Tuesday, December 25, 2018

জৈবিক নোটস

প্রত্যেকদিন, প্রতি মুহুর্তে একইভাবে দেখে চলেছি পৃথিবীটাকে। মোটামুটি ছ'ফুট উপর থেকে যেভাবে দেখা যায়। একরকম ভাবে দেখতে দেখতে দুটো আলাদা দিনের মধ্যে তফাৎ কমতে থাকে ধীরে ধীরে। কিন্তু যদি কয়েক হাজার ফুট উপরে চলে যাওয়া যায়, তাহলে আর একেকটা দিনকে সূক্ষভাবে আলাদা করার দরকার পড়ে না। তখন বিমূর্তভাবে আরো বড় সময়ের স্কেলে ঘটনাপ্রবাহকে দেখা যায়। সেই সময়ের স্কেলে, অন্ততপক্ষে একটা বৈচিত্র্য ফুটে ওঠে - কিন্তু সেই বৈচিত্র্য-এর উদ্দেশ্য কি - তা ঠিক বুঝতে পারিনা। 

একটা ফুটপাথ দিয়ে বাড়ি ফিরছি, চারপাশে অল্প কিছু ছাত্রছাত্রীরাও হাঁটছে। আমি ক্লান্ত কিন্তু পরিতৃপ্ত সারাদিনের কাজের পরে। তাহলে কি এটাই সব? এরই জন্য এতো আয়োজন? এরই জন্য সকাল ৬টায় তাড়াতাড়ি মুখ-ধোওয়া? তারপর জলদি সাইকেল করে সাড়ে ছ'টার মধ্যে গেস্টকিন বাজারে ফিজিক্স পড়তে ঢোকা? এরই জন্য সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার ফাঁকা হলদিয়া লোকালের জন্য বাগনানে অপেক্ষা করা? চেঙ্গাইলে দিলখুশ ওঠার জন্য আশা করা? এরই জন্য নন্দন, নিউটাউনে হলুদ আলোয় স্নান? এই হেঁটে ফেরার জন্যই এতো কিছু নাকি, এই হেঁটে ফেরার আগে অতো কিছু? কয়েকহাজার ফুট উপর থেকে জীবনের স্কেলে বৈচিত্র্য দেখতে পেলেও উদ্দেশ্য পাচ্ছি না - কেন হচ্ছে এসব! এই সবগুলোই তো নাহলে চলতো।

আমি এখন লেখাটা না লিখলে, আমি জয়েন্ট না দিলে, আমি চাকরি না করলে - বেশ চলতো। কিন্তু তারপরেও এসব হল, আমি আমার এখনকার "আমি" হলাম। আমি আছি, আমি থাকছি, আমি থাকবো। বুঝতে পারছি এর পরে কি হবে, বন্ধুরা দেখিয়ে দিচ্ছে - বিয়ে হচ্ছে, একটা সংসার হচ্ছে, তাতে বাদলবাবুর "মানবী"-ও হয়তো থাকছে, পরবর্তী প্রজন্ম হচ্ছে। একটা ফর্মুলায় খেলা চলছে, আমি সেই ফর্মুলা মেনে খেলছি। "এক-দুই-তিন।" চাকরি করা, চাকরি ছাড়া, পড়াশোনা, ঘুরেবেড়ানো! ফর্মুলা-ভাঙার যে ফর্মুলা সেটাকেও প্রয়োগ করতে ছাড়ছি না। "দুই-এক-তিন"। কোথাও গিয়ে বেশ রঙীন লাগছে পৃথিবীটাকে, কি বিচিত্র এই পার্থিব জীবন ! কিন্তু বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে হঠাৎ আবার ঢুকে পড়ছি সেই একঘেয়েমি কল্পচিত্রে। কারণ সবটাই তো সেই ফর্মুলার বৃত্তে আবর্তিত। আর এই একঘেয়েমিই আমার অতীত পেরিয়ে বাস্তব ছুঁয়ে আবার অতীত হবে। কিন্তু ঠিক সকলের আর পাঁচটা অতীতের মতোই তার পরিচিতি। তার মধ্যে বিশেষ কোনো স্বকীয়তা নেই, নিজস্বতা নেই, আছে সময়ের প্রতিফলন, সমসাময়িক সমাজের এক চলচ্ছবি। আমি একটা সমাজ, আমার জীবন একটা সমাজ, আমার ছ'ফুটের দৃষ্টিভঙ্গি একটা সমাজ, মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, আর আমি সেই সমাজে আবদ্ধ জীবাশ্ম!

Saturday, October 06, 2018

বাংলা ভাষা বিষয়ক (~৫ মিনিট) | About Bengali Language

কলকাতা - প্রাক্তন ব্রিটিশ রাজধানী। এই শহরের একটা বিশেষ চরিত্র যদি হয় এর নস্টালজিয়া, মিষ্টত্ব - এসব কোমলতায় মোড়া বিশেষণগুলি - তাহলে অন্য চরিত্রটি এর অন্তর্দ্বন্দ্ব। যে কোনো আধুনিকতাতে দ্বন্দ্বের অবতারণা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক, আধুনিক শিল্পের একটা বড় মূলধন এই টানাপোড়েনটাই; আর ব্রিটিশ রাজধানী হওয়ার আগে থেকেই, মূলত সম্পদের বৈভবের কারণে কলকাতায় আধুনিকতার পরশ লেগেছিলো। ব্রিটিশরা এসে ঘাঁটি গেঁড়ে বসার পর সেই আধুনিকতা অন্য মাত্রা পায়। ব্রিটিশদের মাতৃভাষার প্রতি বাঙালীদের সেই তখন থেকেই ঈর্ষা। ব্রিটিশদের সম্পদের প্রাচুর্য এবং শাসক-চরিত্র সেই ইংরিজি ভাষা-প্রীতিকে আরো জোরদার করে। আবার বাংলা ভাষার প্রতিও বাঙালীর স্বাভাবিক টান, ফলত জন্ম হয় এক চিরকালীন দ্বন্দ্বের।

কলকাতায় বরাবরই ইংরেজি বলিয়ে লোকেদের বেশি মান্যগন্য করা হয়ে আসছে। স্বাধীনতার আগে ভারতের প্রদেশগুলোতে যখন নির্বাচনে-জেতা নেতারা বিধানসভায় বক্তব্য রাখতেন, তখন বাংলার বেশিরভাগ প্রতিনিধি ইংরেজিতে বক্তব্য পেশ করতেন। এতে করে তাঁদের একটা সম্মানীয় স্থান পেতে সুবিধে হত, অন্যেরা তাঁদের মন্তব্যকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন। এই ইংরিজি কতৃত্বকে কিছুটা আটকে রেখেছিল - ঢাকা-কেন্দ্রিক বাংলা। যার জন্য যখন ১৯৩৭-এর নির্বাচনে ইংরেজদের বিভাজনের সুযোগে অনেক সাধারণ, খেটে-খাওয়া মুসলমান বাংলার নির্বাচনে জিতলেন, তখন তাঁরা বাংলায় বক্তব্য পেশ করতে শুরু করলেন বিধানসভায়। সেই সময় যে গুটিকতক হিন্দু বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরা সেই বাংলায়-রাখা বক্তব্যে কিছুটা প্রভাবিত হয়ে বাংলা বলার চেষ্টা করেন, নিজেদের চিরাচরিত ইংরিজি ছেড়ে। সুতরাং বাংলা নিয়ে নাক সিঁটকানো ভাবটা বেশ পুরোনো, এবং এর উৎসটা কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু সম্প্রদায় থেকে আসা। এনাদের বেশিরভাগই তখনকার জমিদার, ব্যবসায়ী এবং উচ্চবর্ণ ছিলেন। এই ইংরিজি ভালোবাসার সুফল স্বরূপ প্রথম নন-ইউরোপীয়ান নোবেলটাও কলকাতাবাসী এক সাহিত্যিকের ঝুলিতে আসে। তবে সে যুগে ইংরিজি ভালোবাসার সাথে বাংলাকে অবহেলা ব্যাপারটা পুরোপুরি সমার্থক হয়ে ওঠেনি।

আধুনিক ইতিহাসেও কলকাতাকেন্দ্রিক এই উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা ইংরিজির পদলেহন করা বন্ধ করেননি। সেখানেও লুকিয়ে আছে কলকাতার চিরস্থায়ী অন্তর্দ্বন্দ্ব। সেই প্রসঙ্গে ঢোকার আগে বলতে হবে, ২০১৭ সালে একটি বিতর্কে চন্দ্রিল ভট্টাচার্য্যের বক্তব্যের কথা, যা কিনা সম্প্রতি নতুন করে প্রচার পেয়েছে (এবং এই লেখাটার একটা অনুঘটক)। উনি সেখানে বাংলা ভাষার দুরবস্থা প্রসঙ্গে বলছেন যে, "উচ্চকোটির বাঙালী" বাংলা ভাষাকে বর্জন করার জন্যই আজকে বাংলা ভাষার এই করুন পরিস্থিতি। লোকে বাংলা বলতে ভুলে যাচ্ছেন, বাংলায় ভাবতে বন্ধ করছেন। দরকার হলে ভিডিওটা দেখে নেওয়া যেতে পারে, তবে ছোট করে বললে মূল বক্তব্য এটাই। কিন্তু আধুনিক ইতিহাসে বাংলাকে পিছনে ফেলে দেওয়ার ন্যারেটিভটি তৈরী করেছিলেন কারা? - সেই অনুসন্ধানেই দ্বন্দ্ব ধরা পড়ে। 

বামফ্রন্ট সরকার মাঝখানে কিছু বছরের জন্য সরকারি স্কুলে প্রাথমিকে ইংরিজি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ গ্রামাঞ্চলে অনেক প্রথম জেনারেশনের শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসছিল না, সঠিক ইংরিজি শিক্ষকেরও অভাব ছিল। কিছু বছর পরেই যদিও আবার ইংরিজি চালু করা হয়, সারা ভারতের আগেই। কিন্তু সেই সময় ইংরিজি তুলে দেওয়া নিয়ে তীব্র বিক্ষোভ হয়। এই বিক্ষোভের মূল বক্তব্য ছিল, ইংরিজি না শিখলে উচ্চপদে চাকরি, উচ্চশিক্ষা সম্ভব নয়। এই বিক্ষোভ যে গোষ্ঠীগুলো থেকে উঠে আসে - চন্দ্রিলবাবু তার প্রায় প্রত্যেকটারই অন্তগর্ত - কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চবর্ণ (মূলত ব্রাহ্মণ), "বাবু"-সম্প্রদায়, প্রতিষ্ঠিত ধনী মানুষেরা এবং আনন্দবাজার গোষ্ঠী। অথচ পরবর্তীকালে দেখা গেছে যে ইংরিজি তুলে নেওয়ার কোনো প্রভাবই প্রায় পড়েনি। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসা থেকে যাওয়ার মাঝে পশ্চিমবঙ্গে সাক্ষরতার হারে প্রায় ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। দেশের বড় বড় IIT-গুলিতে বাঙালী প্রফেসরের আধিক্য দেখা গেছে। কিন্তু সেই ন্যারেটিভটা থেকে গেছে - ইংরিজি ছাড়া উচ্চশিক্ষিত বা সম্ভ্রান্ত হওয়া যায় না। খুব কম সংখ্যকই বলেছেন, উচ্চপদের পরীক্ষাগুলোতে বা উচ্চশিক্ষায় আরো মাতৃভাষার ব্যবহার প্রয়োজন। 

চন্দ্রিল নিজে হুতোমের গুণগ্রাহী এবং হুতোমের লেখনীর ঘরানার লেখক। হুতোম নিজে কলকাতার বাবু-সম্প্রদায়ের অন্তগর্ত হয়েও সেই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বগুলিকে তাঁর লেখা নকশায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। চন্দ্রিল সেই একই কাজ করে থাকেন, আধুনিক মধ্যবিত্ত বাঙালীর ক্ষেত্রে। কিন্তু তাঁর নিজের তর্কের মধ্যেও এই দ্বন্দ্বের পরিসর আছে। তবে যেটা প্রথমে বলেছিলাম, এই দ্বন্দ্ব চন্দ্রিলবাবুর শুধু নয়, কলকাতাকেন্দ্রিক সমাজের একটা অঙ্গাঙ্গী সত্তা হল এই দ্বন্দ্ব। যে কারণে এখনও বলা হয়ে থাকে, ইংরিজি-শিক্ষা শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অথচ ভারতের প্রায় কোনো প্রদেশ থেকেই এই ধরণের বক্তব্যকে আগে তুলে আনা হয়নি। আগে অনেক রাজ্যেই ইংরিজি তুলে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কেউ অভিযোগ করে থাকেনা, যেভাবে বাঙালী করে থাকে। না ভুল বললাম, এমনকি গ্রামবাংলাও এই অভিযোগ করে না। শুধুমাত্র কলকাতাকেন্দ্রিক এলিট সমাজের এই অভিযোগ থেকে যায়। বিভিন্ন ইউরোপীয়ান দেশগুলি, জাপান - এরা সকলেই নিজেদের মাতৃভাষাকে উদযাপন করেন, ব্যতিক্রম কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালী ভদ্রসমাজ। 

যতদিন না কলকাতা তাঁর এই দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারবে, ততদিন কলকাতার উপর বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ না ছাড়াই ভালো। বাংলা বরং অনেক বেশি নির্ভরশীল কলকাতার বাইরে তার কতটা সমাদর তার ওপর। কারণ বাংলাকে কলকাতা কোনোদিনই তাঁর সঠিক মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেনি, আর অদূর ভবিষ্যতেও করবে বলে আশা করিনা। কলকাতার বাংলার অনিবার্য পরিণতি, "I तो বিরিয়ানি খেতে ভীষণ love করি।"

Friday, September 21, 2018

মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা প্রলম্বিত জেটল্যাগ চলছে - Sometime it feels like a long jetlag

মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা প্রলম্বিত জেটল্যাগ চলছে। গভীর রাত্রে অনেকসময় যখন ঘুম ভেঙে যায়, তখন মনে হয়, কেন ঘুমোবো ! আমার তো এখন জেগে থাকবারই সময়। আমার নিজের যারা - বন্ধু, শত্রু, আত্মীয়, ইত্যাদি - তারা তো সকলেই এখন জেগে, দিনের ব্যস্ততম সময়ে তারা ব্যস্ততায় বন্দী। তাহলে আমি কেন এই নিকষ কালো মুক্তদশার কবলে থাকবো ! এইরকম প্রশ্নই সমস্ত ঘরজুড়ে ঘুরপাক খেয়ে প্রতিফলিত হওয়ার পরে সত্যের সন্ধানী হওয়ার ইচ্ছে হয়। সেই সত্যের খোঁজেই বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমকে আপন করে নেওয়া - গান, লেখা, কবিতা। এসব কিছুতেই সেই সত্যকে তুলে ধরার এক যারপরনাই চেষ্টা। কিন্তু সেই সত্যানুসন্ধান আসলে একটা ঢাল। প্রকৃতপক্ষে এসব শিল্প যে সৃষ্টি করছি, এগুলো পুরো ট্র্যাশ, বোগাস, গার্বেজ। স্রেফ কোনো মূল্য নেই এগুলোর। এগুলো শিল্প বলে ভাবার নূন্যতম স্তরেও পৌঁছনোর যোগ্য নয়। তাই জন্যই সত্যানুসন্ধানের একটা ভেক ধরতে বাধ্য হতে হয়, নাহলে তো সৃষ্টির কোনো সার্থকতা থাকেনা। তবে এই সত্য-মিথ্যার আড়ালেই অন্য যে উদ্দ্যেশ্য অজান্তে সাধন হয়, সেটাই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা -আত্মানুসন্ধান। আত্মায় বিশ্বাস নেই, কিন্তু তাকে সন্ধানে যথেষ্ট বিশ্বাস আছে। নিজের অন্তরটাকে খুঁড়ে বের করার মধ্যে এক পাশবিক আনন্দ যেমন আছে, তেমনি মহাজাগতিক এক তৃপ্তি আছে - হয়তো বা পাশবিক আনন্দটাতেই তৃপ্তি। তবে নিজের ভিতরে সম্পূর্ণ প্রবেশ করার মানে, গভীরে লোকানো আশঙ্কাগুলো - যা কিনা দৈনন্দিন নাওয়া-খাওয়ায় চাপা পড়ে ছিল - সেগুলোকে এক অন্ধকার ঘর থেকে সর্বসমক্ষে আলোয় নিয়ে ফেলা। মৃত্যুচিন্তা তার মধ্যে প্রথম সারির। অধিকাংশ অন্তরখননেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। সামান্য ভাবনার বারুদেও, এই চিন্তার ফুলকি বিধ্বংসী আগুনের ধ্বংসলীলা চালায়, মনের অলিতে-গলিতে, মস্তিকের পাড়ায় পাড়ায়। স্রেফ রাস্তায় হাঁটতে থাকা থেকে ল্যাম্পপোস্ট, ট্রাফিক লাইট, স্ট্যান্ডার্ড, আমেরিকা, ভারত, ইতিহাস, সমাজতন্ত্র, স্বাধীনতা, পৃথিবী, প্রক্সিমা সেন্ট্যুরি, মহাজগত, বিগব্যাং, ব্ল্যাক হোল এবং... আমি। আসলে তো আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব নেই এই ভাবনাটারও। মৃত্যুর যদিও অস্তিত্ব আছে, আমাদের একমাত্র নিশ্চয়তা। সেটারই স্থায়িত্ব নির্ধারিত। আর একটা প্রচণ্ড চিৎকার, এবং শুধুই তার থেকে যাওয়া আছে, তারও অস্তিত্ব আছে। গান, লেখা - এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই, লেখার কোনো মূল্যও নেই। কারণ লেখা অনেক সহজ, বাঁচা অনেক কঠিন।
মাঝে মধ্যে মনে হয়, একটা প্রলম্বিত জেটল্যাগের মধ্যে রয়েছি, গত চার বছর ধরে।

Sunday, September 16, 2018

মন তরে কেবা পার করে

ভীষণ গোলাপী মতন হয়ে আকাশের গায়ে সন্ধ্যের ছায়া পড়তে শুরু করেছে। বোম্বে রোড ধরে চলে এসে কিছুক্ষনের ভিতরেই কলকাতাকে পেরোনো হয়ে গেছে। সেখানকার মেকী মনুষ্যত্ব, নাক-উঁচু স্বভাব গা থেকে ঝরে গেছে। মাটির কাছাকাছি, খুব খুব কাছাকাছি যাওয়া হচ্ছে। আকাশ গোলাপী রঙে সেজে উঠে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। যে নদীকে একটু আগেই অচেনা মহিলা লেগেছিল, এখন সে যেন কত চেনা পুরনো বান্ধবী। এইভাবে শ্রান্ত সন্ধ্যের মাঝে ওর সাথে বসে থাকতে থাকতে, হয়তো এই পুরনো বান্ধবীর প্রেমে পড়বো। এরই তো প্রেমে পড়া যায়। কি হবে আর বন্ধুত্বের দূরত্ব রেখে! ওই তো, একটা নৌকো দেখা যাচ্ছে। ওতে করে বেরিয়ে পড়ছি দুজনে মিলে। এরই মধ্যে,  ভাটিয়ালি গান শুরু হয়েছে। মাঝিভাই এক প্রান্তে বসে গানের ভেলায় দাঁড় বাইছেন। আমি আর নদী একদিকে শুয়ে আছি, পাশাপাশি। অকূল দরিয়ার গান শুনতে শুনতে উপরে দেখছি, কিভাবে তারারা একের পর এক কালো হতে থাকা আকাশের প্রান্তরে অবিন্যস্ত ভাবে দাঁড়াচ্ছে। এরই মাঝে আমার সদ্য হওয়া প্রেমিকা নদী গেয়ে উঠছে, "মাঝি তোর নাম জানিনা, আমি ডাক দিমু কারে, মন তরে কেবা পার করে"। এত বেদনা, কিন্তু তার মধ্যেও জীবনতরী বেয়ে চলার কি ভীষণ আর্তি! নদীর কণ্ঠ্যে যে কি আছে! দেহে শিহরণ হচ্ছে, কিন্তু চোখে জল, ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নদীকে জিজ্ঞাসা করতে গেলাম, "মেঘে ঢাকা তারাতে এই গানটা..."। নদী গান থামাল না, সদর্থক মাথা নাড়লো। আকাশ থেকে দূরে পাড়ের দিকে চোখ নেমে এলো, ছোট্ট ঘুপচির ভিতর টিমটিমে হলদে বাল্ব গুলো জ্বলে উঠছে, একের পর এক। কেউ হয়তো তুলসিতলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ দিচ্ছে, আজান শেষে কেউ ঘরে ফিরছে। শাঁখ বাজলেও শব্দ এসে পৌঁছায় না নদীর মাঝখানে।

আচ্ছা নদী, ওপারে যাওয়া যায় না? - আমার কৌতুহল। নদী বলছে, "আমি তো যাই। আমার তো তোমাদের মতন বাঁধন নেই। আমি স্বাধীন।" - নদীর মুখে মৃদু হাসির স্রোত খেলে গেল। কিন্তু সেই স্রোতই আমার মনের ভিতর কি ভীষণ রকম মোচড় দিচ্ছে। এতগুলো মানুষকে একটা পেনের আঁচড়ে ঘর ছাড়া করে দেওয়া হল, আলাদা করে ভেঙে দেওয়া হল। চাইলেও আর যাওয়া যাবে না, শুধু হয়তো কিছু ঘুপচির ক্ষীণ, শান্ত, নিরস্ত্র আলো দেখা যাবে, এপার থেকে। তবু যেতে আমাকে হবেই; তাই উপায় বের করে নদীর দেহে ডুব দিচ্ছি আমি, নদীর সাথে মিশে যেতে। তখন তো আর কোনো বাধা থাকবে না। নদী তো আমার প্রেমিকা, আমাকে নিশ্চই ফিরিয়ে দেবে না। দিচ্ছেও না, ডুবে যাচ্ছি আমি। মুক্তি হচ্ছে আমার, দেশীয় বাধা, বন্ধন, পার্থিব শৃঙ্খল থেকে মুক্তি, কি ভীষণ আনন্দ, কি দারুন পরিতৃপ্তি! কি মিঠা জল, কি শীতল, কি স্নিগ্ধ! আমি বুঝতে পারছি, আমার মৃত্যু হচ্ছে, আরো গভীরে চলে যাচ্ছি নদীর, কিন্তু কোন কষ্ট হচ্ছে না। সমস্ত দুঃখ আমাকে, এই প্রথম বোধ হয়, ছেড়ে চলে যাচ্ছে। গলার কাছে বিশালাকৃতির দলাটা নেমে যাচ্ছে। কিন্তু নিশ্বাস নিতে পারছি না যে! দমটাই শুধু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জৈবিক বাস্তবতা আঁকড়ে ধরছে আমায়। কেউ আমাকে একটু অক্সিজেন দিন না, দাদা একটু অক্সিজেন? - আমি ভিক্ষা চাইছি। কিন্তু কেউ যে নেই নদীতে, সকলে কোনো না কোনো পাড়ে ঠাঁই নিয়েছে, কাউকে পাচ্ছি না। দাদা একটু কেউ সাহায্য করুন না, প্লিজ। দাদা আমি যে বাঁচতে চেয়েছিলাম, দাদা আ আ আ আ আ.... 

উঠে বসলাম, হাঁপাচ্ছি, ভীষণ ভয় করছে, চারিদিক অন্ধকার, শুধু বিছানার একটা কোণে রিডিং ল্যাম্পের আলোটা তাক করা আছে। চারিদিক অন্ধকারের ভিতরে, বিছানায় রাখা বুকমার্ক করা বইটার ওপর ল্যাম্পের আলোটা পড়ে, বইটার নামটা যেন একটু বেশি জ্বলজ্বল করছে, "পূর্ব-পশ্চিম" - আমাদের অবশিষ্ট আইডেন্টিটি।

Wednesday, September 05, 2018

তোমার আছে, তোমার নেই

Boston, 05-Sep-2018, 11:00 PM

তোমাদের সব আছে,
গাড়ি আছে, বাড়ি আছে,
নতুন কেনা ফ্ল্যাট আছে।
আলমারিতে সোনা-দানা,
সেবার পুজোর জহর খানা,
যত্ন করে রাখা আছে।
বছরে দুবার বিদেশ আছে,
ঘরের কাছেও ফ্লাইট করে
গোয়া কিংবা জয়পুরে
সময় পেলেই ঘোরা আছে।
সপ্তাহেতে দুবার করে,
রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে,
মুভি হলে সিনেমা আছে,
লাইভ শোয়ের টিকিট আছে।

কিন্তু তোমার সবুজ নেই,
শ্যামল মাঠের খোলা হাওয়ার
মাতাল করা সুবাস নেই,
মাথার ওপর নীল নেই। 
ঘরের ভেতর আরাম ক'রে,
নিখাদ একটা আড্ডা মারে -
এমন কোনো বন্ধু নেই। 
ঘোরা আছে, চেনা নেই,
শিল্প আছে, চর্চা নেই,
সত্যজিৎ খানিক আছেন,
শেষের কোনো কবিতা নেই।
রাস্তার পাশে ফুচকাওয়ালা-
শেষের ফাউটা দিতে বলার
ইচ্ছে আছে, উপায় নেই। 
"অনুপম" তো চিরন্তন,
গানের স্রোতে ভাসা নেই,
তোমার নতুন ভাষা নেই,
তোমার কেবল আমি আছি,
তোমার আসলে তুমি নেই।

Friday, August 31, 2018

"অরাজনৈতিক" আন্দোলন ও কলকাতা-কেন্দ্রিক নাগরিক সমাজ (~৫ মিনিট) । Apolitical Movements and Kolkata-based Civil Society

একবিংশ শতকের বয়েস বাড়ার সাথে সাথেই বাঙালির একটা প্রবণতা বেশি বেশি করে চোখে পড়ছে, "অরাজনৈতিক" হতে চাওয়ার প্রবল চেষ্টা। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনাস্থাই হয়তো এর মূল কারণ। কিন্তু এই "অরাজনীতি" তাঁদের সাময়িক আরাম ছাড়া আর কিছু দিচ্ছে বলে মনে হয় না। উপরন্তু এই "অরাজনীতির" সুযোগ যখন কোনো রাজনৈতিক দল নিতে পারছে, তখন তারা লাভবান হচ্ছে। আর যখন তা হচ্ছে না, তখন কিছু গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট কিছু সমস্যা ক্ষণিকের জন্য সমাধান হচ্ছে। অথচ "রাজনীতি" যদি সত্যিই দক্ষ এবং দায়িত্বপূর্ণভাবে করা যেত, তাতে কিছু ক্ষতি ছিল না, বরং একটা বৃহত্তর সমাজের ভালো হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে মেডিকেল কলেজের ঘটনা নিয়েও এই "অরাজনৈতিক" আকাঙ্খা আবারো দেখা গেল। মেডিকেল কলেজের হোস্টেল নিয়ে ছাত্ররা একটি আন্দোলন করছিলেন। তাঁদের দাবি না মানায় তারা একটি পলিটিকাল টুল হিসেবে "অনশন"-কে ব্যবহার করেন। দিন বাড়ার সাথে সাথে, কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলগুলো থেকে অনেক মানুষ এই আন্দোলনের সমর্থনে নেমে আসেন। তাঁরা মেডিকেলে কলেজে উপস্থিত থেকে ছাত্রদের সমর্থন জানান। শেষ পর্যন্ত কতৃপক্ষ ছাত্রদের দাবি মেনে নেয়। তবে এই আন্দোলনের পিছনের রাজনৈতিক চরিত্রটা কলকাতার মানুষ বুঝতে চাইলো না। আন্দোলনটাকে একটি "অরাজনৈতিক" চরিত্র দিয়ে তার পাশে দাঁড়ানো হল। 

এই আন্দোলনকে একটু গভীর ভাবে দেখলে অন্য চরিত্র বেরিয়ে আসে। মেডিকেল কলেজের যে ছাত্র সংগঠন এই আন্দোলনটা পরিচালনা করছিলো, ডিএসএফ, তাঁদের দাবিতে এও ছিল যে, তৃণমূলের প্রাক্তন ছাত্রকে যে সুপার করা হয়েছে, তাঁকে রাখা যাবে না। বদলে ছাত্র-শিক্ষকের কাউকে রাখতে হবে। অন্তত ন্যায়সঙ্গত দাবি, এবং রাজনৈতিকও। দাবিটাকে একটু বড় করে দেখলে বোঝা যায়, সব জায়গায় তৃণমূলের পোষ্য লোক বসিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এই দাবি। অনেক জায়গাতেই এখন এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন মানুষ। কিন্তু সব আন্দোলনকে "অরাজনৈতিক" রূপ দেওয়া যায় না, সব আন্দোলনের এলিটিজম থাকে না, যা মেডিকেল কলেজের আছে। ফলে সেইসব আন্দোলন কোনো স্বীকৃতি বা বৃহৎ আকৃতি পায়না। অথচ মানুষের এখনই দরকার ছিল, এই ধরণের আন্দোলনগুলোকে একত্রিত করার। কিন্তু তা না হয়ে, এটা স্রেফ মেডিকেলের ছাত্রদের সাময়িক উপশম ঘটালো।

এখনকার এই ঘটনা যেমন দেখায় যে অরাজনৈতিক আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা, তেমনি উল্টো পিঠও আছে। ২০০৭ সালের নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন হয়, তাকেও প্রথমদিকে এক "অরাজনৈতিক" রূপ দেওয়া হয়েছিল। কলকাতার সাধারণ মানুষ এবং "বুদ্ধিজীবী", শিল্পী সমাজ সেই আন্দোলনের সমর্থনে নেমে এসেছিলেন। যদিও এটা অরাজনৈতিক আন্দোলন একেবারেই ছিল না, পিছনে খুব ক্ষুরধার রাজনৈতিক মাথারা কাজ করছিলেন। মমতা ব্যানার্জি এই আন্দোলন থেকে নিজের পলিটিকাল মাইলেজ উদ্ধার করেন। আবার মাওবাদীরা - যাদেরকে দেশের সব থেকে বড় ইন্টারনাল সিকিউরিটি থ্রেট বলেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী - এই আন্দোলনের পিছনে তাঁদের অক্সিজেন খুঁজে পেয়েছিলেন। বাংলার সাধারণ মানুষ অজান্তে দেশের "বৃহত্তম ইন্টারনাল সিকিউরিটি থ্রেট"-কে সমর্থন করেছিল। এরপরে মমতা ব্যানার্জির শাসক চরিত্র উদ্ঘাটিত হওয়ার পরে, সেই বাংলাবাসীই হাত কামড়েছে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করার জন্য। 

মূলত যেটা দেখা যাচ্ছে, বাঙালী "অরাজনৈতিক" হওয়ার চক্করে কখনো সুযোগ হারায়, কখনো ব্যবহৃত হয়। সম্ভবত ৭০-এর দশকে ছাত্রদের চরম রাজনৈতিক চরিত্রের ফলে যে করুন পরিণতি হয়, এবং হাজার হাজার ছাত্র-যুবরা মারা যান, তার কারণেই বাঙালী এখন রাজনৈতিক হতে ভীষণ ভয় পায়। বাড়ির বড়রাও বলেন ছাত্রদের রাজনীতির দিকে না এগোতে। যদিও এই ঘটনা খুব নতুন নয়, কিন্তু এর ফলগুলো নতুন নতুন করে বাঙালীকে সমস্যার মধ্যে রেখে দিচ্ছে। আমাদের শিবপুরে আমরা দেখেছি, কিভাবে কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের অরাজনৈতিক করার মাধ্যমে সমস্ত ধরণের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন। আমরা না বুঝেই "অরাজনৈতিক" হয়েছিলাম, তবে পরে উপলব্ধি করেছিলাম যে আমাদের বক্তব্য বলার মতো প্ল্যাটফর্মটা আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হল। সে কারণেই মনে হয়, "অরাজনীতির রাজনীতি"-এর এই ধোঁকাটা বন্ধ হওয়া দরকার। "অরাজনীতি" বলে যে কিছু হয়না - সেটা বোঝা দরকার।বাঙালী যদি রাজনীতিটাকে অস্পৃশ্য করে না রেখে, সুস্থ এবং দায়িত্বশীল একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারতো, তাতে তাঁদের নিজেদেরই মঙ্গল হত। আশা রাখবো, ভবিষ্যতের আন্দোলনগুলো গঠনমূলক রাজনৈতিক পরিচিতি পাবে, এবং সেখান থেকে এক বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের পরিসর গড়ে উঠবে।

Thursday, August 30, 2018

শিল্পকলা নিয়ে নোটস - ২ | Notes on Arts - 2

আগের নোটে শিল্পের ক্লাসিকাল এবং মর্ডান ধারার মধ্যে একটা মেলবন্ধনের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে, শিল্পের বিষয়বস্তু বোধগম্য না হওয়ার একটা কথা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। সেটা নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করা যাক।

শিল্পকে বুঝতে পারার জন্য যেমন নমনীয়, অনুভূতিপ্রবণ একটা মনন দরকার হয়, তেমনি একটা বিশ্লেষণী ক্ষমতাও লাগে। তবে সেই বিশ্লেষণী ক্ষমতার কথা বেশি করে ভাবলে শিল্প আর শুধু অরগ্যানিক একটা বস্তু থাকে না, যার সৃষ্টি নাকি কোনো এক অদৃশ্য শক্তি, ক্ষমতা বা অনুভূতির ওপর নির্ভর করে। এই বিশ্লেষণী ক্ষমতা শিল্পকে কিছুটা যান্ত্রিক বা মেকানিকাল করে ফেলে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।

কোনো "ভালো" গানের কথা ধরা যাক, যেমন অঞ্জন দত্তের "বেলা বোস" বা ক্যাকটাসের "হলুদ পাখি"। আমরা যদি ভেবে নিই, এই গানগুলোর সুর তৈরি হয়েছে শুধুমাত্রই অনুভূতি দিয়ে, মানে অঞ্জনবাবু কোন মনখারাপের বিকেলে "বেলা বোস"-এর কথার সাথে সুর তৈরি করেছেন, তাহলে হয়ত শিল্পের একটা আলাদা বায়বীয়তা, মাধুর্য, স্বর্গীয় ভাব তৈরি হয়। কিন্তু আমরা একটু গভীরে গিয়ে দেখবো যে, এই দুটো গানেই শুধুমাত্র ডি মেজর key-এর বিভিন্ন কর্ড ব্যবহার করা হয়েছে। হয়তো অঞ্জনবাবু বা ক্যাকটাসের মনে মনে হৃদয় থেকেই ডি মেজরের কর্ড গুলোই এসেছে। কিন্তু আমাদের এটাও দেখতে হবে যে, এরকম একটি স্কেলের মেজর কর্ড গুলো মানুষের কানেও শ্রুতিমধুর হিসেবে শোনায়। সেই সূত্র ধরেই এনারা পুরো গানের সুরটাকে বেঁধে ফেলেছেন।

