ভীষণ গোলাপী মতন হয়ে আকাশের গায়ে সন্ধ্যের ছায়া পড়তে শুরু করেছে। বোম্বে রোড ধরে চলে এসে কিছুক্ষনের ভিতরেই কলকাতাকে পেরোনো হয়ে গেছে। সেখানকার মেকী মনুষ্যত্ব, নাক-উঁচু স্বভাব গা থেকে ঝরে গেছে। মাটির কাছাকাছি, খুব খুব কাছাকাছি যাওয়া হচ্ছে। আকাশ গোলাপী রঙে সেজে উঠে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। যে নদীকে একটু আগেই অচেনা মহিলা লেগেছিল, এখন সে যেন কত চেনা পুরনো বান্ধবী। এইভাবে শ্রান্ত সন্ধ্যের মাঝে ওর সাথে বসে থাকতে থাকতে, হয়তো এই পুরনো বান্ধবীর প্রেমে পড়বো। এরই তো প্রেমে পড়া যায়। কি হবে আর বন্ধুত্বের দূরত্ব রেখে! ওই তো, একটা নৌকো দেখা যাচ্ছে। ওতে করে বেরিয়ে পড়ছি দুজনে মিলে। এরই মধ্যে, ভাটিয়ালি গান শুরু হয়েছে। মাঝিভাই এক প্রান্তে বসে গানের ভেলায় দাঁড় বাইছেন। আমি আর নদী একদিকে শুয়ে আছি, পাশাপাশি। অকূল দরিয়ার গান শুনতে শুনতে উপরে দেখছি, কিভাবে তারারা একের পর এক কালো হতে থাকা আকাশের প্রান্তরে অবিন্যস্ত ভাবে দাঁড়াচ্ছে। এরই মাঝে আমার সদ্য হওয়া প্রেমিকা নদী গেয়ে উঠছে, "মাঝি তোর নাম জানিনা, আমি ডাক দিমু কারে, মন তরে কেবা পার করে"। এত বেদনা, কিন্তু তার মধ্যেও জীবনতরী বেয়ে চলার কি ভীষণ আর্তি! নদীর কণ্ঠ্যে যে কি আছে! দেহে শিহরণ হচ্ছে, কিন্তু চোখে জল, ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নদীকে জিজ্ঞাসা করতে গেলাম, "মেঘে ঢাকা তারাতে এই গানটা..."। নদী গান থামাল না, সদর্থক মাথা নাড়লো। আকাশ থেকে দূরে পাড়ের দিকে চোখ নেমে এলো, ছোট্ট ঘুপচির ভিতর টিমটিমে হলদে বাল্ব গুলো জ্বলে উঠছে, একের পর এক। কেউ হয়তো তুলসিতলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ দিচ্ছে, আজান শেষে কেউ ঘরে ফিরছে। শাঁখ বাজলেও শব্দ এসে পৌঁছায় না নদীর মাঝখানে।
আচ্ছা নদী, ওপারে যাওয়া যায় না? - আমার কৌতুহল। নদী বলছে, "আমি তো যাই। আমার তো তোমাদের মতন বাঁধন নেই। আমি স্বাধীন।" - নদীর মুখে মৃদু হাসির স্রোত খেলে গেল। কিন্তু সেই স্রোতই আমার মনের ভিতর কি ভীষণ রকম মোচড় দিচ্ছে। এতগুলো মানুষকে একটা পেনের আঁচড়ে ঘর ছাড়া করে দেওয়া হল, আলাদা করে ভেঙে দেওয়া হল। চাইলেও আর যাওয়া যাবে না, শুধু হয়তো কিছু ঘুপচির ক্ষীণ, শান্ত, নিরস্ত্র আলো দেখা যাবে, এপার থেকে। তবু যেতে আমাকে হবেই; তাই উপায় বের করে নদীর দেহে ডুব দিচ্ছি আমি, নদীর সাথে মিশে যেতে। তখন তো আর কোনো বাধা থাকবে না। নদী তো আমার প্রেমিকা, আমাকে নিশ্চই ফিরিয়ে দেবে না। দিচ্ছেও না, ডুবে যাচ্ছি আমি। মুক্তি হচ্ছে আমার, দেশীয় বাধা, বন্ধন, পার্থিব শৃঙ্খল থেকে মুক্তি, কি ভীষণ আনন্দ, কি দারুন পরিতৃপ্তি! কি মিঠা জল, কি শীতল, কি স্নিগ্ধ! আমি বুঝতে পারছি, আমার মৃত্যু হচ্ছে, আরো গভীরে চলে যাচ্ছি নদীর, কিন্তু কোন কষ্ট হচ্ছে না। সমস্ত দুঃখ আমাকে, এই প্রথম বোধ হয়, ছেড়ে চলে যাচ্ছে। গলার কাছে বিশালাকৃতির দলাটা নেমে যাচ্ছে। কিন্তু নিশ্বাস নিতে পারছি না যে! দমটাই শুধু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জৈবিক বাস্তবতা আঁকড়ে ধরছে আমায়। কেউ আমাকে একটু অক্সিজেন দিন না, দাদা একটু অক্সিজেন? - আমি ভিক্ষা চাইছি। কিন্তু কেউ যে নেই নদীতে, সকলে কোনো না কোনো পাড়ে ঠাঁই নিয়েছে, কাউকে পাচ্ছি না। দাদা একটু কেউ সাহায্য করুন না, প্লিজ। দাদা আমি যে বাঁচতে চেয়েছিলাম, দাদা আ আ আ আ আ....
উঠে বসলাম, হাঁপাচ্ছি, ভীষণ ভয় করছে, চারিদিক অন্ধকার, শুধু বিছানার একটা কোণে রিডিং ল্যাম্পের আলোটা তাক করা আছে। চারিদিক অন্ধকারের ভিতরে, বিছানায় রাখা বুকমার্ক করা বইটার ওপর ল্যাম্পের আলোটা পড়ে, বইটার নামটা যেন একটু বেশি জ্বলজ্বল করছে, "পূর্ব-পশ্চিম" - আমাদের অবশিষ্ট আইডেন্টিটি।
No comments:
Post a Comment