Saturday, May 26, 2018

অন্তরখনন

ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছি, কানে হেডফোন। একটু সামনে একটি মেয়ে হেঁটে চলেছে। আমার মনে হল, সে যেন আমার হেডফোনে হয়ে চলা গানের তালে তালে হাঁটছে। লক্ষ্য করে দেখলাম, তার কানেও হেডফোন। এর মানে, সে হয়তো সম্পূর্ণ অন্য কোনো গানের ছন্দেই হেঁটে চলেছে, অথবা তার হাঁটার হয়তো কোনো ছন্দই নেই। কিন্তু আমার কানে, আমার মনে যে গান, যে ছন্দ বয়ে যাচ্ছে, তারই প্রতিচ্ছবি আমি দেখতে পাচ্ছি মেয়েটির হাঁটার মধ্যে।

একইরকম ভাবে, আমরা তো সত্যিই জানিনা, অন্য লোকটা ঠিক কি ভাবছে, কিভাবে ভাবছে, কোন পরিপ্রেক্ষিতে ভাবছে। কিন্তু নিজেদের সুবিধেমতো একটা প্রতিচ্ছবি ভাসিয়ে দিই, অন্য মানুষের জীবনের ক্যানভাসে। অথচ সেই জীবনটা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই থাকে না। আর সেই মানুষটাকে যদি সামনাসামনি, চাক্ষুষ না দেখে থাকি, তখন আমাদের কল্পনাশ্রিত চারিত্রিক গড়নটার আরো সহজ প্রক্ষেপন করতে পারি। বিভিন্ন ডিজিটাল সোশ্যাল মিডিয়ার নেটওয়ার্কের দৌলতে, যেটা এখন প্রায়শই হয়ে থাকে।

এর ফলস্বরূপ, ঠিক কোন "আমি"-টা যে আসল "আমি", ক্রমশই সেটা ধোঁয়াশায় চলে যাচ্ছে। আমার চারপাশের সমাজ একটা নির্দিষ্ট "আমি"-কে ডিমান্ড করছে। আমার সোশ্যাল মিডিয়ায় অচেনা-স্বল্পচেনা-(আগে-চেনা-এখন-অচেনা) বন্ধুরা একটা "আমি"-কে চাইছে। এছাড়াও ব্যাক্তিগত স্তরে আরো নানা কাছের মানুষ, দূরের মানুষেরা বিভিন্ন "আমি"-কে চেয়ে থাকছেন। 

কিন্তু তার মধ্যে থেকেও একটা আমার "আমি" তো আছে। যে "আমি"-টা একান্ত আমার। যে "আমি"-টাকে আমি নিজে চেয়েছি। যে "আমি"-টার মতে, সৃষ্টিশীল শিল্প আর রাজনীতি একসাথে পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে। যে "আমি"-টার মতে আধ্যাত্মিক এবং ধর্মীয় ব্যাপারকেও খুব যুক্তিযুক্তভাবেই তর্কের বিষয়ে আনা যায়। তাকে স্রেফ "গাঁজাখুরি" হিসেবে উড়িয়ে না দিয়েও, দেখানো যায় যে ধর্ম পালনের জায়গাটা খুবই ব্যক্তিগত। আবার সেই "আমি"-টা তো এটাও মানে, যে সমাজবাদ কোনো ধর্ম নয়। 

মানুষের সমাজে থাকার দরুন, তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই তো একসাথে সমাজবদ্ধ হয়ে থাকা। সেই সমাজে একে অপরের সাহায্যই তো খুব প্রত্যাশিত। সেখানে কি করে একটা ভার্চুয়ালি তৈরী করা জিনিস, যার পোশাকি নাম "টাকা", তাকে আমরা সমাজ এগোনোর প্রধান চালিকাশক্তি করে তুলতে পারি? কিন্তু তা বলে সমাজবাদ তো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মতো কোনো "গোঁড়ামো" নয়। কি করে তা হবে? কারণ সমাজ তো সদা-পরিবর্তনশীল, সে এক জায়গায় থামবে কেন! কিন্তু সেই সমাজবাদকেই কিছু মানুষ কুক্ষিগত ধর্মের মতো করে তুলছে। মাঝে মাঝে "মহামতি মার্ক্স্"-এর কোটেশন টেনে কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তা কেন হবে, আমি তো সমাজে থাকতে থাকতে স্বততই উপলব্ধি করছি সমাজবাদের গুরুত্ব। তার জন্য তো আমার মার্ক্স্-এর উদ্ধৃতি লাগছে না। হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে পড়তে হয় বৈকি, তবে যেমন কম্পিউটার আর্কিটেকচার বুঝতে না পারলে বই পড়তে হয়, ঠিক তেমনি; স্রেফ আগের কাজটাকে বুঝে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তারপর উপলব্ধি তো ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক তো নয়।

