্ধকার সময়গুলোতে ফিরে না গিয়ে উজ্জ্বলতার দিকে যাত্রা করে, প্রগতিশীল হয়।

কিন্তু দুঃখ দুর্দশা তো আমাদের মনে হতাশা, সংশয়, ভয় ডেকে এনে। এরকম কঠিন সময়ে, শিল্প কি বিলাসিতা নয়! এখানে মূলত দুটো যুক্তি পাচ্ছি। প্রথমত, শিল্পীর অর্থনৈতিক অবস্থান বা শ্রেণী। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দুর্দশার প্রাথমিক আঁচ থেকে শিল্পীরা একটা দূরত্বে থেকে শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ করে তাঁদের শিল্পরচনা করে থাকেন। এখানে আমরা সত্যজিৎ থেকে সলিল চৌধুরী, অনেককেই পাবো, যারা প্রধানত মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষ। দ্বিতীয়ত, শিল্পীর দুরবস্থাই কখনো কখনো শিল্প হয়ে কথা বলে। সেখানে দুর্দশাটার সরাসরি প্রকাশ হয় শিল্পে। এবং অনেক সময় তা শিল্পের সাধারণ পরিশীলন, আঙ্গিককে ভেঙে দেয়। যেমন আমরা ঋত্বিক ঘটকের ভারতভাগ নিয়ে সিনেমাগুলোতে ধারাবাহিক ভাবে দেখি।

এই দুটো যুক্তি ছাড়াও একটি তৃতীয় বক্তব্য রাখা যায়। যে কোন কঠিন সময়েরই একটা প্রাথমিক অভিঘাত থাকে। অযাচিত বা অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার দরুন, মানুষের বিচলিত হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। যেমন কাছের কোন মানুষের মৃত্যু বা এমনকি এই অকস্মাৎ করোনাভাইরাস নামক মহামারী নেমে আসা। ঘটনার প্রাথমিক চমক কেটে যাওয়ার পরই হয়ত আমরা মানসিকভাবে এমন এক জায়গায় আসতে পারি, যেখানে নতুন শিল্প তৈরী হতে পারে।
(চলবে)

Sunday, April 05, 2020

আমাদের আসা-যাওয়ার-মাঝে

এক প্রবল ঝড় এসে সব ওলোটপালোট করে দেওয়ার পরে, চারিদিক ভীষণ শান্ত হয়ে উঠছিল, যেমনটা হয়ে থাকে। কিন্তু মনের ভিতরে তখনও ছিল উথালপাথাল করে দেওয়া শূন্যতা। পৃথিবীটাকে চিনতেই যেন খুব অসুবিধে হচ্ছিল। হয়তো তার সাথে নিজের ভিতরের খানিকটাও হারিয়ে গিয়েছিলো।

গল্পটা এরকম চলতে পারতো, এবং ধীরে ধীরে এই অচেনা পরিচয়ই হয়তো আপন হয়ে উঠতো। কিন্তু গল্প আর জীবন তো এক নয়, তা আমরা জানি। কিন্তু যেটা আমরা অনেকসময় ভুলে যাই - জীবন গল্পের থেকেও বেশি আদরের। সে যেমন সজোরে ধাক্কা দেয়, তেমনি সর্বাত্মক ভালোবাসায় সেই জীবনেরই প্রেমে পড়তে শেখায়।

তাই জীবন তৈরী করলো নতুন আখ্যান - ঝড়ের শেষে যে গুমোট আবহাওয়া ছিল, সেই মেঘ কেটে গেল, সূর্য ঝলমল করে উঠলো, গাছের পাতায় দেখা গেল অকাল সবুজ, প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে পাখিরা তাদের বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো ভীষণ কলরবে, সব ক্লীবতা দূর হয়ে গেল, আর শুরু হল নতুন চর্যা। সেই চর্যায় না থাকলো কোনো চাপানো বাঁধন, না কোনো আড়াল, না কোনো মলিনতা, না কোনো অন্ধকার। 

অথচ বন্ধন তো তৈরী হল, যে বন্ধন পশমের আদর লাগিয়ে নিজেকে হারিয়ে যেতে দেয় না। যে বন্ধন কোন নিয়মের বিধিনিষেধ না মেনেই ভীষণ জোরালো হয়। যে বন্ধন দূরত্বকে অবজ্ঞা করে অনায়াস পারদর্শিতায়। সেই বন্ধন অচিরেই এনে দেয় আরাম, অভ্যাস, দৈনন্দিন রুটিন। কিন্তু সেই প্রাত্যহিকতা এতটাই সহজাত, যে তা একেবারেই উহ্য। তার অনুভব আছে, উচ্চারণ নেই।

সেই অনুভবে, এক প্রান্তের সকালের রোদে অন্য প্রান্তের বিকেলের পাখিদের ঘরে ফেরার ডাক শোনা যায়। তারপর কিছুটা সময়কে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে আদানপ্রদান করে নেওয়া, অন্তরঙ্গতা। একটু বাদে দৈনন্দিন কাজের ব্যস্ততায় ডুব দেওয়া। তবু "মাঝদুপুরে হঠাৎ সেদিন আচমকা সব পড়লো মনে", এবং সেই বিষাদকে নদীর ধারে হাঁটতে গিয়ে জলের সাথে ভাগ করে নেওয়া। এরপরে কাজ শেষে, আবারো কিছু সময়ের ভাব, কিছু ভাবনার প্রকাশ। এই আসা যাওয়ার মাঝে যে সময়টুকু পড়ে থাকে, সেখানেই তৈরী হয়ে গেল কত রঙিন স্বপ্ন। মেঘের গায়ে নকশা আঁকা হল কত কল্পনার। জলের বুকে খেলে গেল কত তরঙ্গ, ভরসার দেওয়াল পেল হৃদয়ের প্রত্যেক নিলয়-অলিন্দ, সব জটিল সমীকরণ সমাধান খুঁজে পেল। বোধ হয় এরই অপেক্ষা ছিল চিরটাকাল, বহুযুগ, শুধু সমাপতন হয়নি সময়ের। কিন্তু ভাবনা, চিন্তা ও সর্বোপরি হৃদয়ের সমাপতনের কাছে সময়ের হার তো ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই অপেক্ষার শেষেই শুরু নতুন সময়ের, নতুন পথচলার।