ম্যাসাঞ্জোর গেছিলাম একবার। ওরকম শান্ত, ধীর-স্থির জল যে নদীর হতে পারে, তা দেখে বেশ অবাকই লেগেছিল। নদীর বহমানতা থমকে গিয়ে সে সেখানে মানুষের হাতে বশবর্তী। কিন্তু সেই নদীই বর্ষাকালে গ্রামের পর গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। মনে হয়, বাঁধা পড়ে থাকতে থাকতে ময়ূরাক্ষীর মনে জমতে থাকা কথাগুলো যে ভীষণ বেদনা তৈরী করে, তার জেরেই প্রবল বেগে স্রোত আসে বৃষ্টি হলে। আমাদের সম্পর্কগুলোও যেমন ভেসে যায় না-বলতে-পারা অভিমানের আঘাতে।
কোনো সিনেমা যখন ব্যক্তিগত জীবনের সাথে মিশে যায়, তখন তা মনের বেশি কাছের হয়ে যায়। কিছু সিনেমা আমাদের ব্যক্তিগত আশার প্রতিফলন ঘটায়, আবার কিছু সিনেমা আমাদের জীবনের উপেক্ষিত দিকগুলোকে সামনে এনে দেয়। "ময়ূরাক্ষী" দ্বিতীয় ধরণের অনুভূতিকে সামনে আনলো। সিনেমা শুরু হওয়ার পরে, অতনুবাবু প্রথম যখন সৌমিত্রবাবুর চশমার ক্যামেরায় ফোকাস করলেন আর ক্যামেরা ফলো করলো সেই চশমাকে, যা সৌমিত্রবাবুর হাত থেকে তুলে নিয়ে প্রসেনজিৎ আলতো করে রাখলেন টেবিলে, সেই তখন থেকেই ঢুকে পড়লাম ফিল্মের একদম ভিতরে। ওই ফোকাসটাই সিনেমা হল থেকে আমাদের নিয়ে গিয়ে ফেললো, সুশোভন (সৌমিত্র) আর আর্যনীল (প্রসেনজিৎ)-এর জীবনে, দ্বন্দ্বে ও সমস্যায়।
যদিও সিনেমায় অনেকগুলো চরিত্রের জীবন একসাথে চলছে, যেমন বাস্তবেও চলে, কিন্তু বারবারই (অতনুবাবুর কারগরিতে) আমরা ঢুকে পড়লাম সৌমিত্রের চোখ আর ঠোঁটের যন্ত্রনায়। একজন প্রফেসরের প্রগলভতা, পান্ডিত্য পেরিয়ে এসে জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি অশীতিপর, কিন্তু তবুও তাঁর তীক্ষ্নতা হারিয়ে যাচ্ছে না। এমন বিবিধ অভিজ্ঞতার মিশেলকে স্তরে স্তরে মূলত মুখের মধ্যে ফুটিয়ে তোলার মতো অভিনেতা ভূ-ভারতে আছেন কিনা জানিনা। যদিও থাকেন, সৌমিত্রবাবুর এই কাজটা করে ফেলার পর অন্য কারোর দরকার পড়ে না। উনি যখন ক্যাফেতে বসে কফি খেতে খেতে যৌবনের সংগীত রচনা করছেন, তখন উনি আর ৮৪ বছরের বৃদ্ধ নেই, একজন যুবক সংগীত নির্দেশক হয়ে উঠেছেন। আবার যখন কারোর মৃত্যুসংবাদ ওনার মধ্যে বিহ্ববলতা সৃষ্টি করছেন, তখন তাঁর চোখে শূন্যতা। আমার মনে হয় না, সৌমিত্রবাবু ওনার যুবক বয়সের কোনো ফিল্মেই অভিনয়ের এই দ্যোতনা সৃষ্টি করতে পেরেছেন।
এই ধরণের একজনের পাশে কাজ করাটাই ভীষণ মুশকিলের। প্রসেনজিতবাবুকে দেখে মনে হয়েছে, উনি চেষ্টা করেছেন এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে। অনেক জায়গাতেই তাঁকে এই কারণেই বেশ সাবলীল লেগেছে, কিন্তু কিছু জায়গায় মনে হয়েছে মেকী। যেমন সৌমিত্রবাবু যখন প্রসেঞ্জিতবাবুর মন-খারাপের কথা প্রেডিক্ট করলেন, সেই জায়গায়। আবার বাবার পাশে না থাকতে পারা