এভাবে শিল্পের বিশ্লেষণ করতে বসলে দেখা যায়, প্রত্যেক শিল্পেরই কিছু ব্যাকরণ আছে। গানের যেমন major বা minor key-এর কর্ডস। এই ব্যাকরণ দিয়েই প্রত্যেক শিল্পের আলাদা কিছু ভাষা তৈরি হয়। যখন কোনো শিল্পী সেই ভাষায় কথা বলে কোনো শিল্প সৃষ্টি করছেন, তখন আমাদের কাছে তা ভীষণ ভালোলাগার এনে দিচ্ছে, যদি আমরা সেই ভাষা বুঝতে পারি। কিন্তু যখন আমরা সে ভাষা বুঝতে পারছিনা, তখন সেই শিল্পকে আমাদের গ্রহণ করতে সমস্যা হচ্ছে। সে জন্য পন্ডিত আমীর খাঁ-এর "সাহানা" রাগ আমাদের কারো কারো কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ওই রাগের যে ভাষা, তার স্বাদ বুঝতে পেরে তার শিল্পরসে ভেসে যাচ্ছেন।

শিল্পের এই ভাষা শেখানোর জন্যই আজকাল বিভিন্ন আর্ট স্কুলগুলো তৈরি হয়েছে। এই স্কুলগুলিতে প্রচলিত শিল্প-ভাষাগুলি শেখানো হয়ে থাকে। তাই কেউ যদি কোনো শিল্পের সম্পূর্ণ মাদকতা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হয়, তাহলে সে এই আর্ট স্কুলগুলোর শরণাপন্ন হতে পারে, অথবা নিজে থেকে সেইসব ভাষাকে রপ্ত করার চেষ্টা করতে পারে। তবে প্রচলিত ভাষা যেমন আছে, তেমনি সেই ভাষাকে ভেঙে দেওয়াও আছে।

আমরা যদি সত্যজিত কে দেখি, তাহলে দেখতে পাবো, সিনেমার ভাষা মেনে নিয়ে তিনি অকল্পনীয় কিছু সিনেমা তৈরি করে গেছেন। তার সিনেমাগুলো তখনকার ওয়েস্টার্ন ফিল্মের যে ভাষা, তার সাথে সামঞ্জ্যপূর্ণ। সত্যজিৎ নিজেও একাধিক সাক্ষাৎকারে তার এই ওয়েস্টার্ন ফিল্মের অনুপ্রেরণার কথা বলেছেন। বিপরীত দিকে আছেন ঋত্বিক। তিনি সিনেমার সব প্রচলিত নমনীয় ভাষা, ন্যারেটিভ ভেঙে দিচ্ছেন। ফলত প্রথমে মানুষ সেই ভাষাকে নিতে পারছেনা। কারণ একটা নতুন ভাষা বুঝতে পারা তো বেশিরভাগ জনগণের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা ঋত্বিক-এর বেশিরভাগ ফিল্মকে পছন্দ করেছেন না। কিন্তু "যুক্তি তক্ক গপ্প" একটা ল্যান্ডমার্ক ফিল্ম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে, আর এ জন্যই ঋত্বিক এর ছবিগুলোকে এখন বিভিন্ন ফিল্ম স্কুলে গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়ে থাকে। যাতে শিক্ষার্থীরা এই ভাষা সম্পর্কে অবগত হতে পারেন।

এর পরে প্রশ্ন আসতে পারে, শিল্পীরা তাদের শিল্পের উৎস ঠিক কোথা থেকে পেয়ে থাকেন। যে কোনো শিল্পের উৎকর্ষতা তো সেই শিল্পের সততা আর তার ভাষার উপর নির্ভর করলো। কিন্তু সেই উৎকর্ষ শিল্পের অনুপ্রেরণা কোথায়? এ নিয়ে পরের নোটে ভাবার চেষ্টা করবো।
(চলবে)

Wednesday, August 22, 2018

কাউকেই চিনি না - Don't know anyone!

Boston, 22-Aug-2018, 10:00 PM

আমার কোনো মুসলিম বন্ধু নেই,
আমার কিছু বন্ধু আছে যারা মুসলিম,
আমার কিছু বন্ধু আছে যারা ঈদের দিন নতুন জামাকাপড় পরে,
কখনো আমাকে সুস্বাদু বিফ খাওয়ায়।
আমার কোনো হিন্দু আত্মীয় নেই,
আমার কিছু আত্মীয় আছে যারা পুজো-আচ্চা করে,
ভালো সিন্নি বানায়।
আমার কোনো বিহারী সহপাঠী ছিল না,
আমার কিছু বন্ধু আছে যারা আমায় প্রথম লিট্টি খাইয়েছিল।
আমার কোনো চেনা মাড়োয়ারি দোকানদার নেই,
পাড়ার মিষ্টির দোকানের মালিক জাগেতিয়া বাবু
আমার প্রিয় মিষ্টির খোঁজ রাখেন,
ওনার কাছে ওদের জয়পুরের বাড়ির গল্প শুনেছি।
আমি কোনো তামিল ছেলেকে চিনিনা,
তবে আমার রুমমেট আমাকে নিখুঁত ধোসা বানানো শিখিয়েছে।
আমি কোনো পাকিস্তানী মেয়েকে চিনিনা,
আমেরিকায় আমার ল্যাবমেট আমার সাথে হিন্দিতে লাহোরের গল্প করে।
আমার কোনো মেক্সিকান কলিগ নেই,
পাশের কিউবিকলের ছেলেটার জানে কোথায় ভালো টাকো পাওয়া যায়,
আমরা মাঝে মাঝে একসাথে খেতে যাই।

আমি আজকাল কাউকেই চিনিনা,
আমি শুধু কিছু মানুষ চিনি, মান-হুঁশ।

Sunday, August 19, 2018

শিল্পের আধুনিকতা নিয়ে নোটস - ১ | Notes on Modernity of Arts - 1

ভাবনাগুলোকে অক্ষরে চালান করতে করতে বুঝতে পারছি এগুলো মূলত নোটস। সেরকমই শিল্প আর তার আধুনিকতা নিয়ে বহুদিন ধরেই মনের মধ্যে ভাবনার অযাচিত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। তা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে বেশ ক্লান্ত। এ নিয়ে বেশ কয়েকজনের সাথে অনেক বার আলোচনাও হয়েছে। এবার বোধ হোয় এই ভার নামিয়ে রাখার সময় হয়েছে, সুতরাং লিখন।

শিল্পকে এক হাজার ফুট উঁচু থেকে মূলত দুই ধারায় ভাগ করে নেওয়া যায় - ক্লাসিকাল আর মডার্ন। ক্লাসিকাল এর কথায় পরে আসছি। আধুনিক এর কথা দিয়ে শুরু করি, খুব সাবজেক্টিভ একটা ব্যাপার। বাংলা গানের আধুনিকতা নিয়ে লেখাটায় বলেছিলাম যে, সমসাময়িকতা আমার কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা বয়ে আনে। তাই সলিল চৌধুরী যখন কৃষকদের জমির অধিকারে স্বাধীনতার পরেই "হেই সামালো ধান" লিখছেন, আমার কাছে উনি ভীষণ আধুনিক হওয়ে উঠছেন। বব ডিলান যখন বিশ্বের নাগরিক অধিকারের জন্য, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লিখছেন, "টাইমস দে আর চেঞ্জিং", তিনি আমার কাছে ভীষণ পরিমাণে "আধুনিক"। আমি প্রধানত আধুনিক শিল্পকেই ভালোবাসি। ক্লাসিকাল এর প্রতি আমার তেমন আসক্তি নেই।

ক্লাসিকালকে এ হেন বুড়ো আঙুল যখন দেখাচ্ছি, তখন তার পিছনে অনেকগুলো কারণও আছে। নিখিল ব্যানার্জী যখন "মেঘ" রাগে পরিবেশমন্ডলীতে গভীর নিম্নচাপ তৈরি করেছেন, আমি আধঘন্টার জন্য সেই আবহাওয়াতে মিশে যাচ্ছি বটে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না, কি হচ্ছে! উনি যে কোথা দিয়ে আমাকে নিয়ে চলেছেন, সেই রাস্তাই চিনতে পারছি না। এই যে বিমূর্ততা, এটাই তো ক্লাসিকাল শিল্পের প্রাণ ভোমরা। এই বিমূর্ততা কে আমি ধরতেই পারছিনা, আমার অপারগতা। তাই ক্লাসিকাল শিল্পকে আমি আমার শিল্প বলে ভাবছিনা। ঠিক পছন্দ করতে পারছিনা।

এসব বলার পরে, জর্জ বিশ্বাস যখন "আকাশভরা" শুরু করছেন তখন তো আমি মহাবিশ্বের সাথে নিজেকে আর আলাদা করতে পারছিনা। তখন আমি, রবীন্দ্রনাথ, জর্জদা - একসাথে বসে আছি আমরা। সকলে মিলে পথের পাঁচালী দেখছি। যা কিনা আদ্যন্ত একটি ক্লাসিকাল ছবি, অন্তত আগে বলা আধুনিকতার সংজ্ঞা অনুযায়ী। তাহলে আধুনিকতার একটা নতুন সংজ্ঞা বানাতে হয়, কারণ শুধু সমসাময়িকতা দিয়ে আধুনিকতাকে আর বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। এই নতুন সংজ্ঞায় নিয়ে আসতে হচ্ছে "খোঁজ"।

চন্দ্রিলবাবুর বক্তব্যকে একটু বিস্তৃত করে বলা যায়, যে শিল্পের মধ্যে এক নিরন্তর সন্ধান চলেছে, সেই শিল্পই আধুনিক। সে খোঁজ নিজেকে চিনতে পারার হতে পারে, বা শিল্পকে উত্তরণের হতে পারে অথবা কোনো এক বিমূর্ত খোঁজ, যা কিনা আসলে সন্ধান পাবার পরও বিমূর্ত থাকবে। সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী ক্লাসিকাল শিল্পভাবনা এক চূড়ান্ত আধুনিকতায় পরিবর্তিত।

পন্ডিত আমীর খান "বসন্ত" রাগে যখন বিস্তার করছেন, তখন তো মনে হচ্ছে উনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই সর্বশেষ অনুভূতিকে যা বসন্তকে বয়ে আনবে। যে বসন্তের ছায়াছবি তাঁর মনে, হৃদয়ে, মস্তিষ্কে খেলা করছে, সেটাকেই সুরের মধ্যে প্রকাশের এক সর্বোত্তম চেষ্টা। সেই আল্টিমেট অনুভূতিকে নিরন্তর রূপ দেওয়ার চেষ্টাই সার্থক করে তুলছে ক্লাসিক্যাল শিল্পকে। কিন্তু কোনো শিল্পই তো সার্থক নয় এই সন্ধানটুকু ছাড়া। সত্যজিৎ- এর অন্যতম "আধুনিক" কীর্তি, প্রতিদ্বন্দ্বীর শেষ দৃশ্যটা মনে পড়ে যায়। সেই ছোটবেলার নাম-না-জানা পাখির ডাকটা। সেটারই তো খোঁজ সারা ছবিটা জুড়ে। ওই মিষ্টি ডাকটা, ওই সরল ডাকটা, যেটার মধ্যে লুকিয়ে আছে সব অন্তর্দ্বন্দ্বের অবসান। সেটার সন্ধানেই তো কি ভীষণ আধুনিকতা সত্যজিৎ-এ।

এই পর্যন্ত এসে ক্লাসিকাল আর আধুনিক সম্পূর্ণ মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলেছি। নবারুণ এর ছোট গল্প কিস্যু বুঝতে পারছিনা। অথচ মানুষটি কি ভীষণ "আধুনিক"। ওনার কবিতা দিয়েই তো আশা নিয়ে বাঁচছি, চেষ্টা করছি, যেন "একটা কথার ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে" পড়ে, হোক সারা সহর উথাল পাথাল। আধুনিকতা তছনছ করে দিক চারপাশের এই মেকী পরিপাট্য। এবং তার পরেই হয়ত একটা নতুন সূর্য উঠবে, "লাল সূর্য" পূর্ব দিকে। সব কিছু তখন কোমলতায় ভরে গেছে। পন্ডিত আলী আকবর খাঁ তখন ভৈরবী বাজাচ্ছেন। রাগেদের সাথে নাকি অনেকটা সময় কাটাতে হয়, তবেই নাকি তাদের বোঝা যায়। আমিও হয়ত একটু একটু করে বেশি সময় কাটিয়ে, রাগসহ অন্যান্য ক্লাসিকাল শিল্পের বিমূর্ততা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করবো। যেখানে অন্তর্দ্বন্দ্বের সাথেই সহাবস্থান করবে পরিতৃপ্তি বা রেসোলিউশন।
(চলবে)

Sunday, June 17, 2018

পর্দার ওপারে - On the other side of the curtain

Austin, Texas, 18-Jun-2018, 2:17 AM

দুঃখ তখন বৃষ্টি ফোঁটায়, খুব ক'রে মেঘ ঈশান কোণে,
বাদল ঘনায় মনের কনায়, তবুও যেন কেউ না জানে। 

সবাই কেমন বহিরাগত, ভিতরপানে চায় না কেউ,
মনেই গড়া মস্ত দেওয়াল, আটকে দিচ্ছে সুজনকেও।

বয়স হওয়ার অধীর ভারে চুঁইয়ে পড়ছে বিষন্নতা,
কাছের মানুষ, দূরের মানুষ - ভীষণরকম একাত্মতা।

মনের সাথে একলা থাকার এই আদুরে গল্পখানি,
মেঘলা হাওয়ার স্পর্শ লেগে একটুমতো অভিমানী।

Wednesday, June 06, 2018

সাম্যবাদী গণতন্ত্র - Communist Democracy

টুকাইয়ের বাড়িতে মাটির ওপর আসন পেতে বসে স্টিলের থালায় মাংস-ভাত খাচ্ছিলাম। ওর মা সামনে বসেছিলেন। সবশেষে টমেটোর চাটনিও ছিল, কাকিমা বেশ সুন্দর বানিয়েছিলেন। সেবারে টুকাইয়ের জন্মদিনে বেশ মজা হয়েছিল, সাজ্জানলালও এসেছিল। আমি একটা পেন্সিলবক্স উপহার দিয়েছিলাম টুকাইকে, তাতে কয়েকটা খুব সুন্দর পেন্সিল ছিল। তার আগের দিনই ওকে অঙ্কের মাষ্টারমশাই আলম স্যার ক্লাসের বাইরে নীল ডাউন করিয়ে দেন, ক্লাসে লেখার সময় ওর নিজের পেন্সিল না থাকায়। সেজন্যই বোধ হয় ওর খুব পছন্দও হয়েছিল পেন্সিলবক্সটা। ও খুব খুশি ছিল সেবার। আমাদের দুপুরের খাবারের একটু আগেই কেক কাটা হয়েছিল; এই পাশেই, ওদের শোয়ার ঘরে। অবশ্য যা ওদের শোয়ার ঘর, সেটাই ওদের বসার ঘর, সেটাই আমাদের ট্রাম্প কার্ড খেলার ঘর - সবই ওই এক ঘর। কারণ ওদের একটাই ঘর ছিল তখন, এবং সেটাই ওদের পুরো বাড়ি। বাইরে যে ছোট্ট মত জায়গাটায় আমরা খাচ্ছিলাম, সেই ছোট্ট মতো জায়গাটাতেই ওর মা, মানে কাকিমা রান্না করতেন। খেয়ে নিয়ে একটু গল্প করেই আমরা সেদিন স্কুলের মাঠে খেলতে চলে গেছিলাম, দৌড়ে দৌড়ে।

দৌড়োতে দৌড়োতে আমি ২৩বি নম্বর গেট-এ পৌঁছলাম, কিন্তু গিয়ে দেখলাম প্লেন ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। অবশ্য টুকাই দৌড়ে ৩৪ বি বাসটা ধরে ফেলেছিল ধর্মতলার মোড়ে, কে.সি.দাশ-এর অপোজিট-এ। এভাবে কিছু ট্রেন আমরা মাঝে মিস করেছি, কিছু প্লেন ধরে ফেলেছি। ঠিক মতো জানি না, টুকাই ঠিক কোন কোন ট্রেন বা বাসগুলো ধরতে পেরেছিল বা পারেনি। তবে এটুকু বুঝেছিলাম, আমার জন্য যে ট্রেনগুলো ছিল, সেগুলোর নাগাল পায়নি টুকাই। ওর আর্থিক অবস্থা থেকে পাওয়ার কথা ছিল না। হয়তো আমার ছোটবেলার বন্ধু সাজ্জানলালও কিছু একটা কাজ জুটিয়ে নিয়েছে এতদিনে, যদিও ওর একটা পা-এ সামান্য সমস্যা ছিল, খুঁড়িয়ে হাঁটতো। ওর আর কোনো খোঁজ পাইনি স্কুলের পরে, যেমন সামিউল-এরও পাইনি। টুকটাক কিছু খবর ছাড়া অন্য খবর পাওয়ার কথাও ছিল না। কারণ আমি ধীরে ধীরে আলোর দিকে চলে এসেছি। আর আমরা যখন আলোয় থাকি, অন্যদের স্রেফ কিছু সংখ্যায় পরিণত করি। তাই পেপারে আলাউল, টুকাই, সাজ্জানলালদের সম্পর্কে combined কিছু তথ্য পেয়েছি। বুঝতে পেরেছি ওদের জন্য কিছু উন্নতি হচ্ছিলো, আর অনেক কিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।

আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম আমাদের কাছাকাছি ও ব্যক্তিগত উন্নতিটা। একটা সময় মা উনুনে রান্না করতো, তারপর একদিন গ্যাসে এসে গেল। অন্যের বাড়ি থেকে আমাদের নিজেদের বাড়ি হচ্ছিল। টুকাইরা মাটি আর বাঁশের ঘর ছেড়ে পাকা ভাড়া-বাড়িতে উঠে আসছিল। কিন্তু এসবের পিছনের কাহিনীটা আরো পরে ধরতে আরম্ভ করি। সরকার থেকে চাকরি হচ্ছিল অনেকের, আমার বাবা-মা-আত্মীয়রা এই পরিবর্তনটার সাক্ষী ছিল। কিছু বেসরকারি চাকরিও দেখছিলাম। কিন্তু চাকরি তো এমনি এমনি হতে পারে না। এর পিছনে চলছিল লাগাতার আন্দোলন, শ্রমের অধিকার এবং মূল্যের জন্য। অনেক মানুষ মাঠে-ঘাটে নেমে এই আন্দোলনটা করছিলেন। তারা সত্যিকারের শ্রমের মূল্যের তত্ত্ব কতটা বুঝেছিলেন, জানিনা। কিন্তু তাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে শ্রমের প্রকারভেদ এবং নিজেদের সামাজিক অবস্থানটা যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাঁদের আন্দোলনের দিশাও ছিল, প্রাপ্তিও ছিল। একই জিনিস হচ্ছিল একটু গ্রামের দিকে, চাষিদের বাড়িতেও। মুশকিল হল - তাঁরা সকলেই বাস করছিলেন একটা গণতান্ত্রিক দেশে এবং আন্দোলন করছিলেন সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।

আন্দোলনকারীরা তাঁদের যথার্থ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে স্বচ্ছলতাটা আনলেন তাঁদের জীবনে, সেটা সকলের জীবনেই আনা সম্ভব ছিল না। কাজ কখনো একেবারে, একটা প্রজন্মের আন্দোলনে শেষ হতে পারে না, তার জন্য অনেকটা সময়, অনেকগুলো যুগ লাগে। ফলে অনেক মানুষ, এর পরেও, পিছনেই পড়ে রইলেন। কিন্তু একটা প্রজন্মের আন্দোলনের বয়ে আনা স্বচ্ছলতা একটা বৃহৎ গোষ্ঠীকে মূলত পঙ্গু করে দিল। এই খুব বড় জনগোষ্ঠীই হল আমাদের সোনার মিডল ক্লাস, মানে আমরা যারা মধ্যবিত্ত। আমরা একটা আপাত সুখের মাঝে বড় হলাম; বাবা-মা তাঁদের স্বভাববশত, তাঁদের কষ্টটা আমাদের কাছে যথাসম্ভব চেপে রাখলেন। আমরা বড় হয়ে কেউ প্লেন ধরলাম, কেউ ছুটে গিয়ে বাস ধরলাম। এইভাবে আমরা নিজেদের আরো উপরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করলাম বটে, কিন্তু অনেকেই এই দৌড়টায় পিছিয়ে পড়লো।

যারা পিছিয়ে পড়লো, তারা মনে করলো, তাঁদের পিছিয়ে পড়ার কারণ তাঁদের নিজেদের অক্ষমতা। অথচ আমরা যে সেই একই সমাজব্যবস্থায় বাস করছি, সেটা অনেকেই খেয়াল করলাম না। নাহ্, একটু ভুল বললাম, ঠিক একই সমাজব্যবস্থায় আমরা আর বাস করছিলাম না। একটা বৃহৎ গোষ্ঠী, যারা আমাদের আগের প্রজন্মে সক্রিয় ছিল, তারা এখন নিজেদের অক্ষম বলে ভাবতে শুরু করেছে। তাই ব্যবস্থাটাকে আর একই বলা যাচ্ছে না। এই এখনকার অক্ষম গোষ্ঠীটাতেই আগে ছিল আমাদেরই বাবা-মা-আত্মীয়রা, তাঁদের যুবক-সত্ত্বায়, যারা তখন মাঠে-ঘাটে নেমে আন্দোলনটা করছিল, শ্রমের অধিকারের জন্য, সঠিক চাকরির জন্য। কিন্তু আমরা বড় হয়ে সেই চাকরিটাকে হয় নিজেদের অধিকার অথবা চাকরি না-পাওয়াটাকে নিজেদের অক্ষমতা বলতে শুরু করলাম। ফলে যে গোষ্ঠীটা খুব সক্রিয় ছিল নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে আনায় বা প্রতিষ্ঠিত করায়, সেই গোষ্ঠীটা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল।

পুরোপুরি বিলুপ্তও বলা যায় না, বলতে হয়, সেই গোষ্ঠীটা ছন্নছাড়া হয়ে গেল। সেই গোষ্ঠীর কিছু লোক এখন ব্যাঙ্গালোরে হুইস্কি সহযোগে হাহুতাশ করে মমতা ব্যানার্জির শাসন নিয়ে, অথবা নন্দনে বিকেলবেলা হাওয়া খেতে খেতে সিপিএম-এর করুন দশা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, অথবা আমেরিকায় বসে এরকম একটা লেখা লেখে। এরা কিছুটা সচেতন সমাজের এই (অধঃ)গতিটা সম্পর্কে এবং সেখানে নিজেদের কিছু করতে না-পারার ব্যর্থতা সম্পর্কে। কিন্তু যেহেতু এদের আগের প্রজন্ম এদের একটা স্বচ্ছলতা দিয়েছে, একটা পরিসর দিয়েছে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বপ্ন-চাহিদাগুলো পূরণ করার, তাই তারা মূলত উদাস এবং প্রমাণসাপেক্ষে অপারগ, এই সমস্যা নিয়ে কিছু করার উদ্দ্যশ্যে।

এর পরও পড়ে থাকছে এই বৃহৎ গোষ্ঠীর আর একটা মূল উপগোষ্ঠী। যাদের এখনো সেই চাকরিগুলো দরকার, যেগুলো সক্রিয় আন্দোলন এবং সঠিক উন্নয়ন থেকে উঠে আসতে পারে। এই হল সেই গোষ্ঠীটা যারা গণতন্ত্রের এবং সর্বোপরি সাম্যবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে আসা স্বচ্ছলতার শিকার। এরা এখন হয় শাসক দলের তাবেদারী করতে বাধ্য বা সিভিক পুলিশে নাম লেখাতে। এদের কাছে সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তেমন কোনো উপায় নেই। কারণ এরা জানেনা, আন্দোলন করার মানে, এদের বড় হওয়ায় হয় মিশে আছে সামান্য শৌখিনতা, অথবা স্বচ্ছলতার মেদুর স্বপ্ন যা ২০০৩-০৪-এর "Shining India"-এর মতোই সত্যি। সেই স্বপ্নে কোনো আক্রোশ নেই, বাসনা নেই, শুধু আছে চাতকের চাহুনি। আর সেই চাহুনি চেয়ে আছে সমাজবাদী, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে, যা খানিকটা "সুখী" আন্দোলনে পর্যবসিত। তবে প্যারাডক্সটা এখানেই যে, সফল আন্দোলনের মূল জ্বালানি যে অনুভূতিটা, সেই আক্রোশ বা ক্রোধ নামক আবেগটা এখন প্রায় অনুপস্থিত এই গোষ্ঠীর ভিতর। ফলে আমরা কোথাও আটকে গেছি একটা ডেডলকের মধ্যে। কেউ কোনোদিকে চলতে পারছি না, কেউ দৌড়োতে পারছি না, কেউ মাটির কাছাকাছি যেতে পারছি না। আমরা শুধুই মাটির ওপরে সুন্দর হাতের কাজ-করা আসনটুকু দেখতে পাচ্ছি, পেতে চাইছি; ওর উপর বসে মাংস-ভাত খাওয়ার স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু আসনটা যে মাটিতেই বিছিয়ে দিতে হবে, এবং তার জন্য আসনটাকে যে মাটি ছোঁওয়াতেই হবে - সেটা মেনে নিতে রাজি হচ্ছি না। বর্তমান শাসকেরাও চান না আমরা রাজি হই, কারণ তারা এই পঙ্গু গোষ্ঠীটাকে ভোট জেতার মেশিনারি হিসেবেই কাজে লাগাতে ব্যস্ত। সাম্যবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন আমাদের যে দৌড়টা দিতে শিখিয়েছিল, আমরা খুব সহজে ভেবে নিয়েছি যে, তার বোধ হয় কোনো ফিনিশিং লাইন আছে। কিন্তু সেটা তো ছিল না, সেটার একটা চিরন্তন বহমানতা থাকার কথা ছিল। অথচ আমরা সেই কাল্পনিক ফিনিশিং লাইনে এসে অপেক্ষা করছি, আশা করছি, একটা উন্নততর পৃথিবীর, যেটাকে মরীচিকা ছাড়া আর কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সাম্যবাদী আন্দোলনের এটাই বোধ হয় সব থেকে বড় পরিহাস।
---

আলোচনা ও ভাবনা সহায়তা: শুভাশিস পাত্র

শুভাশিসের মন্তব্য: তোর এই লেখাটা পড়ে আমার মনে যে টা সব থেকে বেশি টাচ করেছে সেটা হল 'গোষ্ঠী'। শ্রেণী নয়। একদম ঠিক। যতদুর মনে পড়ে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার এর পর থেকেই শ্রেণী চেতনা হারিয়ে গেছে এসেছে গোষ্ঠীবাজি। তুই সেটাই দেখেছিস।
তোর দেখাটা সত্য। বামফ্রন্ট সরকার যখন থেকে কাজের সুযোগ তৈরী করতে সক্ষম হল, তখন আন্দোলনটা গোষ্ঠীগত আন্দোলন হয়ে গেছে, শ্রেণীগত চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার তাগিদে ভুলে গেল তুলনামূলক ভাবে অগ্রসর শ্রেণী এর সিংহ ভাগ সুযোগ আত্মসাৎ করবে। হলও তাই। সেই ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে মুক্তি পেতে ultimately মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর উদয় হলো। কিন্তু সেটাও মরিচীকা।

Sunday, June 03, 2018

সংরক্ষণ বন্ধ করার আগে - Before abolishing caste-based Reservation

দীপক মন্ডল ক্লাসের মাঝারি মাপের ছাত্র। প্রথমবার সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসে ভালো ফল করতে পারেনি। যদিও সংরক্ষণের সুবিধা অনুসারে তার চাকরি হয়ে যায়, কিন্তু সে কখনোই ওই সুবিধে নেয়নি। তাই অনেক খেটে, পড়াশোনা করে দ্বিতীয়বার আবার চাকরির পরীক্ষা দেয় এবং ভালো ফল করে। তারপর সরকারি দপ্তরে জেনারেল কোটাতেই তার চাকরি হয়। সরকারি চাকরি পাবার পর খুব খুশি ছিল দীপক। ভেবেছিল এবার সে সুলগ্নাকে বিয়ে করতে পারবে। সুলগ্না তার কলেজের প্রেম, সুলগ্না চক্রবর্তী। কিন্তু সুলগ্নার বাড়ি থেকে এই বিয়েতে রাজি হয় না। কারণ দীপক SC, আর সুলগ্নারা ব্রাহ্মণ। সুলগ্নার বিয়ে ঠিক হয় সপ্তর্ষি ভট্টাচার্যের সাথে। সুলগ্না দীপককে ভালোবাসলেও বাবা-মা-র ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেতে পারেনি, সপ্তর্ষিকেই বিয়ে করে ও। সুলগ্না এখন ভালই আছে।

সুলগ্নার স্বামী সপ্তর্ষি একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। সেই ফার্মেরই রাইভাল ফার্মে দীপকের বন্ধু আলাউল কিছুদিন আগে অ্যাপ্লাই করেছিল। আলাউল অ্যাপ্লাই করার পরেও কল পায়নি ফার্মটা থেকে। দীপক জানত আলাউল-এর যা প্রোফাইল, অন্তত ইন্টারভিউর জন্য ওকে ডাকা উচিৎ। দীপকের অন্য কিছু বন্ধুও ওই একই ফার্মেই কাজ করতো। দীপক তাদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, আলাউল-এর শুধুমাত্র নামটা দেখেই নাকি ওকে বাছাই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছ।

আগে আপনারা দীপক মন্ডল আর সুলগ্না চক্রবর্তীর ভালোবাসার বিয়ে সুরক্ষিত করুন। আগে আলাউল ইসলামকে সমাজে প্রাপ্য সম্মান আর মর্যাদাটা দিন, তারপর না হয়, আমরা সরকারি ক্ষেত্রে ওদের সংরক্ষণ তোলার ব্যাপারে ভাববো।

আগে আমাদের রাজ্যের পার্টি, সরকার এবং অন্যান্য প্রভাবশালী জায়গায় দীপক মন্ডল আর আলাউল ইসলামদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ুক, আগে বুদ্ধদেব "ভট্টাচার্য", মমতা "ব্যানার্জী"-এর ব্রাহ্মণ্য এলিটিজম বন্ধ হোক, তারপর নয় সংরক্ষণে ঠিক কি কি সুবিধে SC/ST-রা বেশি পাচ্ছে, সেটা ভাবা যাবে।

Saturday, May 26, 2018

অন্তরখনন

ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছি, কানে হেডফোন। একটু সামনে একটি মেয়ে হেঁটে চলেছে। আমার মনে হল, সে যেন আমার হেডফোনে হয়ে চলা গানের তালে তালে হাঁটছে। লক্ষ্য করে দেখলাম, তার কানেও হেডফোন। এর মানে, সে হয়তো সম্পূর্ণ অন্য কোনো গানের ছন্দেই হেঁটে চলেছে, অথবা তার হাঁটার হয়তো কোনো ছন্দই নেই। কিন্তু আমার কানে, আমার মনে যে গান, যে ছন্দ বয়ে যাচ্ছে, তারই প্রতিচ্ছবি আমি দেখতে পাচ্ছি মেয়েটির হাঁটার মধ্যে।

একইরকম ভাবে, আমরা তো সত্যিই জানিনা, অন্য লোকটা ঠিক কি ভাবছে, কিভাবে ভাবছে, কোন পরিপ্রেক্ষিতে ভাবছে। কিন্তু নিজেদের সুবিধেমতো একটা প্রতিচ্ছবি ভাসিয়ে দিই, অন্য মানুষের জীবনের ক্যানভাসে। অথচ সেই জীবনটা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই থাকে না। আর সেই মানুষটাকে যদি সামনাসামনি, চাক্ষুষ না দেখে থাকি, তখন আমাদের কল্পনাশ্রিত চারিত্রিক গড়নটার আরো সহজ প্রক্ষেপন করতে পারি। বিভিন্ন ডিজিটাল সোশ্যাল মিডিয়ার নেটওয়ার্কের দৌলতে, যেটা এখন প্রায়শই হয়ে থাকে।

এর ফলস্বরূপ, ঠিক কোন "আমি"-টা যে আসল "আমি", ক্রমশই সেটা ধোঁয়াশায় চলে যাচ্ছে। আমার চারপাশের সমাজ একটা নির্দিষ্ট "আমি"-কে ডিমান্ড করছে। আমার সোশ্যাল মিডিয়ায় অচেনা-স্বল্পচেনা-(আগে-চেনা-এখন-অচেনা) বন্ধুরা একটা "আমি"-কে চাইছে। এছাড়াও ব্যাক্তিগত স্তরে আরো নানা কাছের মানুষ, দূরের মানুষেরা বিভিন্ন "আমি"-কে চেয়ে থাকছেন। 

কিন্তু তার মধ্যে থেকেও একটা আমার "আমি" তো আছে। যে "আমি"-টা একান্ত আমার। যে "আমি"-টাকে আমি নিজে চেয়েছি। যে "আমি"-টার মতে, সৃষ্টিশীল শিল্প আর রাজনীতি একসাথে পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে। যে "আমি"-টার মতে আধ্যাত্মিক এবং ধর্মীয় ব্যাপারকেও খুব যুক্তিযুক্তভাবেই তর্কের বিষয়ে আনা যায়। তাকে স্রেফ "গাঁজাখুরি" হিসেবে উড়িয়ে না দিয়েও, দেখানো যায় যে ধর্ম পালনের জায়গাটা খুবই ব্যক্তিগত। আবার সেই "আমি"-টা তো এটাও মানে, যে সমাজবাদ কোনো ধর্ম নয়। 

মানুষের সমাজে থাকার দরুন, তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই তো একসাথে সমাজবদ্ধ হয়ে থাকা। সেই সমাজে একে অপরের সাহায্যই তো খুব প্রত্যাশিত। সেখানে কি করে একটা ভার্চুয়ালি তৈরী করা জিনিস, যার পোশাকি নাম "টাকা", তাকে আমরা সমাজ এগোনোর প্রধান চালিকাশক্তি করে তুলতে পারি? কিন্তু তা বলে সমাজবাদ তো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মতো কোনো "গোঁড়ামো" নয়। কি করে তা হবে? কারণ সমাজ তো সদা-পরিবর্তনশীল, সে এক জায়গায় থামবে কেন! কিন্তু সেই সমাজবাদকেই কিছু মানুষ কুক্ষিগত ধর্মের মতো করে তুলছে। মাঝে মাঝে "মহামতি মার্ক্স্"-এর কোটেশন টেনে কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তা কেন হবে, আমি তো সমাজে থাকতে থাকতে স্বততই উপলব্ধি করছি সমাজবাদের গুরুত্ব। তার জন্য তো আমার মার্ক্স্-এর উদ্ধৃতি লাগছে না। হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে পড়তে হয় বৈকি, তবে যেমন কম্পিউটার আর্কিটেকচার বুঝতে না পারলে বই পড়তে হয়, ঠিক তেমনি; স্রেফ আগের কাজটাকে বুঝে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তারপর উপলব্ধি তো ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক তো নয়।

অথচ, যে এই "আমি"-টাকে দেখেনি বা বোঝার চেষ্টা করেনি, সে তো ওই প্রাতিষ্ঠানিক "আমি"-কেই দেখার চেষ্টা করছে। আমিও আর আলাদা থাকছি না, অনেক প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরূপের মধ্যে স্রেফ আর একটা প্রতিবিম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছি আমি। এর জেরে, সেই অন্যের চোখের "আমি"-র সাথেও আর নিজেকে মেলাতে পারছি না। খুব খুব দূরে সরে পড়ছি। একটা দেওয়াল তৈরী হচ্ছে। আমি বোঝাতে পারছি না, যে কোথাও গিয়ে আমার অন্য কিছু মনে হচ্ছে, লেনিনিষ্ট-স্টালিনিস্ট পার্টি স্ট্রাকচারে ঠিক বিশ্বাস থাকছে না আমার। আবার কোথাও হয়তো আমার মনে হচ্ছে, ট্রটস্কি যখন আন্তর্জাতিকতাবাদের কাছে গিয়ে সমাজবাদকে স্থান দিতে চাইছেন, সেটাই হয়তো আসল পথ। কখনো মনে হচ্ছে, নিচ-থেকে-উপরে আসার রাস্তাটাই সঠিক, নিচের স্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা-আন্দোলন-রাজনৈতিক-শিক্ষা না হলে উপরের নেতাদের শত শত কুরবানী, আন্দোলন বৃথা। সবকিছুকে আমি যখন অবজেক্টিভলি বুঝতেও চাইছি, আমার গায়ে লেগে থাকা "ট্যাগ", আমাকে তা বুঝতেই দিচ্ছে না, চারপাশের মানুষেরা সেই সুযোগটাই দিচ্ছে না। আমার মতপ্রকাশ স্রেফ আমার গায়ের "ট্যাগ"-কেই আরো জোরে সেঁটে দিচ্ছে। 

একেকবার খুব খুব, যাকে বলে, একেবারে ভীষণ রেগে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, এভাবে আর চলা সম্ভব নয়। আমাকে খুঁজে দিতেই হবে আফ্রিকা থেকে আহমেদাবাদ - সকল জায়গার শ্রমিকের সমানাধিকার। কিন্তু আবার তার পরেই তো আমার খুব ভালো লাগছে এই পৃথিবীটাকে। আমি নদীর ধারে যখন হাঁটছি, তখন দেখতে পাচ্ছি, সলিল সুর করছেন দূরে গাছের তলায় বসে, "আহা ওই আঁকা-বাঁকা যে পথ"। আমি তো শ্যামল মিত্রের স্রোতে ভেসে গেয়ে উঠছি, "আপন নীড়ে ফিরে গেছে পাখি, নীড় হারায়ে আমি পথে থাকি"। এগুলো তো মিথ্যে নয়, বরং ভীষণ ভীষণ করে সত্যি বলে মনে হচ্ছে আমার। আমি যখন অনেক ভেবে ভেবে, একটা থিওরি খাড়া করে, মডেল বানিয়ে, তার ওপর একটা সিস্টেম তৈরী করছি, কোড লিখে - আমার যে ভীষণরকমভাবে সেটাকে রিয়েল, আদ্যোপান্ত সত্যি মনে হচ্ছে। অথচ ফেসবুকের মধ্যে যে কোনোরকম রিয়েলিজম পাচ্ছি না। কেউ যে সেখানে সত্যি কথাটা বলছে না। সক্কলে একটা ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের চেইনে, শৃঙ্খলে ঢুকে গেছে মনে হচ্ছে। এই কঠিন কৃত্তিম সত্যিটাকে যে একদম অস্বীকার করতে পারছি না।

তখনই দূরে দেখতে পাচ্ছি একটা কালো রঙের কাঠের চেয়ার, তার ওপর ধবধবে সাদা আলো ফেলা হয়েছে কোথা থেকে যেন, চারপাশে তখন রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে। কালো চেয়ারটায় একটা মূর্তি বসে আছে। কাছে গিয়ে বুঝতে পারছি, বোধ হয় তিনি বাদল সরকার। ওনাকে সহ্য করতে পারছি না, উনি আমাকে বারবার বলে যাচ্ছেন, "এক-দুই-তিন, তিন-দুই-এক", আমি দৌড়ে পালাচ্ছি। এসে পড়ছি একটা টিভির সামনে। সেই টিভিতে আর্জেন্টিনার জার্সিতে মেসি খেলছে, কিংবা খেলতে পারছে না, কারণ বল পাস্ করার মতো কেউ নেই। সেখান থেকেই দূরে শুনতে পাচ্ছি, যেন রেডিও বাজছে, যেমন মামাবাড়িতে সকালবেলায় বাজতো, এখনো বাজে বোধ হয়। কি গান হচ্ছে ওখানে? ছুটে গিয়ে দেখছি এক সুপুরুষ বসে বসে গান বাঁধছেন, পাশে গিটার নিয়ে আমি বসে পড়ছি। বুঝতে পারছি উনি জসিমুদ্দিন, সুর দিচ্ছেন, "জ্বালায়ে চান্দের বাতি, আমি জেগে রব সারা রাতি গো; কব কথা শিশিরের সনে"। দেখছি আকাশে চাঁদ উঠছে, তার রুপোলি আলো পড়ছে নদীর বুকে, গাছের মাথায়। কি ভীষণ নরম হাওয়া আমার মুখে এসে লাগছে ! দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, অনেকে হেঁটে আসছেন আমাদের সুরমূর্ছনায় সঙ্গী হতে, কারা ওরা - চিনতে পারছি না, তবু অবয়বে মনে হচ্ছে, ওদের নামই তো সলিল, সুমন, মার্ক্স্, সত্যজিৎ, নোয়াম, ঋত্ত্বিক, গৌতম, শচীনদেব, পল সাইমন, এবং আরো কত চেনা-শোনা মানুষ। হ্যাঁ, এদেরই তো আমি চিনি। কিন্তু আমার জীবনের চারপাশের কাউকেই যে আর চিনতে পারছি না ! তার থেকেও বড়, তারা যে আমায় চিনতে পারছেন না।

Sunday, May 13, 2018

পশ্চিমবঙ্গ - এবিপি গ্রুপ - পরিবর্তন

কিছু বলছিনা, স্রেফ কিছু ঘটনা তুলে দিচ্ছি। ভাবনাটা পাঠকের দায়িত্ব।

২০০৫ সালে জুন মাসে "ষ্টার আনন্দ" বলে একটি বাংলা খবরের চ্যানেল শুরু হয়। সেই চ্যানেলটির একটি ভাগ থাকে এবিপি গ্রুপের হাতে, বাকিটা থাকে ষ্টার গ্রুপের হাতে। ষ্টার গ্রুপ হল Fox News-এর একটি সাবসিডিয়ারি সংস্থা, যার মালিক হলেন রুপার্ট মার্ডক নামক আমেরিকান businessman. ২০১২ সালে "ষ্টার আনন্দ" নাম বদলে নতুন নাম হয় "এবিপি আনন্দ", কারণ রুপার্ট মার্ডকের ষ্টার গ্রূপ ওই চ্যানেলটি চালাতে আর রাজি হয় না; যদিও ভারতে এখনো অব্দি সবথেকে বেশি লাভবান নিউজগ্রূপ ষ্টার নেটওয়ার্কের। ২০১২-এর পরে, এবিপি গ্রুপ সম্পূর্ণরূপে এবিপি আনন্দকে নিজের আয়ত্তে নেয়। 

এই ঘটনা মাথায় রেখে, আরো কিছু ঘটনা দেখে নেওয়া যাক ২০০৫-২০১২-এর মধ্যে।

২০০৫ - রুপার্ট মার্ডকের ষ্টার গ্রূপ ও এবিপি গোষ্ঠী "ষ্টার আনন্দ" নামক বাংলা ২৪-ঘন্টার নিউজ চ্যানেল তৈরী করে। 
২০০৫ - রিপাবলিকান পার্টির আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে নিউক্লিয়ার চুক্তি করার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। 
২০০৬ - বামপন্থী দলগুলো UPA সরকারকে বলে যে, এই চুক্তি হওয়ার আগে পার্লামেন্টে গভীর আলোচনা করার প্রয়োজন আছে, কারণ এটা ভারতের স্বায়ত্ত্ব শাসন, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার উপর প্রশ্ন তোলে। 
২০০৭ - মনমোহন সিং নিউক্লিয়ার চুক্তি করার জন্য নিজে থেকেই অনেকটা এগিয়ে যান, পার্লামেন্টকে ধোঁয়াশায় রেখে। 
২০০৭-০৮ - পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম হয়। 
২০০৭-০৮ - আনন্দবাজারের আনন্দ-প্রকাশনীর বিশিষ্ঠ লেখকগোষ্ঠী এবং অন্য বুদ্ধিজীবীরা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জন্য পথে নামেন। 
২০০৭-০৮ - আনন্দবাজার, এবিপি আনন্দ-সহ এবিপি গ্রুপের সমস্ত প্রিন্ট ও নিউজ মিডিয়া পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি বলতে থাকে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আনন্দবাজার-গোষ্ঠীর বিশিষ্ঠ লোকেরা সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মিত কথা বলেন। এবিপি আনন্দতে মমতা ব্যানার্জি নিজেও কয়েকবার একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। 
২০০৮ - বামফ্রন্ট কেন্দ্রের UPA-সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেয়, কারণ কংগ্রেস নিউক্লিয়ার চুক্তি সাইন করতে বদ্ধপরিকর ছিল। বামফ্রন্ট এই চুক্তিকে কখনোই স্বীকৃতি দিতে চায় না। 
২০০৮ - UPA তাও পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখে, অন্য দলগুলির সাহায্যে। 
২০০৮ - UPA-সরকার আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে নিউক্লিয়ার চুক্তি সাইন করে। 
২০০৯ - বামফ্রন্ট লোকসভা নির্বাচনে মাত্র ১৫টি আসন পায় পশ্চিমবঙ্গে (আগে ছিল ৩৫টি)। 
২০১১ - বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা হারায়। 
২০১২ - হিলারি ক্লিনটন তার ৩-দিনের ভারত সফরে, পশ্চিমবঙ্গে এসে নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সাথে দেখা করেন। হিলারি ক্লিনটন ছিলেন তখনকার আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেট্। তাঁর আগের সেক্রেটারি অফ স্টেট্ ছিলেন কন্ডোলিজা রাইস, যিনি ভারত এবং আমেরিকার নিউক্লিয়ার চুক্তি সাইন করেছিলেন ২০০৮ সালে।
২০১২ - রুপার্ট মার্ডকের ষ্টার গ্রূপ এবিপির সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার শেষ করে দেয়, ষ্টার আনন্দ বন্ধ হয়ে গিয়ে এবিপি আনন্দ শুরু হয়।

আবারো বলি, কিছু বলছিনা, এগুলো শুধুই ঘটনা, হয়তো শুধুই সমাপতন। কিন্তু ভাবতে পারেন, বা ভাবা প্র্যাকটিস করতে পারেন। 
লাস্ট নোট:  পৃথিবীর মধ্যে এখনো একটি মাত্র দেশই সবথেকে বেশি মাত্রায় অন্য দেশের সরকার বদলেছে, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়, সেটা কখনো সামরিকভাবে, কখনো যুদ্ধের মাধ্যমে, বা কখনো অন্য কিছু উপায়ে। তবে শাসন বদলানোর পরে প্রায় সবকটা দেশেরই অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছে, আর সে ব্যাপারে তারা একদমই care করেনি। 

Saturday, April 14, 2018

বাংলা গানের আধুনিকতা । Modernism in Bengali Songs (~১৩ মিনিট)

বাংলা গানের আধুনিকতা (~ ১৩ মিনিট)
---
ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, উৎপল দত্ত। সংস্কৃতির তিনটে ধারায় এই তিন বাঙালি ঠিক কি বিপজ্জনক কাজটা করেছিলেন, তা ৭০-এর দশক থেকেই মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায়। ওনাদের সৃষ্টির মূলে যে অসন্তোষ, সে ধরণের কাজই আধুনিকতার সংজ্ঞা তৈরী করে, বারবার করেছে, সে আমরা যে যুগেই থাকি না কেন। পৃথিবীর যে কোনো জায়গার যে কোনো আধুনিক শিল্প বেছে নিলেই, এই সাহসী চিন্তাভাবনার ছোঁয়া দেখতে পাবেন। কিন্তু বাঙালির ক্ষেত্রে গত ৭০-৮০ বছর ধরে, সংস্কৃতির আধুনিকতার একটি সমান্তরাল উৎস, অনুপ্রেরণা লক্ষ্য করা যায়। অন্তরে বয়ে যাওয়া সেই আধুনিক সৃষ্টির ফল্গুধারাতেই কি খানিকটা চরা পড়েছে সাম্প্রতিক ইতিহাসে? এখনকার বাংলায় যে শিল্প সৃষ্টি হচ্ছে তা কি "আধুনিক" শিল্পের স্তরে উঠতে পারছে? বা এই শিল্প সমকালীন সমাজ বা অসন্তোষকে কি ধরতে পারছে? নেতিবাচক উত্তরের দিকেই কিন্তু পাল্লা ভারী রাখতে হচ্ছে। আরো বড় প্রশ্ন, যদি সত্যিই সেই আধুনিকতার জোয়ারে চড়া পড়ে থাকে, তার কারণটাই বা কি? এই লেখাতে সেটা খোঁজারই চেষ্টা করবো, তবে শুধুমাত্র সঙ্গীতশিল্প তথা গানের দৃষ্টিভঙ্গিতে। লেখাটা পড়া শুরু করবার আগেই বলে দেওয়া ভালো, আমি এখানে শিল্পকে আমার আধুনিকতার স্তর থেকে দেখছি, যা চারপাশের সমাজের কথা বলে, আবার মানবিকতার কথাও বলে। আধুনিকতার সামান্য অন্য সংজ্ঞাও আছে, তবে আমার সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক গানের কথাই বলতে চাইছি ; সেটা মাথায় রেখেই লেখাটা পড়া কাম্য।

একটু ইতিহাসের খোঁজে যেতে হবে আমাদের। বিংশ শতাব্দীতে বাংলা গানকে মার্গসংগীতের আড়াল থেকে বের করে এনে, রবীন্দ্রনাথ সকলের ঘরে পৌঁছে দিলেন, একান্ত ব্যক্তিগত করে। সেই সুরে রাগাশ্রয়ী সঙ্গীতের আড়ম্বর নেই। ফলে বাংলা গানের সুরের ক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথকে এক বিপ্লব বলতেই হয়। তবে গানের কথার ক্ষেত্রে আমরা পেলাম, আধুনিকতার থেকেও বেশি অন্তরঙ্গতাকে। সেই গানগুলোর চিরন্তন প্রাসঙ্গিকতা, আনুগত্য হয়তো রবীন্দ্রনাথকে চিরআধুনিক করেছে শিল্পের কোনো এক আঙ্গিকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানে সমসাময়িক সমাজকে ধরার চেষ্টা মূলত নেই; এটা অনেকাংশে মেনে নেওয়াই বাঞ্চনীয় বলে মনে হয়। তার থেকে অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, এবং সর্বোপরি কাজী নজরুল ইসলাম - তৎকালীন ভারতবর্ষের দৈন্য অবস্থা, গানের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ ও ধারাবাহিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমরা তাঁদের গানে শুনতে পাচ্ছি সদ্য জন্ম নেওয়া দেশাত্মবোধের ধ্বনি, অনেক বেশি করে। নজরুল "ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম" হয়ে বলছেন "কারার ওই লৌহ কপাট" ভেঙে ফেলার কথা। তখনকার সংগ্রামের বক্তব্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল নজরুলের সুরের বৈচিত্র্য, জটিলতা আর ধার। বিপ্লবের সমার্থক হয়ে উঠছেন নজরুল।

নজরুলের পরে একই ধরণের রাজনৈতিক মানসিকতার আবহে, সঙ্গীতের জগতে আমরা পাচ্ছি সলিল চৌধুরীকে। শুধু সলিলবাবুকে নিয়েও একাধিক প্রবন্ধ লেখা যায়। কিন্তু আমাদের বিষয়ের পরিসরে বললে, উনি বাংলা সংগীতের আধুনিকতাকে যেন নতুন মাত্রা দিলেন। আমার মতে, এখনো অব্দি কোনো বাংলা সুরকার-গীতিকার সলিল চৌধুরীর মতো বাস্তব-সচেতন কাজ করে যেতে পারেননি। সলিল চৌধুরী গান লিখছেন স্বাধীনতার ঠিক প্রাক্কালে, গণনাট্য সংঘ (IPTA)-এর সাথে কাজ করবার সূত্রে। তিনি তার বাংলা গানের সুরের মধ্যে এনে ফেলছেন বেঠোভেন, মোৎজার্টকে। সেটা যেমন নতুনত্ব, তেমনি তার কথায় উঠে আসছে চারপাশের বিপ্লবী আবহ। সলিল চৌধুরীর সুর আর কথা একসঙ্গে মিলে যে অভূতপূর্ব দ্যোতনা তৈরী করছে, তা মিটিং-মিছিলের উত্তেজক মেজাজ তৈরী করে দিচ্ছে। তার গানের কথায় আমরা সরাসরি অনুপ্রেরণা পাচ্ছি, "আহ্বান, শোনো আহ্বান"-এর মধ্য দিয়ে। তিনি আমাদের "আলোর পথযাত্রী" করছেন, ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের শত হতাশার মধ্যেও। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের একত্রিত হতে ডাক দিচ্ছেন, "পথে এবার নামো সাথী।"

কিন্তু ১৯৪০-এ সলিলবাবু তো পরিচিত কোনো মুখ নন। তাহলে তিনি উঠে আসছেন কি ভাবে? আগেই বলেছি গণনাট্য সংঘের সঙ্গীতের ধারা তাকে তুলে আনছে। কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন আন্দোলনের মঞ্চে উনি গান গাইছেন, কখনো কখনো হয়তো শুধুমাত্র একটা হারমোনিয়াম নিয়েই। হাজার হাজার মানুষ উদাত্ত কণ্ঠে একসাথে ওনার গান গাইছে। ওনার গান কিন্তু তখনও রেকর্ড হয়নি, শুধুমাত্র মানুষের কন্ঠ্যে সে গান জীবিত থাকছে। বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আধুনিক শিল্পের এই পৃষ্ঠপোষকতা, শুধু গানে নয়, ছায়াছবি, নাটক, সবেতেই ছিল। ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত এমনকি মানিক বন্দোপাধ্যায় - সকলেই একসময় সক্রিয়ভাবে কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ করেছেন। বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব বাইরের রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে, মহারাষ্ট্রে তখন IPTA-এর হিন্দি নাটক হচ্ছে। বলরাজ সাহানি, পৃথ্বিরাজ কাপুর তার সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। যাই হোক, গানে ফিরে আসা যাক। 

সলিলবাবুর গান ১৯৫০-৬০-এর দশকে রেকর্ড হলো, তার পরেও মানুষকে তৎকালীন সমাজ সম্পর্কে চেতনা যোগাচ্ছে, অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। এর মাঝে যে অন্য ভালো গান হচ্ছে না, তা কিন্ত নয়। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, নচিকেতা ঘোষ - দারুন সব সুর সৃষ্টি করছেন বাংলা ফিল্মে, কিন্তু তাঁরা গানের আধুনিকতাকে ছুঁতে পারছেন না, কথার বন্ধ্যাত্বে। এরপর ১৯৭০-এর টালমাটাল দশক পেরিয়ে আমরা পৌঁছচ্ছি ১৯৮০-এর দশকে। এই সময় একটি আমেরিকা-ফেরত যুবক চেষ্টা করছেন, আবারো বাংলা সংগীতে আধুনিকতার নতুন সংজ্ঞা যোগান দেওয়ার। ১৯৮৬ সালে "তোমাকে চাই"-এর মতো কিছু গান লেখার চেষ্টা করে অসফল হয়ে, আবারো ফিরে আসছেন ৯০-এর দশকে বাংলা সংগীতের খোলনলচে বদলে দিতে।

সুমনের মতো প্রিয়তমকে অভিবাদন জানানোর আগে মনে রাখতে হবে, ৯০-এর দশকের আগেই কিন্তু সুমনের সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশোনা হয়েছে, ৬০-৭০-দশকের নকশাল আন্দোলনে উনি প্রভাবিত হয়েছেন, লাশ বয়ে যেতে দেখেছেন কলকাতার মাঝে খাল দিয়ে। উনি আবারো শিল্প সৃষ্টি করছেন, বাস্তবের মধ্যে থেকেই, কিন্তু তার সাথে এক জীবনদর্শনও তার গানে ধরা পড়ছে। যে দর্শন একসাথে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বলে, শিহরিত হয় "লাল নিশান" দেখে, আবার এই স্বপ্নও দেখে যে "সেনাবাহিনী বন্দুক নয়, গোলাপের তোড়া হাতে কুচকাওয়াজ" করবে। আর এই গানকে প্রথম তুলে ধরছে সিপিএমের রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল। শুভেন্দু মাইতির মতো কমিউনিস্ট আদর্শের মানুষ সুমনকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করছেন, গান গাইবার মঞ্চ তৈরী করে দিচ্ছেন। এরপর ধীরে ধীরে সারা বাংলায় একটু একটু করে, সমস্ত ৯০-এর দশক জুড়ে ঘরে ঘরে আলোচনার বিষয় হয়ে যাচ্ছে, "মরবো দেখে বিশ্ব জুড়ে যৌথ খামার।" মনে রাখতে হবে, তখন সোভিয়েত ভেঙে গেছে, নকশাল আন্দোলন শেষ, কিন্তু তবুও বাঙালি সমাজ-বদলানোর গানকে স্বাদরে গ্রহণ করছে।

২০০০ সালের কিছু আগে, সুমনের পরে বাংলা ব্যান্ডের উত্থান হচ্ছে। সেখানে আমরা নতুন করে পাচ্ছি ৭০-৮০-এর দশকে তৈরী হওয়া কিছু গান, মহীনের ঘোড়াগুলির পৃষ্ঠপোষকতায়। বাংলার সমস্ত বিখ্যাত ব্যান্ডই স্বীকার করে যে, তাদের উত্থানের পিছনে মহীনের ঘোড়াগুলির প্রতিষ্ঠাতা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ই অনুপ্রেরণা। সেই গৌতমবাবু আবার ৭০-এর দশকে কংগ্রেস সরকারের তাড়া খেয়েছেন নকশাল আন্দোলনের জন্য। তাঁর এবং রঞ্জন ঘোষালের গানেও যে "ওরা কাজ করে, গ্রামে বন্দরে, শুধুই ফসল ফলায়, ঘাম ঝরায় মাঠে-প্রান্তরে"- এসবের কথা উঠে আসবে, তা খুব স্বাভাবিক। বাংলা ব্যান্ডের উঠে আসার পিছনেও আমরা একই ধরণের সমাজতান্ত্রিক দর্শনের ছোঁয়া পাচ্ছি। 

এছাড়া সিপিএম পার্টি থেকেও কিছু ক্ষেত্রে (পার্টির স্বার্থেই) আমরা আধুনিক শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা দেখতে পাচ্ছি, আরো বিশেষভাবে নচিকেতার উঠে আসার মাধ্যমে। সুভাষ চক্রবর্তী নচিকেতার গানকে সামনে আনতে সাহায্য করছেন; যদিও সুমনকে রোখার জন্যই নাকি নচিকেতাকে তুলে আনে সিপিএম - এমনটা শোনা যায়। কিন্তু পরে আবার নচিকেতার গান "আমি সরকারি কর্মচারী" - ব্যানও করছে সিপিএমের সরকার। একই কাজ হয়েছে সলিল চৌধুরীর ক্ষেত্রেও। তাঁকেও পার্টির পক্ষ থেকে বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়েছে। কিন্তু এই যে বিকল্প শৈল্পিক ভাবনা গঠন করা এবং তাকে তুলে ধরা - এটা অসংগঠিতভাবে কমিউনিস্ট-ভাবধারার মধ্যে থেকে বাঙালি আত্মস্থ করেছিল। সংগঠিত এবং "রাষ্ট্রীয়" কমিউনিস্ট পার্টি পরে বারবার এই শৈল্পিক ভাবধারার বিরুদ্ধে গেলেও, বাঙালি তাঁর দর্শনটা হারায়নি। কোথাও যেন খুব অন্তরে, বাঙালি সামাজিকতার দর্শনকে লালন করেছে, যে দর্শন সমষ্টির কথা ভাবতে বলে, নিজের স্বার্থের থেকেও বড় উদ্দেশ্যের জন্য। তাই বারবার আধুনিকতার নতুন সংজ্ঞা আমরা পেয়েছি, কখনো তার নাম সুমন, কখনো সলিল, কখনো গৌতম। কোনো একটা উৎস ছিল এই সমসাময়িক এবং আধুনিক শিল্পের বিকাশ ঘটার। 

এবার এখনকার যুগে চলে আসুন। আমাদের সামনে এখন কেন্দ্রীয় সরকারে শুধু নয়, রাজ্যেও খুব বড় ক্রাইসিস। অথচ তার বিপক্ষে সংগীতের তেমন কোনো চলন নেই। ভালো গান হচ্ছে না, তা নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সময়টাকে ধরার বাসনাটা নেই। অথচ এখন YouTube-জাতীয় মিডিয়ামের মধ্যে দিয়ে গানের ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আরো বেশি। কিন্তু সেই ধরণের শিল্পীকে আমরা যেন পাচ্ছি না। দীপাংশু প্যারোডি লিখছেন, বহু মানুষ শুনছেন। এর মানে, মানুষ কিন্তু সরকারের সমালোচনাটা শুনতে চাইছে। কিন্তু সেই শিল্পিত প্রকাশের পরিসরটা যেন কমে গেছে।

আমার মতে, এর একটা বড় দায় সিপিএমেরও। অনেকে ব্যঙ্গ করতে পারেন এই বলে যে, পশ্চিমবঙ্গে সবকিছুর দায়ই তো সিপিএমকেই নিতে হয়। কিন্তু আগে যেভাবে গণসংগীত বা অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে দিয়ে সিপিএম সংস্কৃতিগত আধুনিকতার ধারক ছিল, সেই জায়গাটা সিপিএমের গণসংঠনগুলো হারিয়ে ফেলেছে। ৩৪ বছরের শাসনের জন্য সিপিএমের এই চলমান গতিতেও, মনে হয়, কোথাও যেন জং ধরে গেছিল। তাই একটা খুব বড় শূন্যস্থান তৈরী হচ্ছে, সমসাময়িক এবং আধুনিক শিল্পের।

সেটার আর একটা কারণ হতে পারে বিশ্বায়ন এবং individualism. সমগ্র পৃথিবীতে, এখন সকলেই খুব বেশি করে নিজের ব্যক্তিগত চাহিদা এবং আশাপূরণের কথা ভাবছে। সেখানে সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাভাবনা বড়ই দুর্লভ। বাংলাও এই বিশ্বজুড়ে চলা ট্রেন্ডের বাইরে নয় আর। তাই মানুষের মনে অসন্তোষ থাকলেও তা দানা বাঁধছে না, তা জমে কালো মেঘের গর্জনে পরিণত হচ্ছে না, যে মেঘ চিৎকার করে আহ্বান করতে পারে। যা সলিল করেছিলেন, যা শুনে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। তবে সময় এখনো যে চলে গেছে তা নয়, এই লেখাটার পরেও হয়তো আশার সূর্য আছে। সুমনের গান সকলের সামনে আসতে প্রায় কয়েক বছর সময় লেগে গেছিলো। কে বলতে পারে? হয়তো কোনো নতুন "সুমন", অন্য কোনো নামে, নিজের ঘরে গিটার বাজিয়ে দুঃসাহসী কোনো কথাকে সুরের জ্বালে বাঁধছেন না? অপেক্ষা করছি, আশা করছি, কেউ আবারো জেগে উঠবে, গেয়ে উঠবে:

"যখন প্রশ্ন ওঠে যুদ্ধ কি শান্তি,
আমাদের বেছে নিতে হয় নাকো ভ্রান্তি,
আমরা জবাব দিই শান্তি শান্তি শান্তি।
আর রক্ত নয় নয়!"

Friday, March 23, 2018

Ticking Time Bomb - Part 2 (~১৫ মিনিট)


মার্ক জাকারবার্গ প্রথমে নিজেও মানতে চাননি যে, ফেসবুককে এভাবে অন্য কোনো দেশ নির্বাচনী কৌশলে কাজে লাগাতে পারে। তবে তিনি আঁচ করতে পারছিলেন ফেসবুকের বিশাল manipulating power-টাকে। এমনকি তাঁর নিজের রাষ্ট্রপতি হওয়ার বাসনা তৈরী হয়েছিল, আর তাই জন্যই ২০১৬-১৭-তে তিনি আমেরিকার ৫০টা রাজ্যের মধ্যে অধিকাংশ রাজ্য ঘুরে ফেলেন। আসলে যে দেশে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি হতে পারেন, সেখানে রাষ্ট্রপতি হওয়ার বাসনা সকলের মনেই জন্মায়। আর মার্কের হাতে তো ছিল আমেরিকার প্রায় সকল মানুষ সম্পর্কে খুব বিস্তারিত তথ্যভান্ডার। সিলিকন ভ্যালিতে কানাঘুঁষো শোনা যায়, সেই তথ্যভান্ডার ব্যবহার করেই জাকারবার্গ বুঝেছিলেন যে ট্রাম্পের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হওয়ায় তাঁরও যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। কিন্তু রাশিয়ান গ্রূপের খবর চাউর হওয়ার পর পরই জাকারবার্গ বুঝতে পারেন, ফেসবুকের সাথে যুক্ত থাকা অবস্থায় নির্বাচনের মতো বিষয়ে অংশ নেওয়াটা অসম্ভব। তাই তিনি তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার বাসনা মুলতুবি রেখে ফেসবুকে মনোনিবেশ করেন। তবে এই রাশিয়ানদের কথা জানাজানি হওয়ার পরও নাটকের কিছু অংশ বাকি ছিল।

ফেসবুকের কাছে আছে বিশাল তথ্যভান্ডার, তাতে আছে হাজারো মানুষের হাজারো গতিবিধি-সম্পর্কিত data। এবং এই তথ্য ভীষণ সেনসিটিভ। ফেসবুক জানে আপনি কার সাথে কথা বলছেন, কাকে পছন্দ করছেন। ফেসবুক তার অজান্তেই তৈরী করে ফেলেছে ভয়ানক এবং দুরন্ত একটি মাধ্যম। এই যে বিপুল পরিমাণ তথ্য ফেসবুকের কাছে গচ্ছিত আছে, তা দিয়ে যে ঠিক কি কি করা যেতে পারে, তার আর কোন সীমা নেই। আপনি ফেসবুককে data দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকছেন, কিন্তু আপনার data থেকে আপনার বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন যে প্রভাবিত হতে পারেন, সেটা ভাবেননি হয়তো। বিজ্ঞাপন থেকে নির্বাচন ম্যানিপুলেশন - সমস্ত রকম কাজেই ব্যবহার করা যায় এই data। কিন্তু এই বিপুল তথ্য কি আদৌ সুরক্ষিত?

এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের চলে আসতে হবে 2018-এর মার্চ মাসে। তবে তার আগে বলুন, আপনি ফার্মভিল খেলেছেন ফেসবুকে বা এমন কোনো কুইজ খেলেছেন যেটা বলে দেবে আপনার প্রিয় বন্ধু কে, বা আপনার প্রোফাইল কোন বন্ধু কত বার চেক করেছে - এই ধরণের কিছু? তাহলে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি - এসব আদৌ সুরক্ষিত কিনা সে বিষয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে। কেন? তার জন্য একটি ছোট্ট গল্প জানা দরকার।

কোগান নামের একজন বিজ্ঞানী মনস্তত্ব নিয়ে গবেষণা করছিলেন বিশ্বখ্যাত কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে কয়েক বছর আগে। যারা গবেষণা করেন, তাদের জন্যে ফেসবুক এক ধরণের স্পেশাল অ্যাপ্লিকেশন (app) তৈরি করার পারমিশন দিত। রিসার্চাররা গবেষণার খাতিরে প্রচুর তথ্য ফেসবুক থেকে ডাউনলোড করতে পারেন সেই app-এর মাধ্যমে। তবে শর্ত একটাই, গবেষণা শেষ হওয়ার পরে সব তথ্য মুছে ফেলতে হবে। কোগান তাঁর রিসার্চের জন্য একটি অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেন, ফেসবুকের ভিতরে, অনেকটা ফার্মভিল গেম অ্যাপ্লিকেশন বা ওই কুইজ অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মতো, যেগুলো আপনারা অবসর সময়ে খেলে থাকেন। তিনি একটি নিরীহ প্রশ্নোত্তর app তৈরি করেন। কোগান তাঁর research grant থেকে কিছু টাকাও বরাদ্দ করেন কিছু লোকের জন্য, যারা প্রশ্নগুলোর সম্পূর্ণ উত্তর দেবেন। প্রায় ২,৭০,০০০ জন মানুষ সেই অ্যাপ ব্যবহার করেন।

এই অ্যাপ যখন কেউ ফেসবুকে খেলবে, সে তার নিজের ফেসবুকের data access-এর পারমিশনও দিয়ে থাকে সেই অ্যাপ টিকে। ফলত কোগান শুধু প্রশ্ন আর উত্তর নয়, সব অ্যাপ ব্যবহারকারীর ফেসবুক ডাটা-ও access করতে পারেন। বলা হচ্ছে, কোগান-এর সাথে এই সময়েই যোগাযোগ হয় একটি কোম্পানির, যার নাম Cambridge Analytica. এই কোম্পানিটি বিভিন্ন দেশে ভোটারদের প্রভাবিত করার কাজ করে থাকে, রাজনৈতিক দলগুলোর হয়ে। তারা কোগানের গবেষণার স্বার্থে ডাউনলোড করা ফেসবুক data কিনে নেয়। তবে তারা মাত্র ২৭০, ০০০ জন মানুষেরই data পেয়েছিলেন, তা নয়।

সেই সময়কালে ফেসবুকের সুরক্ষায় আরো গাফিলতি ছিল। কোনো একজন user-এর data-access permission পাওয়া গেলে, তার প্রায় সমস্ত বন্ধুদের অনেক তথ্যই পাওয়া যেত ফেসবুক থেকে। ফলত ২,৭০,০০০ জন মানুষের বন্ধুবান্ধবের নেটওয়ার্ক মিলিয়ে প্রায় ৫ কোটি মানুষের data কোগান ডাউনলোড করে ফেলেন। Cambridge Analytica এই বিপুল তথ্য পাওয়ার পরে, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে খুব সুক্ষভাবে ভোটারদের প্রোফাইল, তাদের রাজনৈতিক পক্ষ সম্পর্কে ধারণা তৈরী করে। এর জন্য তারা সাইকোলজির আর এক প্রফেসরের গবেষণাকেও কাজে লাগায়, যাতে প্রায় নিপুনভাবে বলে দেওয়া যায়, কোন ভোটার মোটামুটি কি রকম ভাবছে। এর পরে যারা swing voter (নিরপেক্ষ অথবা দ্বিধাগ্রস্থ), তাদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া হয় কার্যকরী বিজ্ঞাপন। Cambridge Analytica officially ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইলেকশন ক্যাম্পেইন-এ কাজ করে। আর এর ফল আমাদের সবার প্রাপ্য ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে Cambridge Analytica বলছে, তারা শুধু আমেরিকা নয়, অনেক দেশেই তাঁদের data model-কে কাজে লাগিয়েছে, যেমন ব্রেক্সিটের সময় ব্রেক্সিটের পক্ষে, এমনকি ভারতেও।

নিউজ এজেন্সি চ্যানেল-৪ বলে একটি মিডিয়া এই সব তথ্য ফাঁস করে এই মার্চ মাসে, মাত্র কয়েক দিন আগেই। ফেসবুকের মার্কেট ভ্যালু এর পরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার নিচে নেমে যায় (যদিও শোনা যাচ্ছে, এসব আগে থেকে বুঝে মার্ক জাকারবার্গ তাঁর অংশের শেয়ারগুলি বেচে দিয়েছিলেন কিছুদিন আগে )। এই ঘটনার পরে মার্ক জাকারবার্গ একটি নিরামিষাশী ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। অবশ্য এর থেকে বেশি আর করারও কিছু নেই। কারণ ফেসবুক এই পুরো ঘটনা সম্পর্কে অনেক দিন আগে থেকেই জানতো। তারা নাকি Cambridge Analytica-কে "অনুরোধ"-ও করেছে বারবার data delete করে দেওয়ার জন্য। Cambridge Analytica এখন বলছে যে, তারা সেটা delete করেও দিয়েছেন। এই ছেলেভোলানো কথায় মার্ক ভুলতে পারেন, কিন্তু আপনি ভুলবেন কি? এতো সূক্ষাতিসূক্ষ মানুষের প্রোফাইলিং data কেউ মুছে ফেলবে? ডেমোক্রেসিকে নিয়ন্ত্রণ করার এতো সহজ উপায় হাতছাড়া কেউ করবে?