অথচ, যে এই "আমি"-টাকে দেখেনি বা বোঝার চেষ্টা করেনি, সে তো ওই প্রাতিষ্ঠানিক "আমি"-কেই দেখার চেষ্টা করছে। আমিও আর আলাদা থাকছি না, অনেক প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরূপের মধ্যে স্রেফ আর একটা প্রতিবিম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছি আমি। এর জেরে, সেই অন্যের চোখের "আমি"-র সাথেও আর নিজেকে মেলাতে পারছি না। খুব খুব দূরে সরে পড়ছি। একটা দেওয়াল তৈরী হচ্ছে। আমি বোঝাতে পারছি না, যে কোথাও গিয়ে আমার অন্য কিছু মনে হচ্ছে, লেনিনিষ্ট-স্টালিনিস্ট পার্টি স্ট্রাকচারে ঠিক বিশ্বাস থাকছে না আমার। আবার কোথাও হয়তো আমার মনে হচ্ছে, ট্রটস্কি যখন আন্তর্জাতিকতাবাদের কাছে গিয়ে সমাজবাদকে স্থান দিতে চাইছেন, সেটাই হয়তো আসল পথ। কখনো মনে হচ্ছে, নিচ-থেকে-উপরে আসার রাস্তাটাই সঠিক, নিচের স্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা-আন্দোলন-রাজনৈতিক-শিক্ষা না হলে উপরের নেতাদের শত শত কুরবানী, আন্দোলন বৃথা। সবকিছুকে আমি যখন অবজেক্টিভলি বুঝতেও চাইছি, আমার গায়ে লেগে থাকা "ট্যাগ", আমাকে তা বুঝতেই দিচ্ছে না, চারপাশের মানুষেরা সেই সুযোগটাই দিচ্ছে না। আমার মতপ্রকাশ স্রেফ আমার গায়ের "ট্যাগ"-কেই আরো জোরে সেঁটে দিচ্ছে। 

একেকবার খুব খুব, যাকে বলে, একেবারে ভীষণ রেগে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, এভাবে আর চলা সম্ভব নয়। আমাকে খুঁজে দিতেই হবে আফ্রিকা থেকে আহমেদাবাদ - সকল জায়গার শ্রমিকের সমানাধিকার। কিন্তু আবার তার পরেই তো আমার খুব ভালো লাগছে এই পৃথিবীটাকে। আমি নদীর ধারে যখন হাঁটছি, তখন দেখতে পাচ্ছি, সলিল সুর করছেন দূরে গাছের তলায় বসে, "আহা ওই আঁকা-বাঁকা যে পথ"। আমি তো শ্যামল মিত্রের স্রোতে ভেসে গেয়ে উঠছি, "আপন নীড়ে ফিরে গেছে পাখি, নীড় হারায়ে আমি পথে থাকি"। এগুলো তো মিথ্যে নয়, বরং ভীষণ ভীষণ করে সত্যি বলে মনে হচ্ছে আমার। আমি যখন অনেক ভেবে ভেবে, একটা থিওরি খাড়া করে, মডেল বানিয়ে, তার ওপর একটা সিস্টেম তৈরী করছি, কোড লিখে - আমার যে ভীষণরকমভাবে সেটাকে রিয়েল, আদ্যোপান্ত সত্যি মনে হচ্ছে। অথচ ফেসবুকের মধ্যে যে কোনোরকম রিয়েলিজম পাচ্ছি না। কেউ যে সেখানে সত্যি কথাটা বলছে না। সক্কলে একটা ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের চেইনে, শৃঙ্খলে ঢুকে গেছে মনে হচ্ছে। এই কঠিন কৃত্তিম সত্যিটাকে যে একদম অস্বীকার করতে পারছি না।

তখনই দূরে দেখতে পাচ্ছি একটা কালো রঙের কাঠের চেয়ার, তার ওপর ধবধবে সাদা আলো ফেলা হয়েছে কোথা থেকে যেন, চারপাশে তখন রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে। কালো চেয়ারটায় একটা মূর্তি বসে আছে। কাছে গিয়ে বুঝতে পারছি, বোধ হয় তিনি বাদল সরকার। ওনাকে সহ্য করতে পারছি না, উনি আমাকে বারবার বলে যাচ্ছেন, "এক-দুই-তিন, তিন-দুই-এক", আমি দৌড়ে পালাচ্ছি। এসে পড়ছি একটা টিভির সামনে। সেই টিভিতে আর্জেন্টিনার জার্সিতে মেসি খেলছে, কিংবা খেলতে পারছে না, কারণ বল পাস্ করার মতো কেউ নেই। সেখান থেকেই দূরে শুনতে পাচ্ছি, যেন রেডিও বাজছে, যেমন মামাবাড়িতে সকালবেলায় বাজতো, এখনো বাজে বোধ হয়। কি গান হচ্ছে ওখানে? ছুটে গিয়ে দেখছি এক সুপুরুষ বসে বসে গান বাঁধছেন, পাশে গিটার নিয়ে আমি বসে পড়ছি। বুঝতে পারছি উনি জসিমুদ্দিন, সুর দিচ্ছেন, "জ্বালায়ে চান্দের বাতি, আমি জেগে রব সারা রাতি গো; কব কথা শিশিরের সনে"। দেখছি আকাশে চাঁদ উঠছে, তার রুপোলি আলো পড়ছে নদীর বুকে, গাছের মাথায়। কি ভীষণ নরম হাওয়া আমার মুখে এসে লাগছে ! দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, অনেকে হেঁটে আসছেন আমাদের সুরমূর্ছনায় সঙ্গী হতে, কারা ওরা - চিনতে পারছি না, তবু অবয়বে মনে হচ্ছে, ওদের নামই তো সলিল, সুমন, মার্ক্স্, সত্যজিৎ, নোয়াম, ঋত্ত্বিক, গৌতম, শচীনদেব, পল সাইমন, এবং আরো কত চেনা-শোনা মানুষ। হ্যাঁ, এদেরই তো আমি চিনি। কিন্তু আমার জীবনের চারপাশের কাউকেই যে আর চিনতে পারছি না ! তার থেকেও বড়, তারা যে আমায় চিনতে পারছেন না।

No comments:

Post a Comment