কলকাতা - প্রাক্তন ব্রিটিশ রাজধানী। এই শহরের একটা বিশেষ চরিত্র যদি হয় এর নস্টালজিয়া, মিষ্টত্ব - এসব কোমলতায় মোড়া বিশেষণগুলি - তাহলে অন্য চরিত্রটি এর অন্তর্দ্বন্দ্ব। যে কোনো আধুনিকতাতে দ্বন্দ্বের অবতারণা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক, আধুনিক শিল্পের একটা বড় মূলধন এই টানাপোড়েনটাই; আর ব্রিটিশ রাজধানী হওয়ার আগে থেকেই, মূলত সম্পদের বৈভবের কারণে কলকাতায় আধুনিকতার পরশ লেগেছিলো। ব্রিটিশরা এসে ঘাঁটি গেঁড়ে বসার পর সেই আধুনিকতা অন্য মাত্রা পায়। ব্রিটিশদের মাতৃভাষার প্রতি বাঙালীদের সেই তখন থেকেই ঈর্ষা। ব্রিটিশদের সম্পদের প্রাচুর্য এবং শাসক-চরিত্র সেই ইংরিজি ভাষা-প্রীতিকে আরো জোরদার করে। আবার বাংলা ভাষার প্রতিও বাঙালীর স্বাভাবিক টান, ফলত জন্ম হয় এক চিরকালীন দ্বন্দ্বের।
কলকাতায় বরাবরই ইংরেজি বলিয়ে লোকেদের বেশি মান্যগন্য করা হয়ে আসছে। স্বাধীনতার আগে ভারতের প্রদেশগুলোতে যখন নির্বাচনে-জেতা নেতারা বিধানসভায় বক্তব্য রাখতেন, তখন বাংলার বেশিরভাগ প্রতিনিধি ইংরেজিতে বক্তব্য পেশ করতেন। এতে করে তাঁদের একটা সম্মানীয় স্থান পেতে সুবিধে হত, অন্যেরা তাঁদের মন্তব্যকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন। এই ইংরিজি কতৃত্বকে কিছুটা আটকে রেখেছিল - ঢাকা-কেন্দ্রিক বাংলা। যার জন্য যখন ১৯৩৭-এর নির্বাচনে ইংরেজদের বিভাজনের সুযোগে অনেক সাধারণ, খেটে-খাওয়া মুসলমান বাংলার নির্বাচনে জিতলেন, তখন তাঁরা বাংলায় বক্তব্য পেশ করতে শুরু করলেন বিধানসভায়। সেই সময় যে গুটিকতক হিন্দু বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরা সেই বাংলায়-রাখা বক্তব্যে কিছুটা প্রভাবিত হয়ে বাংলা বলার চেষ্টা করেন, নিজেদের চিরাচরিত ইংরিজি ছেড়ে। সুতরাং বাংলা নিয়ে নাক সিঁটকানো ভাবটা বেশ পুরোনো, এবং এর উৎসটা কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু সম্প্রদায় থেকে আসা। এনাদের বেশিরভাগই তখনকার জমিদার, ব্যবসায়ী এবং উচ্চবর্ণ ছিলেন। এই ইংরিজি ভালোবাসার সুফল স্বরূপ প্রথম নন-ইউরোপীয়ান নোবেলটাও কলকাতাবাসী এক সাহিত্যিকের ঝুলিতে আসে। তবে সে যুগে ইংরিজি ভালোবাসার সাথে বাংলাকে অবহেলা ব্যাপারটা পুরোপুরি সমার্থক হয়ে ওঠেনি।
আধুনিক ইতিহাসেও কলকাতাকেন্দ্রিক এই উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা ইংরিজির পদলেহন করা বন্ধ করেননি। সেখানেও লুকিয়ে আছে কলকাতার চিরস্থায়ী অন্তর্দ্বন্দ্ব। সেই প্রসঙ্গে ঢোকার আগে বলতে হবে, ২০১৭ সালে একটি বিতর্কে চন্দ্রিল ভট্টাচার্য্যের বক্তব্যের কথা, যা কিনা সম্প্রতি নতুন করে প্রচার পেয়েছে (এবং এই লেখাটার একটা অনুঘটক)। উনি সেখানে বাংলা ভাষার দুরবস্থা প্রসঙ্গে বলছেন যে, "উচ্চকোটির বাঙালী" বাংলা ভাষাকে বর্জন করার জন্যই আজকে বাংলা ভাষার এই করুন পরিস্থিতি। লোকে বাংলা বলতে ভুলে যাচ্ছেন, বাংলায় ভাবতে বন্ধ করছেন। দরকার হলে ভিডিওটা দেখে নেওয়া যেতে পারে, তবে ছোট করে বললে মূল বক্তব্য এটাই। কিন্তু আধুনিক ইতিহাসে বাংলাকে পিছনে ফেলে দেওয়ার ন্যারেটিভটি তৈরী করেছিলেন কারা? - সেই অনুসন্ধানেই দ্বন্দ্ব ধরা পড়ে।
বামফ্রন্ট সরকার মাঝখানে কিছু বছরের জন্য সরকারি স্কুলে প্রাথমিকে ইংরিজি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ গ্রামাঞ্চলে অনেক প্রথম জেনারেশনের শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসছিল না, সঠিক ইংরিজি শিক্ষকেরও অভাব ছিল। কিছু বছর পরেই যদিও আবার ইংরিজি চালু করা হয়, সারা ভারতের আগেই। কিন্তু সেই সময় ইংরিজি তুলে দেওয়া নিয়ে তীব্র বিক্ষোভ হয়। এই বিক্ষোভের মূল বক্তব্য ছিল, ইংরিজি না শিখলে উচ্চপদে চাকরি, উচ্চশিক্ষা সম্ভব নয়। এই বিক্ষোভ যে গোষ্ঠীগুলো থেকে উঠে আসে - চন্দ্রিলবাবু তার প্রায় প্রত্যেকটারই অন্তগর্ত - কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চবর্ণ (মূলত ব্রাহ্মণ), "বাবু"-সম্প্রদায়, প্রতিষ্ঠিত ধনী মানুষেরা এবং আনন্দবাজার গোষ্ঠী। অথচ পরবর্তীকালে দেখা গেছে যে ইংরিজি তুলে নেওয়ার কোনো প্রভাবই প্রায় পড়েনি। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসা থেকে যাওয়ার মাঝে পশ্চিমবঙ্গে সাক্ষরতার হারে প্রায় ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। দেশের বড় বড় IIT-গুলিতে বাঙালী প্রফেসরের আধিক্য দেখা গেছে। কিন্তু সেই ন্যারেটিভটা থেকে গেছে - ইংরিজি ছাড়া উচ্চশিক্ষিত বা সম্ভ্রান্ত হওয়া যায় না। খুব কম সংখ্যকই বলেছেন, উচ্চপদের পরীক্ষাগুলোতে বা উচ্চশিক্ষায় আরো মাতৃভাষার ব্যবহার প্রয়োজন।
চন্দ্রিল নিজে হুতোমের গুণগ্রাহী এবং হুতোমের লেখনীর ঘরানার লেখক। হুতোম নিজে কলকাতার বাবু-সম্প্রদায়ের অন্তগর্ত হয়েও সেই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বগুলিকে তাঁর লেখা নকশায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। চন্দ্রিল সেই একই কাজ করে থাকেন, আধুনিক মধ্যবিত্ত বাঙালীর ক্ষেত্রে। কিন্তু তাঁর নিজের তর্কের মধ্যেও এই দ্বন্দ্বের পরিসর আছে। তবে যেটা প্রথমে বলেছিলাম, এই দ্বন্দ্ব চন্দ্রিলবাবুর শুধু নয়, কলকাতাকেন্দ্রিক সমাজের একটা অঙ্গাঙ্গী সত্তা হল এই দ্বন্দ্ব। যে কারণে এখনও বলা হয়ে থাকে, ইংরিজি-শিক্ষা শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অথচ ভারতের প্রায় কোনো প্রদেশ থেকেই এই ধরণের বক্তব্যকে আগে তুলে আনা হয়নি। আগে অনেক রাজ্যেই ইংরিজি তুলে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কেউ অভিযোগ করে থাকেনা, যেভাবে বাঙালী করে থাকে। না ভুল বললাম, এমনকি গ্রামবাংলাও এই অভিযোগ করে না। শুধুমাত্র কলকাতাকেন্দ্রিক এলিট সমাজের এই অভিযোগ থেকে যায়। বিভিন্ন ইউরোপীয়ান দেশগুলি, জাপান - এরা সকলেই নিজেদের মাতৃভাষাকে উদযাপন করেন, ব্যতিক্রম কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালী ভদ্রসমাজ।
যতদিন না কলকাতা তাঁর এই দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারবে, ততদিন কলকাতার উপর বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ না ছাড়াই ভালো। বাংলা বরং অনেক বেশি নির্ভরশীল কলকাতার বাইরে তার কতটা সমাদর তার ওপর। কারণ বাংলাকে কলকাতা কোনোদিনই তাঁর সঠিক মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেনি, আর অদূর ভবিষ্যতেও করবে বলে আশা করিনা। কলকাতার বাংলার অনিবার্য পরিণতি, "I तो বিরিয়ানি খেতে ভীষণ love করি।"
No comments:
Post a Comment