এই ঘটনায় ফেসবুকের data সুরক্ষা তো প্রশ্নের মুখে পড়েছে বটেই। কিন্তু ফেসবুকের হাতে যে এতো বৃহৎ একটা সম্পদ এসেছে, এর ঠিক ভবিষ্যৎটা কোথায়, আমার মনে হয় সে সম্পর্কেও ভাবার সময় এসেছে। আসলে ফেসবুক নিজেকে ধীরে ধীরে এতটাই বৃহৎ একটি মেশিনারিতে পরিণত করেছে যে, ক্রমশঃ তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করেছে। ফেসবুক শুধু এখন যোগাযোগের মাধ্যম তো নয়ই, এখন ফেসবুক দাঁড়িয়ে আছে মানসিক ব্যবহার ও গতিবিধি সম্পর্কে বিপুল তথ্যের সাগরের মাঝে। এই তথ্যের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকা উচিত? কোন বেসরকারি সংস্থা - ফেসবুকের মত? তাহলে তার অবস্থা তো এরকম হবে, সে তথ্য বেচে দেবে নিজেদের মুনাফার স্বার্থে। তাহলে কি সরকার এই তথ্য নিয়ন্ত্রণ করবে? তাহলে তো সে তার নিজের জনগণকেই ম্যানিপুলেট করতে কাজে লাগাবে এই তথ্যকে? তবে এই তথ্যের সঠিক অধিকারী কার হওয়া উচিত? কোনো নন-প্রফিট, জনগণের একত্রিতভাবে অধিকৃত সমবায় সংস্থার? কিন্তু তার পরিচালন পদ্ধতিই বা কি হবে? এমনকি আরো বড় প্রশ্ন সমাজে ফেসবুকের ভূমিকাটা ঠিক কি হওয়া উচিত?

আমরা কেউই ঠিক জানিনা। ফেসবুক বলেছিলো আমাদেরকে আরো বেশি যুক্ত করবে একে অপরের সাথে। কিন্তু ফেসবুকের filter bubble-এর জেরে, আমরা একে অপরের আরো দূরে সরে গেছি। শুধু পছন্দ করছি যে মতাদর্শগুলো আমাদের মনোপূতঃ। আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে তৈরি করেছি আরো বৈরিতা হিংসা ঘৃণা indifference। ফেসবুক যারা তৈরী করেছিলেন, (মার্ক বাদে) তাঁদের অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন ফেসবুক ছেড়ে দেওয়ার। ফেসবুক সামাজিক ও ব্যক্তিগত মানসিক দিকেও তর্কসাপেক্ষে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এখানে আমরা নিজেদের ইগোকে এক অসম উচ্চতায় নিয়ে চলেছি। অতীতকে পিছনে ফেলে ভবিষ্যতের দিকে সাধারণ অগ্রগতিকে রোধ করে দিয়েছি। মাঝে মাঝেই ফিরে যাচ্ছি অতীতের প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে, যাদের অনেকদিনই ফেলে আসা উচিত ছিল, তারা এখনো পড়ে থাকছে জীবনে। আর এসবের মাঝে ফেসবুক গুঁজে দিচ্ছে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী, রাজনৈতিক সংস্থার প্রোপাগান্ডা। আপনি আপাতভাবে ভাবছেন যে আমার data নিয়ে ফেসবুকের কিছুই করার নেই। অথচ, ফেসবুক তার থেকে ঠিক খুঁজে বের করে নিচ্ছে কোনটা দরকারি। আমাদের সামগ্রিক সামাজিক অগ্রগতির পথে ফেসবুক ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা কেউ জানিনা। তবে এতো বিপুল তথ্যের মালিক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার বিড়ম্বনাটা বোঝা যাচ্ছে।

আর বোঝা যাচ্ছে যে, বোমাটা কিন্তু আমরা তৈরী করে ফেলেছি। ক্রমাগত শান দিয়ে চলেছি সেই বোমায়, যাতে ওটা আরো শক্তিশালী হয়। চীনারা এই বোমাটা এড়াতে পেরেছে, কিন্তু বাকি বিশ্ব এই বোমার মোহতে এগিয়ে চলেছে। আর আমরা সবাই অপেক্ষা করছি এর পরের বিস্ফোরণটা কখন হয়। তবে ম্যাজিকটা এখানেই যে, এই বোমার বিস্ফোরণের তীব্রতা খুব বেশি হয়েও, এটি অতি সুক্ষভাবে মানবসভ্যতাকে আক্রমণ করছে। তাই এই বোমাটা সঠিকভাবে যখন তার ভয়াবহ রূপ দেখিয়ে ফাটবে, তখন আমরা বোধ হয় নিজেদেরকে বোঝার অবস্থাতেও থাকবো না। ঠিক যেমনভাবে আমেরিকানরা পারেননি। স্রেফ অপেক্ষা করে যাবো পরবর্তী বিস্ফোরণটার জন্য।

Ticking Time Bomb - Part 1 (~১১ মিনিট)

চলুন একটা গল্প বলি। গল্পটার বাস্তবতাটা যদিও খানিকটা বেশিই, তবুও এটাকে গল্পের ছলে সামনে আনাই শ্রেয়। সময়গত দিক থেকে সামান্য অবিন্যস্তভাবে গল্পটা বলবো। যারা ক্রিস্টোফার নোলান-এর স্টোরিটেলিং স্টাইলের সাথে পরিচিত, তাদের কাছে এই সময়ের দৌড়াদৌড়ি নস্যি। তবে বাকিরাও সহজে মানিয়ে নিতে পারবেন বলে মনে হয়।

যে সময়কালটা ধরবো, তা মোটামুটি ২০০৪-০৫ থেকে এই ২০১৮-এর মার্চ অব্দি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, বেশ সাম্প্রতিক অতীতের কথা, তাই মাঝে মাঝেই গল্প তার কল্পনার বেড়া পেরিয়ে বাস্তবের আঙিনায় ঢুকে পড়বে। আর আপনারাও তখন আপনাদের বাস্তবের খাড়া-বড়ি-থোড় থেকে কল্পনার থোড়-বড়ি-খাড়ায় ঢুকে পড়বেন। 

প্রথমেই, আমরা ফিরে যাবো ২০০৪-০৫ সালে। এখন ঠিক যেখানে বসে গল্পটা লিখছি, তার খুব কাছাকাছিই এই গল্পের শুরু, খোদ বস্টন শহরে। এই শহরের লক্ষ লক্ষ ছাত্রের মধ্যে থেকে মাত্র ৪-৫ জন ছাত্রের মাথা থেকে বেরোনো এক আইডিয়া, সারা বিশ্বের এক বৃহৎ সংখ্যক মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলে দিল, শুধু ব্যক্তিগত স্তরে নয়, আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক স্তরেও। আপাতভাবে খুব নিরীহ একটি আইডিয়া। কলেজে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের ছবি ও ব্যক্তিগত কিছু তথ্য-সম্বলিত একটি ওয়েবসাইট তৈরী করা হবে। সেই ওয়েবসাইটে এসে যে কেউ তার সহপাঠী বা সহপাঠিনী সম্পর্কে তথ্য জানতে পারবে।

কলেজ চত্ত্বর থেকে বেরিয়ে ২০০৬-০৭ সালে ধীরে ধীরে যখন এই ওয়েবসাইটটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, তখনও তা বেশ নিরীহই। ফেসবুকের কথা তখন বিশ্বের মানুষ সবে জানতে শুরু করেছেন। সকলে তাদের ব্যক্তিগত ভালোলাগা, মতাদর্শ এ সম্পর্কে তথ্য দেওয়া শুরু করেছেন। পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে পেতে শুরু করছেন। আবার যোগাযোগ হয়ে যাচ্ছে পুরোনো স্কুলের হারিয়ে যাওয়া সহপাঠীর সাথে, যার সাথে টিফিনবেলায় ঝগড়া হতো; আর স্কুল ছুটির পরে চুড়ান ও ফুচকা খেয়ে বাড়ি ফেরা হতো। তবে না, নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করা এই লেখার উদ্দ্যেশ্য নয়। তাই বেরিয়ে আসুন, আমরা এবার চলে আসবো ২০১২ সালে। 

সারা দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশে ফেসবুক ছড়িয়ে পড়েছে। ফেসবুক শুধু আর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম নয়, ফেসবুক একটা স্টাইল, খবরাখবর পাওয়ার জায়গা, বিজ্ঞাপনের আস্তানা, আবার গ্রূপে আড্ডা মারার জায়গাও বটে। তার কিছু আগে থেকেই, পশ্চিমবঙ্গেও ফেসবুক গ্রূপে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে ফেসবুক থেকে শুরু হতে থাকলো সংগঠিত আন্দোলন, যেমন Jasmine Revolution। বিভিন্ন মিডিয়া গোষ্ঠী ফেসবুকে তাদের নিউজ দিতে আরম্ভ করলো। ফেসবুক এগিয়ে যেতে থাকলো নতুন দিগন্তের পথে। সোশ্যাল মিডিয়াই শুধু নয়, এক আদ্যন্ত মিডিয়া হয়ে উঠলো ফেসবুক। 

এর পাশাপাশি যেটা হতে থাকলো, বিজ্ঞাপনের স্বার্থে ফেসবুক সংগ্রহ করতে লাগলো আমাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আরও আরও তথ্য। আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কি খাচ্ছেন, কোন ব্র্যান্ডের পোশাক পড়ছেন, কোথা থেকে জামাকাপড় কিনছেন, কি পছন্দ করছেন, কি ভিডিও দেখছেন, কাকে কী বলছেন - সব তথ্য জমানো শুরু করলো। এমনকি আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ ঠিক কি রকম হতে পারে, তা আপনি ফেসবুককে সরাসরি না বললেও, সে আপনার আচার আচরন দেখে মোটামুটি প্রেডিক্ট করতে শুরু করলো। মানুষের ব্যবহার সম্পর্কে এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যভান্ডার - বিশ্ব ইতিহাসে আগে কোথাও কোনও দিন তৈরি হয়নি। ফেসবুকের মধ্যে তৈরী হতে থাকলো World's largest social data bank। এই বিপুল তথ্য ফেসবুক ব্যবহার করে সেই ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপনের জন্য। ফেসবুকের পারদর্শিতা এখানেই যে, সে একদম সঠিকভাবে সঠিক লোককে উপযোগী বিজ্ঞাপনটা দেখাতে পারে, কারণ সে খুব সুক্ষভাবে জানে আপনার পছন্দ ঠিক কোন ধরণের প্রোডাক্ট। এর ফলে ফেসবুকে বিভিন্ন কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিয়ে লাভবানও হল। আপনি বিজ্ঞাপনে দেখা কোম্পানির জিনিস কিনলেন, বা সেই রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে গেলেন। এতক্ষন পর্যন্ত ব্যাপারটা মোটামুটি ঠিকই ছিল। কিন্তু বিজ্ঞাপন কি শুধুমাত্র consumer product-এরই হয়?

এই প্রশ্নের খুব সরাসরি উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের এবার চলে আসতে হবে ঠিক 2016 সালে। আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। সেই সময়কালে ফেসবুকের একজন প্রাক্তন-head লক্ষ্য করলেন, একটি আপাতভাবে-মনে-হওয়া Bernie Sanders-এর প্রচারের পেজ থেকে কিছু অদ্ভুত ধরনের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে ফেসবুকে। মানে যে বিষয়গুলোর বিপক্ষে Bernie Sanders কথা বলেন, ঠিক সেগুলোরই পক্ষে প্রচার করা হচ্ছে, অথচ ওনার স্বপক্ষে প্রচারের পেজ থেকে। পরে বোঝা যায়, কিছু লোকজন মিলে Sanders-এর বিপক্ষে তারই নাম দিয়ে উল্টো প্রচার করছিল। ততদিনে শুরু হয়ে গেছে ফেক নিউজের জমানা। যে নিউজ সত্যি নয়, তাকেই সত্যের মোড়কে জনগণের সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। আর ফেসবুক হয়ে উঠলো সেই ফেক নিউজের মূল কারখানা।

2017-তে জানা যায় আরও একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য, Russian কিছু গ্রুপ ফেসবুকে প্রায় লক্ষাধিক ডলার ব্যয় করে আমেরিকান প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে প্রচারের জন্য।  তারা অন্য প্রার্থীদের বিপক্ষেও প্রচার করেছিল। যে রাষ্ট্রটি এতদিন অন্য দেশের নির্বাচনে নাক গলিয়ে এসেছে, তাদেরই নির্বাচনে তাদেরই দেশের একটি সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে মানুষকে যে ম্যানিপুলেট করা যেতে পারে, এটা অনেকেরই ধর্তব্যের বাইরে ছিল। রাশিয়ান গ্রুপগুলি ফেসবুকের বিজ্ঞাপন-মাধ্যমকে ব্যবহার করে। ফেইসবুকের কাছে যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম data আছে প্রচুর মানুষের সম্পর্কে, সেই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে নিপুন দক্ষতায় ভোটার টার্গেট করা হয়। মানে ধরুন আপনি conservative কোনো ideology-তে বিশ্বাস করেন, তখন আপনাকে দেখানো হয় Republican party-র বিজ্ঞাপন বেশি বেশি করে। বা আপনি যদি দ্বিধাগ্রস্থ অথচ সামান্য-হিন্দু-ঘেঁষা ভোটার হন, তাহলে আপনাকে BJP-এর বিজ্ঞাপন দেখানো হবে। ফলাফল আমরা দেখতেই পাই, 2016 সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু এই গল্প শুধু বিজ্ঞাপনেই শেষ হয় না।

- বাকিটা পরের পার্টে

Monday, February 26, 2018

বামপন্থী বিশ্ব-মানবিকতা ও সচেতনতা

"নিকারাগুয়ায় নিঃসহায় নিম্নবিত্ত নিঃস্ব মানুষদের নিখিরি বানানো চলছে না, চলবে না। গুয়েতেমালায় গণতান্ত্রিক গরীব-গুর্বোদের জোর করে গণধর্ষণ, ওয়াক থু, ওয়াক থু। ... প্রলেতারিয়েতদের পাশে পলিটব্যুরো লড়ছে লড়বে। হনুলুলুতে হারেরেরে হার্মাদদের হুঙ্কারের হামলাবাজিকে, ওয়াক থু, ওয়াক থু।" - ওপেন টি বায়োস্কোপ সিনেমাতে, ঠিক এভাবেই বামপন্থীদের এককালের বিদেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধের স্লোগানগুলোকে উপহাস করা হয়েছিল। বিদ্রুপ করতে গিয়ে সামান্য অতিরঞ্জনের দরকার পড়ে, সেটুকু পরিমাণমতোই ছিল। কিন্তু সিনেমাতে এটা উপহাস হলেও, পরের দিকে এই মনোভাবটাই মেইনস্ট্রিমে উঠে আসে। কলেজে পড়াকালীন বেশি মাত্রায় শুনতে শুরু করি যে, কোনো একটা বাইরের দেশে কি হয়ে গেলো, সেই নিয়ে আমরা কেন মাথা ঘামাবো ! আমাদের চাকরি পেতে হবে, রাজ্যে আরো শিল্প দরকার - এসব না ভেবে, কেন আমরা "আমার নাম, তোমার নাম, ভিয়েতনাম"-এর মতো স্লোগানের পিছনে নিজের সময় ব্যয় করবো !

