ভাবনাগুলোকে অক্ষরে চালান করতে করতে বুঝতে পারছি এগুলো মূলত নোটস। সেরকমই শিল্প আর তার আধুনিকতা নিয়ে বহুদিন ধরেই মনের মধ্যে ভাবনার অযাচিত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। তা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে বেশ ক্লান্ত। এ নিয়ে বেশ কয়েকজনের সাথে অনেক বার আলোচনাও হয়েছে। এবার বোধ হোয় এই ভার নামিয়ে রাখার সময় হয়েছে, সুতরাং লিখন।
শিল্পকে এক হাজার ফুট উঁচু থেকে মূলত দুই ধারায় ভাগ করে নেওয়া যায় - ক্লাসিকাল আর মডার্ন। ক্লাসিকাল এর কথায় পরে আসছি। আধুনিক এর কথা দিয়ে শুরু করি, খুব সাবজেক্টিভ একটা ব্যাপার। বাংলা গানের আধুনিকতা নিয়ে লেখাটায় বলেছিলাম যে, সমসাময়িকতা আমার কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা বয়ে আনে। তাই সলিল চৌধুরী যখন কৃষকদের জমির অধিকারে স্বাধীনতার পরেই "হেই সামালো ধান" লিখছেন, আমার কাছে উনি ভীষণ আধুনিক হওয়ে উঠছেন। বব ডিলান যখন বিশ্বের নাগরিক অধিকারের জন্য, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লিখছেন, "টাইমস দে আর চেঞ্জিং", তিনি আমার কাছে ভীষণ পরিমাণে "আধুনিক"। আমি প্রধানত আধুনিক শিল্পকেই ভালোবাসি। ক্লাসিকাল এর প্রতি আমার তেমন আসক্তি নেই।
ক্লাসিকালকে এ হেন বুড়ো আঙুল যখন দেখাচ্ছি, তখন তার পিছনে অনেকগুলো কারণও আছে। নিখিল ব্যানার্জী যখন "মেঘ" রাগে পরিবেশমন্ডলীতে গভীর নিম্নচাপ তৈরি করেছেন, আমি আধঘন্টার জন্য সেই আবহাওয়াতে মিশে যাচ্ছি বটে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না, কি হচ্ছে! উনি যে কোথা দিয়ে আমাকে নিয়ে চলেছেন, সেই রাস্তাই চিনতে পারছি না। এই যে বিমূর্ততা, এটাই তো ক্লাসিকাল শিল্পের প্রাণ ভোমরা। এই বিমূর্ততা কে আমি ধরতেই পারছিনা, আমার অপারগতা। তাই ক্লাসিকাল শিল্পকে আমি আমার শিল্প বলে ভাবছিনা। ঠিক পছন্দ করতে পারছিনা।
এসব বলার পরে, জর্জ বিশ্বাস যখন "আকাশভরা" শুরু করছেন তখন তো আমি মহাবিশ্বের সাথে নিজেকে আর আলাদা করতে পারছিনা। তখন আমি, রবীন্দ্রনাথ, জর্জদা - একসাথে বসে আছি আমরা। সকলে মিলে পথের পাঁচালী দেখছি। যা কিনা আদ্যন্ত একটি ক্লাসিকাল ছবি, অন্তত আগে বলা আধুনিকতার সংজ্ঞা অনুযায়ী। তাহলে আধুনিকতার একটা নতুন সংজ্ঞা বানাতে হয়, কারণ শুধু সমসাময়িকতা দিয়ে আধুনিকতাকে আর বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। এই নতুন সংজ্ঞায় নিয়ে আসতে হচ্ছে "খোঁজ"।
চন্দ্রিলবাবুর বক্তব্যকে একটু বিস্তৃত করে বলা যায়, যে শিল্পের মধ্যে এক নিরন্তর সন্ধান চলেছে, সেই শিল্পই আধুনিক। সে খোঁজ নিজেকে চিনতে পারার হতে পারে, বা শিল্পকে উত্তরণের হতে পারে অথবা কোনো এক বিমূর্ত খোঁজ, যা কিনা আসলে সন্ধান পাবার পরও বিমূর্ত থাকবে। সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী ক্লাসিকাল শিল্পভাবনা এক চূড়ান্ত আধুনিকতায় পরিবর্তিত।
পন্ডিত আমীর খান "বসন্ত" রাগে যখন বিস্তার করছেন, তখন তো মনে হচ্ছে উনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই সর্বশেষ অনুভূতিকে যা বসন্তকে বয়ে আনবে। যে বসন্তের ছায়াছবি তাঁর মনে, হৃদয়ে, মস্তিষ্কে খেলা করছে, সেটাকেই সুরের মধ্যে প্রকাশের এক সর্বোত্তম চেষ্টা। সেই আল্টিমেট অনুভূতিকে নিরন্তর রূপ দেওয়ার চেষ্টাই সার্থক করে তুলছে ক্লাসিক্যাল শিল্পকে। কিন্তু কোনো শিল্পই তো সার্থক নয় এই সন্ধানটুকু ছাড়া। সত্যজিৎ- এর অন্যতম "আধুনিক" কীর্তি, প্রতিদ্বন্দ্বীর শেষ দৃশ্যটা মনে পড়ে যায়। সেই ছোটবেলার নাম-না-জানা পাখির ডাকটা। সেটারই তো খোঁজ সারা ছবিটা জুড়ে। ওই মিষ্টি ডাকটা, ওই সরল ডাকটা, যেটার মধ্যে লুকিয়ে আছে সব অন্তর্দ্বন্দ্বের অবসান। সেটার সন্ধানেই তো কি ভীষণ আধুনিকতা সত্যজিৎ-এ।
এই পর্যন্ত এসে ক্লাসিকাল আর আধুনিক সম্পূর্ণ মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলেছি। নবারুণ এর ছোট গল্প কিস্যু বুঝতে পারছিনা। অথচ মানুষটি কি ভীষণ "আধুনিক"। ওনার কবিতা দিয়েই তো আশা নিয়ে বাঁচছি, চেষ্টা করছি, যেন "একটা কথার ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে" পড়ে, হোক সারা সহর উথাল পাথাল। আধুনিকতা তছনছ করে দিক চারপাশের এই মেকী পরিপাট্য। এবং তার পরেই হয়ত একটা নতুন সূর্য উঠবে, "লাল সূর্য" পূর্ব দিকে। সব কিছু তখন কোমলতায় ভরে গেছে। পন্ডিত আলী আকবর খাঁ তখন ভৈরবী বাজাচ্ছেন। রাগেদের সাথে নাকি অনেকটা সময় কাটাতে হয়, তবেই নাকি তাদের বোঝা যায়। আমিও হয়ত একটু একটু করে বেশি সময় কাটিয়ে, রাগসহ অন্যান্য ক্লাসিকাল শিল্পের বিমূর্ততা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করবো। যেখানে অন্তর্দ্বন্দ্বের সাথেই সহাবস্থান করবে পরিতৃপ্তি বা রেসোলিউশন।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment