Thursday, August 30, 2018

শিল্পকলা নিয়ে নোটস - ২ | Notes on Arts - 2

আগের নোটে শিল্পের ক্লাসিকাল এবং মর্ডান ধারার মধ্যে একটা মেলবন্ধনের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে, শিল্পের বিষয়বস্তু বোধগম্য না হওয়ার একটা কথা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। সেটা নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করা যাক।

শিল্পকে বুঝতে পারার জন্য যেমন নমনীয়, অনুভূতিপ্রবণ একটা মনন দরকার হয়, তেমনি একটা বিশ্লেষণী ক্ষমতাও লাগে। তবে সেই বিশ্লেষণী ক্ষমতার কথা বেশি করে ভাবলে শিল্প আর শুধু অরগ্যানিক একটা বস্তু থাকে না, যার সৃষ্টি নাকি কোনো এক অদৃশ্য শক্তি, ক্ষমতা বা অনুভূতির ওপর নির্ভর করে। এই বিশ্লেষণী ক্ষমতা শিল্পকে কিছুটা যান্ত্রিক বা মেকানিকাল করে ফেলে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।

কোনো "ভালো" গানের কথা ধরা যাক, যেমন অঞ্জন দত্তের "বেলা বোস" বা ক্যাকটাসের "হলুদ পাখি"। আমরা যদি ভেবে নিই, এই গানগুলোর সুর তৈরি হয়েছে শুধুমাত্রই অনুভূতি দিয়ে, মানে অঞ্জনবাবু কোন মনখারাপের বিকেলে "বেলা বোস"-এর কথার সাথে সুর তৈরি করেছেন, তাহলে হয়ত শিল্পের একটা আলাদা বায়বীয়তা, মাধুর্য, স্বর্গীয় ভাব তৈরি হয়। কিন্তু আমরা একটু গভীরে গিয়ে দেখবো যে, এই দুটো গানেই শুধুমাত্র ডি মেজর key-এর বিভিন্ন কর্ড ব্যবহার করা হয়েছে। হয়তো অঞ্জনবাবু বা ক্যাকটাসের মনে মনে হৃদয় থেকেই ডি মেজরের কর্ড গুলোই এসেছে। কিন্তু আমাদের এটাও দেখতে হবে যে, এরকম একটি স্কেলের মেজর কর্ড গুলো মানুষের কানেও শ্রুতিমধুর হিসেবে শোনায়। সেই সূত্র ধরেই এনারা পুরো গানের সুরটাকে বেঁধে ফেলেছেন।

এভাবে শিল্পের বিশ্লেষণ করতে বসলে দেখা যায়, প্রত্যেক শিল্পেরই কিছু ব্যাকরণ আছে। গানের যেমন major বা minor key-এর কর্ডস। এই ব্যাকরণ দিয়েই প্রত্যেক শিল্পের আলাদা কিছু ভাষা তৈরি হয়। যখন কোনো শিল্পী সেই ভাষায় কথা বলে কোনো শিল্প সৃষ্টি করছেন, তখন আমাদের কাছে তা ভীষণ ভালোলাগার এনে দিচ্ছে, যদি আমরা সেই ভাষা বুঝতে পারি। কিন্তু যখন আমরা সে ভাষা বুঝতে পারছিনা, তখন সেই শিল্পকে আমাদের গ্রহণ করতে সমস্যা হচ্ছে। সে জন্য পন্ডিত আমীর খাঁ-এর "সাহানা" রাগ আমাদের কারো কারো কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ওই রাগের যে ভাষা, তার স্বাদ বুঝতে পেরে তার শিল্পরসে ভেসে যাচ্ছেন।

শিল্পের এই ভাষা শেখানোর জন্যই আজকাল বিভিন্ন আর্ট স্কুলগুলো তৈরি হয়েছে। এই স্কুলগুলিতে প্রচলিত শিল্প-ভাষাগুলি শেখানো হয়ে থাকে। তাই কেউ যদি কোনো শিল্পের সম্পূর্ণ মাদকতা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হয়, তাহলে সে এই আর্ট স্কুলগুলোর শরণাপন্ন হতে পারে, অথবা নিজে থেকে সেইসব ভাষাকে রপ্ত করার চেষ্টা করতে পারে। তবে প্রচলিত ভাষা যেমন আছে, তেমনি সেই ভাষাকে ভেঙে দেওয়াও আছে।

আমরা যদি সত্যজিত কে দেখি, তাহলে দেখতে পাবো, সিনেমার ভাষা মেনে নিয়ে তিনি অকল্পনীয় কিছু সিনেমা তৈরি করে গেছেন। তার সিনেমাগুলো তখনকার ওয়েস্টার্ন ফিল্মের যে ভাষা, তার সাথে সামঞ্জ্যপূর্ণ। সত্যজিৎ নিজেও একাধিক সাক্ষাৎকারে তার এই ওয়েস্টার্ন ফিল্মের অনুপ্রেরণার কথা বলেছেন। বিপরীত দিকে আছেন ঋত্বিক। তিনি সিনেমার সব প্রচলিত নমনীয় ভাষা, ন্যারেটিভ ভেঙে দিচ্ছেন। ফলত প্রথমে মানুষ সেই ভাষাকে নিতে পারছেনা। কারণ একটা নতুন ভাষা বুঝতে পারা তো বেশিরভাগ জনগণের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা ঋত্বিক-এর বেশিরভাগ ফিল্মকে পছন্দ করেছেন না। কিন্তু "যুক্তি তক্ক গপ্প" একটা ল্যান্ডমার্ক ফিল্ম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে, আর এ জন্যই ঋত্বিক এর ছবিগুলোকে এখন বিভিন্ন ফিল্ম স্কুলে গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়ে থাকে। যাতে শিক্ষার্থীরা এই ভাষা সম্পর্কে অবগত হতে পারেন।

এর পরে প্রশ্ন আসতে পারে, শিল্পীরা তাদের শিল্পের উৎস ঠিক কোথা থেকে পেয়ে থাকেন। যে কোনো শিল্পের উৎকর্ষতা তো সেই শিল্পের সততা আর তার ভাষার উপর নির্ভর করলো। কিন্তু সেই উৎকর্ষ শিল্পের অনুপ্রেরণা কোথায়? এ নিয়ে পরের নোটে ভাবার চেষ্টা করবো।
(চলবে)

No comments:

Post a Comment