গত কিছুদিনে সিরিয়ায় বম্বিং-এর তীব্রতা বাড়ায়, দেখলাম অনেক মানুষ নিজেদের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে ভাবছেন। সেখানে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলছেন। অন্তত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এ নিয়ে সক্রিয়তা দেখিয়েছেন, সমবেদনা অনুভব করেছেন। শেষবার কলকাতা গিয়ে দেখে এসেছি, সিপিএম পার্টিটার শেষটুকু চিহ্নও প্রায় আর নেই। খুব আশাব্যঞ্জক অবস্থা ! কিন্তু এককালে পার্টিটার যে মনোভাবকে উপহাস করা হতো, সেই ভাবধারাকে ভিত্তি করেই যে আজ সিরিয়ার যুদ্ধের প্রতিবাদ করতে বলছে খুব সাধারণ মানুষও - সেটাও কম আশাব্যঞ্জক নয় (হয়তো ওটাই একমাত্র আশা)। ওখানে (এবং অন্যান্য জায়গায়) সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির যে শক্তি প্রদর্শন চলছে, তা নিয়ে আগে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো আলাদা আলাদাভাবে মিটিং মিছিল করতো। এখনো হয়তো ছোট করে কোথাও কোথাও হয়। অচিরেই কিছুদিনের মধ্যে সেই ছোট সভাও বন্ধ হয়ে যাবে। তখনও আশা করি, বিশ্বের অন্য কোনো প্রান্তের নিপীড়িত মানুষদের জন্য বাঙালির সহমর্মিতা একইরকম থাকবে। তবে সেই আবেগের সাথে রাজনৈতিক সচেতনতাও যেন থাকে। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের geo-political অবস্থানগুলো বেশ জটিল, সেইটুকু বাস্তববুদ্ধি বাঙালির কাছে প্রত্যাশিত। বিশ্ব-মানবতার সাথে এই সচেতন একাত্মতাই বাঙালিকে বিশ্বের নাগরিক করে তোলে, পৃথিবীর ছবিতে "ব"-লাগানো কোনো লোগো নয়।

Tuesday, January 30, 2018

বিদায় কলকাতা ২০১৮ - Goodbye Kolkata 2018

কলকাতা,

তুমি দেখলাম বেশ সেজে উঠেছ। যদিও জানি এর মধ্যে নীল-সাদা টেন্ডারের রাজনীতি আছে। কিন্তু তা নিয়ে নাহয় বাকি বছরটায় বলবো, এখন নয়। এখন তোমার কল্লোলিনী রূপে মুগ্ধ হওয়ার সময়। যে মুগ্ধতা শুরু হয়েছে কৌশানীতে হোটেল-রুমের ঠিক বাইরেই, পাহাড়ের খাঁজে ভোরের সূর্যকে উঠতে দেখে। সেই সতেজ সূর্যের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছিল, পরিশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলো পৃথিবীর সমস্ত কালিমা। সেই বিশুদ্ধতা তোমার মধ্যে নেই জানি, কলকাতা। তবু আমার চোখে শুভ্রতার ঠুলি পরে শুদ্ধতার রঙে তোমাকে একমাস রাঙাতে এসেছিলাম আমি।

এতে তোমার অনেক কিছুই ওলোটপালোট হয়ে গেলো। একটা ঝোড়ো হাওয়ার ক'দিন ধরে দাপাদাপির পরে এখন তোমার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ভীষণভাবেই এলোমেলো। তবে আমি জানি, তুমি চেয়েই ছিলে এই অবিন্যস্ত কয়েকদিন। তাই বারেবারে আমায় ডেকে বেরিয়েছ তোমার বিভিন্ন দিকে, বুঝিয়ে দিয়েছো নিখাদ ভালোবাসায় কাছে-ডাকা কাকে বলে। সেটা এয়ারপোর্টের কাছে কোনো সাজানো ফ্ল্যাটে হোক, বা আগরপাড়ার কোনো বাড়ির ছাদ, বা ঠাকুরপুকুরের নিশ্চিন্ত গোছানো কোনো নতুন সংসার। শীতকালেও তুমি এই জায়গাগুলোর কোথাও উষ্ণতার অভাব রাখোনি। কিন্তু এতো উষ্ণতার পরেও বুঝিয়ে দিয়েছো, আশঙ্কা যদি কোথাও থাকে, তবে তা টাকা-ছাপানোর জায়গাটির পর পরই শুরু হয়ে যায়। তবে আমি সে ক্লেদ একেবারেই গায়ে মাখিনি।

চার-পাঁচ বছর সাইকেল না চালিয়েও, প্যাডেলে পা পড়লে, মানুষ যেমন ব্যালেন্স করতে প্রধানত ভোলে না, মোটামুটি সোজা সাইকেল চালিয়ে চলে যায়, তোমার কাছে আমার প্রত্যাবর্তন বারেবারেই তাই। তোমার জল-হাওয়ায় আমার সাবলীল অবস্থান; তোমার বিরিয়ানি, চিকেন রোল, লস্যিতে আমার স্বর্গ। সেই তুমিই তৈরী করেছো রঙিন পানীয়ের উন্মত্ত রাত, টোয়েন্টি নাইনের পরের পর গেম বা একসাথে চারজন ছায়ামূর্তির নির্ভেজাল আড্ডা। তখন তুমি আর জব চার্ণক বা সাবর্ণ রায়চৌধুরীর টেনে দেওয়া কোনো ভৌগোলিক সীমানা নয়, তুমি তখন সমস্ত বাস্তবিকতা ছাড়িয়ে কুর্গ, নৈনীতাল বা বকখালীতে ছড়িয়ে গেছো। আমাদের বাড়িতেও তুমি এসেছো প্রচুর আত্মীয়ের সমাগমে, নিখাদ আনন্দের অবসরে। অথবা একান্তে তোমার আঁচলের তলায় গিটারের ঝর্ণা ও মা-এর গান শোনা গেছে। তুমিই বুঝিয়ে দিয়েছো ভাইয়ের ভালোবাসার মানে খোঁচা-মারা, দাদুর ভালোবাসার মানে এমন এক আলিঙ্গন, যার গভীরতা আজ পর্যন্ত কোনো আলিঙ্গন এনে দিতে পারেনি, পারবেনা। তুমিই আমার ছয় বছরের পুরোনো বন্ধুতার অক্ষত অবয়ব। তুমি আমার গানের জগৎ, তুমিই আমার সত্যিকারের বেঁচে থাকা।

কলকাতা, তুমি আমাকে ভাস্কর চক্রবর্তীর শব্দচয়নে সামান্য উল্টো প্রশ্ন করতে শিখিয়েছো। তাই আমি শীতকালকে প্রশ্ন করেছিলাম, সুপর্ণা কবে আসবে। জানো কলকাতা, সুপর্ণা এসে তোমাকে নতুনভাবে তৈরী করে দিয়েছে, পার্ক সার্কাস থেকে ঢাকুরিয়া ব্রিজ হয়ে, সল্টলেক থেকে মোহরকুঞ্জের ফুলের বাগান ছুঁয়ে। সেই ছোঁয়ায় তৈরী রয়েছে সুন্দর অথচ অজানা ভবিষ্যৎ-এর স্বপ্নের কুঁড়ি। সেই স্বপ্নকে তুমি কি অমলিন করে রাখতে পারবে, কলকাতা? সময়মতো জল, বাতাস, রোদ দিয়ে? তোমার কাছে বারবার ফিরে এসে তো আমি শান্তি পাই যে, দুনিয়ার দ্রুত বদলে যাওয়া রুক্ষ মানচিত্রে তুমি চিরকাল তোমার শ্যামলিমাময়, শহুরে অথচ শালবনের জংলী মত্ত রূপ ধরে রাখবে। যদিও তুমি আমার অস্থাবরগুলো চিরকাল ধরে রাখতে পারোনি, কিন্তু তোমার ওপর আমি এখনো বিশ্বাস রাখি, কলকাতা। কষ্ট পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনাতেও ঝুঁকি নিই। তাই তোমার কাছে আমি আবারও ছেড়ে যাচ্ছি ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি, ফেলে যাচ্ছি না। তুমি গচ্ছিত রেখো কলকাতা। তোমার ওপর আমার আস্থা আছে। তোমার কাছে ভালোবাসা ফিকে হয় না। তোমার চোখে, নাকে, গালে, কাঁধে, মুখে, ঠোঁটে আমাকে ছড়িয়ে যেতে দিও। দেখবে সময় কাটতে না কাটতেই আমি আবার তোমার কাছে ফিরে আসবো।

Tuesday, January 16, 2018

প্রশান্তি - Pacificity

"বোবা টানেল"-গানটার দু' লাইনের মানে জিজ্ঞেস করেছিল একবার এক বন্ধু (যার নামের মানে সমুদ্র)। "কার সাথে বলো শব্দ ছুঁড়ে ফিরবো বাড়ী মাঝরাতে, আমি তোমার কথা বলবো কাকে?" তখন কিছু একটা অর্থ বলেছিলাম। আজ আর একবার কিছু বলি।

ধরুন গোলপার্ক, দুজনকে দেখতে পাচ্ছেন, ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটি ছেলে আর মেয়ে, হাত ধরে। কখনো একে অপরকে দেখছে। ওপরে হলুদ আর সাদা স্ট্রিটলাইটের আলো। চারপাশের দোকানগুলো থেকেও টিউবলাইটের আলো হালকাভাবে এসে পড়ছে ওদের দুজনের মুখে।

এরপর বাস এসে গেলো। বাসটা একটু আগে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। দুটো হাত তখন দেখছেন, ছেড়ে যাচ্ছে, আলাদা হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি বাসের দিকে দৌড়ে গেলো, উঠে পড়লো। বাসটা মিলিয়ে গেলো দূরের অন্ধকারে। ছেলেটি এর পর হেঁটে যাচ্ছে গড়িয়াহাটের দিকে। গানের ওই লাইনগুলো তখন বেজে উঠছে ছেলেটির মাথায়। গানটার অন্য লাইনগুলো অপ্রয়োজনীয়। সাথে ছেলেটার মনে বয়ে আসছে একরাশ অনুভূতি। ছেলেটার তখন মেয়েটার জন্য "শান্তি পায়, বুকের ভিতর পায়রা ওড়ার শব্দ পায়, ওর চোখের দিকে তাকালে কিসের যেন ডাক শুনতে পায়।" এরপর দেখা যাচ্ছে, ফুটপাথ ও রাস্তায় যে সব লোকেদের আর গাড়িঘোড়ার ভিড় ছিল, তা সব উধাও হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। গড়িয়াহাটের চারদিক শুনশান হয়ে গেছে। শুধু হলুদ স্ট্রিটলাইটের আলো। কেমন যেন মাঝরাত নেমে এসেছে। ছেলেটার তখন আর কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। প্রশান্তি ছেয়ে গেছে তার মনে।

Monday, January 08, 2018

ময়ূরাক্ষী - Movie Opinion

ম্যাসাঞ্জোর গেছিলাম একবার। ওরকম শান্ত, ধীর-স্থির জল যে নদীর হতে পারে, তা দেখে বেশ অবাকই লেগেছিল। নদীর বহমানতা থমকে গিয়ে সে সেখানে মানুষের হাতে বশবর্তী। কিন্তু সেই নদীই বর্ষাকালে গ্রামের পর গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। মনে হয়, বাঁধা পড়ে থাকতে থাকতে ময়ূরাক্ষীর মনে জমতে থাকা কথাগুলো যে ভীষণ বেদনা তৈরী করে, তার জেরেই প্রবল বেগে স্রোত আসে বৃষ্টি হলে। আমাদের সম্পর্কগুলোও যেমন ভেসে যায় না-বলতে-পারা অভিমানের আঘাতে।

কোনো সিনেমা যখন ব্যক্তিগত জীবনের সাথে মিশে যায়, তখন তা মনের বেশি কাছের হয়ে যায়। কিছু সিনেমা আমাদের ব্যক্তিগত আশার প্রতিফলন ঘটায়, আবার কিছু সিনেমা আমাদের জীবনের উপেক্ষিত দিকগুলোকে সামনে এনে দেয়। "ময়ূরাক্ষী" দ্বিতীয় ধরণের অনুভূতিকে সামনে আনলো। সিনেমা শুরু হওয়ার পরে, অতনুবাবু প্রথম যখন সৌমিত্রবাবুর চশমার ক্যামেরায় ফোকাস করলেন আর ক্যামেরা ফলো করলো সেই চশমাকে, যা সৌমিত্রবাবুর হাত থেকে তুলে নিয়ে প্রসেনজিৎ আলতো করে রাখলেন টেবিলে, সেই তখন থেকেই ঢুকে পড়লাম ফিল্মের একদম ভিতরে। ওই ফোকাসটাই সিনেমা হল থেকে আমাদের নিয়ে গিয়ে ফেললো, সুশোভন (সৌমিত্র) আর আর্যনীল (প্রসেনজিৎ)-এর জীবনে, দ্বন্দ্বে ও সমস্যায়।

যদিও সিনেমায় অনেকগুলো চরিত্রের জীবন একসাথে চলছে, যেমন বাস্তবেও চলে, কিন্তু বারবারই (অতনুবাবুর কারগরিতে) আমরা ঢুকে পড়লাম সৌমিত্রের চোখ আর ঠোঁটের যন্ত্রনায়। একজন প্রফেসরের প্রগলভতা, পান্ডিত্য পেরিয়ে এসে জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি অশীতিপর, কিন্তু তবুও তাঁর তীক্ষ্নতা হারিয়ে যাচ্ছে না। এমন বিবিধ অভিজ্ঞতার মিশেলকে স্তরে স্তরে মূলত মুখের মধ্যে ফুটিয়ে তোলার মতো অভিনেতা ভূ-ভারতে আছেন কিনা জানিনা। যদিও থাকেন, সৌমিত্রবাবুর এই কাজটা করে ফেলার পর অন্য কারোর দরকার পড়ে না। উনি যখন ক্যাফেতে বসে কফি খেতে খেতে যৌবনের সংগীত রচনা করছেন, তখন উনি আর ৮৪ বছরের বৃদ্ধ নেই, একজন যুবক সংগীত নির্দেশক হয়ে উঠেছেন। আবার যখন কারোর মৃত্যুসংবাদ ওনার মধ্যে বিহ্ববলতা সৃষ্টি করছেন, তখন তাঁর চোখে শূন্যতা। আমার মনে হয় না, সৌমিত্রবাবু ওনার যুবক বয়সের কোনো ফিল্মেই অভিনয়ের এই দ্যোতনা সৃষ্টি করতে পেরেছেন।

এই ধরণের একজনের পাশে কাজ করাটাই ভীষণ মুশকিলের। প্রসেনজিতবাবুকে দেখে মনে হয়েছে, উনি চেষ্টা করেছেন এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে। অনেক জায়গাতেই তাঁকে এই কারণেই বেশ সাবলীল লেগেছে, কিন্তু কিছু জায়গায় মনে হয়েছে মেকী। যেমন সৌমিত্রবাবু যখন প্রসেঞ্জিতবাবুর মন-খারাপের কথা প্রেডিক্ট করলেন, সেই জায়গায়। আবার বাবার পাশে না থাকতে পারা বা জীবনের বিভিন্ন অপূর্ণতা, ব্যর্থতা মাঝে মাঝেই ওনার চোখে দেখে যেন ভীষণ স্পষ্ট। এছাড়াও আশেপাশের অভিনেতাদের ভীষণই ইন্টিগ্রেটেড লেগেছে সিনেমার সিচুয়েশনের সাথে। Sudiptaa Chakraborty যেভাবে একজন স্রেফ পরিচারিকা হয়ে রয়েছেন, যেন অন্তরালের উপস্থিতি, অথচ কি প্রবল। আমরা দর্শকরাও যেন আস্বস্ত হই, যে সুদীপ্তা যদি থাকেন, সৌমিত্রবাবু ভালো থাকবেন। অবশ্যই এখানে চিত্রনাট্যের সাপোর্ট আছে, কিন্তু অভিনেতারা সেটাকে যথাযত স্তরে তুলে আনতে পেরেছেন। প্রসেনজিৎ, সুদীপ্তা, গার্গী, ইন্দ্রানী - এদের সকলকেই ধন্যবাদ।

অতনুবাবুর এই আলাদা ধরণের মুহূর্তগুলোকে উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। যদিও উনি এভাবেই আমাদের ভালো কিছু ছবি উপহার আগেও দিয়েছেন। উনি, কৌশিক গাঙ্গুলি, প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য, ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরি - এরা আছেন বলে, আশা করি ভালো বাংলা সিনেমা ঠিক থাকবে। অতনুবাবু যেভাবে ধীরে ধীরে সিনেমাটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, যেভাবে পুরোনো স্মৃতির রেফারেন্স টেনেছেন বিকিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গে, যেভাবে আমেরিকা-ফেরত বাঙালিকে গ্রাউন্ডেড রেখেও সুক্ষ distinction রেখেছেন, তার উদ্দেশ্যে শুধু প্রশংসাই হয়। ময়ূরাক্ষীর দ্বৈত চরিত্রকে নৈপুণ্যের সাথে পর্দায় আনার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তবে উনিও বোধ হয় বুঝেছিলেন, যে এতগুলো ক্লোস শটের একটা ফিল্মে সৌমিত্রবাবুর মতো দক্ষ অভিনেতা ভীষণ প্রয়োজনীয়, indispensable বলা উচিত। শুধু কখনো কখনো মনে হয়েছে, shot reverse shot-গুলোতে একেকটা শটের দৈর্ঘ্য খানিকটা কম হয়ে ক্যামেরাটা মুখে আর একটু ধরলে হয়তো বেটার হতো; কিন্তু আমার মতো সিনেমা-অশিক্ষিতের এ ব্যাপারে পরামর্শের অধিকার নেই। তাই এটা কেবলই মতামত। যেমন আর একটা মতামত সিনেমার শেষটা নিয়ে। ইন্টারমিশনেই ভাবছিলাম এই সিনেমার conclusion-টানা বেশ কষ্টকর। অতনুবাবু খুব একটা খারাপ করেননি কাজটা, কিন্তু আরো দক্ষ কিছু কি হতে পারতো? কিছু মেটাফোরের মাধ্যমে, শুধুমাত্র নতুন প্রজন্মকে জানলার বাইরে দিয়ে দুনিয়া দেখানো ছাড়া? জানিনা, কোথাও মনে হয়েছে, হলে মন্দ হতো না, কিন্তু এটাও মনের কাছেই থাকবে।

অসংখ্য ধন্যবাদ Atanuবাবুকে এরকম একটা movie-এর জন্য। আর বিশেষ ধন্যবাদ, Soumitra Chattopadhyay-এর এমন অভিনয়কে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এবং এটাকে ডকুমেন্ট করে রাখার জন্য। ময়ূরাক্ষী শান্ত আর প্রবল, তার দুই চরিত্র নিয়েই আমাদের মনে থাকুক!