বা জীবনের বিভিন্ন অপূর্ণতা, ব্যর্থতা মাঝে মাঝেই ওনার চোখে দেখে যেন ভীষণ স্পষ্ট। এছাড়াও আশেপাশের অভিনেতাদের ভীষণই ইন্টিগ্রেটেড লেগেছে সিনেমার সিচুয়েশনের সাথে। Sudiptaa Chakraborty যেভাবে একজন স্রেফ পরিচারিকা হয়ে রয়েছেন, যেন অন্তরালের উপস্থিতি, অথচ কি প্রবল। আমরা দর্শকরাও যেন আস্বস্ত হই, যে সুদীপ্তা যদি থাকেন, সৌমিত্রবাবু ভালো থাকবেন। অবশ্যই এখানে চিত্রনাট্যের সাপোর্ট আছে, কিন্তু অভিনেতারা সেটাকে যথাযত স্তরে তুলে আনতে পেরেছেন। প্রসেনজিৎ, সুদীপ্তা, গার্গী, ইন্দ্রানী - এদের সকলকেই ধন্যবাদ।
অতনুবাবুর এই আলাদা ধরণের মুহূর্তগুলোকে উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। যদিও উনি এভাবেই আমাদের ভালো কিছু ছবি উপহার আগেও দিয়েছেন। উনি, কৌশিক গাঙ্গুলি, প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য, ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরি - এরা আছেন বলে, আশা করি ভালো বাংলা সিনেমা ঠিক থাকবে। অতনুবাবু যেভাবে ধীরে ধীরে সিনেমাটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, যেভাবে পুরোনো স্মৃতির রেফারেন্স টেনেছেন বিকিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গে, যেভাবে আমেরিকা-ফেরত বাঙালিকে গ্রাউন্ডেড রেখেও সুক্ষ distinction রেখেছেন, তার উদ্দেশ্যে শুধু প্রশংসাই হয়। ময়ূরাক্ষীর দ্বৈত চরিত্রকে নৈপুণ্যের সাথে পর্দায় আনার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তবে উনিও বোধ হয় বুঝেছিলেন, যে এতগুলো ক্লোস শটের একটা ফিল্মে সৌমিত্রবাবুর মতো দক্ষ অভিনেতা ভীষণ প্রয়োজনীয়, indispensable বলা উচিত। শুধু কখনো কখনো মনে হয়েছে, shot reverse shot-গুলোতে একেকটা শটের দৈর্ঘ্য খানিকটা কম হয়ে ক্যামেরাটা মুখে আর একটু ধরলে হয়তো বেটার হতো; কিন্তু আমার মতো সিনেমা-অশিক্ষিতের এ ব্যাপারে পরামর্শের অধিকার নেই। তাই এটা কেবলই মতামত। যেমন আর একটা মতামত সিনেমার শেষটা নিয়ে। ইন্টারমিশনেই ভাবছিলাম এই সিনেমার conclusion-টানা বেশ কষ্টকর। অতনুবাবু খুব একটা খারাপ করেননি কাজটা, কিন্তু আরো দক্ষ কিছু কি হতে পারতো? কিছু মেটাফোরের মাধ্যমে, শুধুমাত্র নতুন প্রজন্মকে জানলার বাইরে দিয়ে দুনিয়া দেখানো ছাড়া? জানিনা, কোথাও মনে হয়েছে, হলে মন্দ হতো না, কিন্তু এটাও মনের কাছেই থাকবে।
অসংখ্য ধন্যবাদ Atanuবাবুকে এরকম একটা movie-এর জন্য। আর বিশেষ ধন্যবাদ, Soumitra Chattopadhyay-এর এমন অভিনয়কে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এবং এটাকে ডকুমেন্ট করে রাখার জন্য। ময়ূরাক্ষী শান্ত আর প্রবল, তার দুই চরিত্র নিয়েই আমাদের মনে থাকুক!
No comments:
Post a Comment