Friday, September 21, 2018

মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা প্রলম্বিত জেটল্যাগ চলছে - Sometime it feels like a long jetlag

মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা প্রলম্বিত জেটল্যাগ চলছে। গভীর রাত্রে অনেকসময় যখন ঘুম ভেঙে যায়, তখন মনে হয়, কেন ঘুমোবো ! আমার তো এখন জেগে থাকবারই সময়। আমার নিজের যারা - বন্ধু, শত্রু, আত্মীয়, ইত্যাদি - তারা তো সকলেই এখন জেগে, দিনের ব্যস্ততম সময়ে তারা ব্যস্ততায় বন্দী। তাহলে আমি কেন এই নিকষ কালো মুক্তদশার কবলে থাকবো ! এইরকম প্রশ্নই সমস্ত ঘরজুড়ে ঘুরপাক খেয়ে প্রতিফলিত হওয়ার পরে সত্যের সন্ধানী হওয়ার ইচ্ছে হয়। সেই সত্যের খোঁজেই বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমকে আপন করে নেওয়া - গান, লেখা, কবিতা। এসব কিছুতেই সেই সত্যকে তুলে ধরার এক যারপরনাই চেষ্টা। কিন্তু সেই সত্যানুসন্ধান আসলে একটা ঢাল। প্রকৃতপক্ষে এসব শিল্প যে সৃষ্টি করছি, এগুলো পুরো ট্র্যাশ, বোগাস, গার্বেজ। স্রেফ কোনো মূল্য নেই এগুলোর। এগুলো শিল্প বলে ভাবার নূন্যতম স্তরেও পৌঁছনোর যোগ্য নয়। তাই জন্যই সত্যানুসন্ধানের একটা ভেক ধরতে বাধ্য হতে হয়, নাহলে তো সৃষ্টির কোনো সার্থকতা থাকেনা। তবে এই সত্য-মিথ্যার আড়ালেই অন্য যে উদ্দ্যেশ্য অজান্তে সাধন হয়, সেটাই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা -আত্মানুসন্ধান। আত্মায় বিশ্বাস নেই, কিন্তু তাকে সন্ধানে যথেষ্ট বিশ্বাস আছে। নিজের অন্তরটাকে খুঁড়ে বের করার মধ্যে এক পাশবিক আনন্দ যেমন আছে, তেমনি মহাজাগতিক এক তৃপ্তি আছে - হয়তো বা পাশবিক আনন্দটাতেই তৃপ্তি। তবে নিজের ভিতরে সম্পূর্ণ প্রবেশ করার মানে, গভীরে লোকানো আশঙ্কাগুলো - যা কিনা দৈনন্দিন নাওয়া-খাওয়ায় চাপা পড়ে ছিল - সেগুলোকে এক অন্ধকার ঘর থেকে সর্বসমক্ষে আলোয় নিয়ে ফেলা। মৃত্যুচিন্তা তার মধ্যে প্রথম সারির। অধিকাংশ অন্তরখননেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। সামান্য ভাবনার বারুদেও, এই চিন্তার ফুলকি বিধ্বংসী আগুনের ধ্বংসলীলা চালায়, মনের অলিতে-গলিতে, মস্তিকের পাড়ায় পাড়ায়। স্রেফ রাস্তায় হাঁটতে থাকা থেকে ল্যাম্পপোস্ট, ট্রাফিক লাইট, স্ট্যান্ডার্ড, আমেরিকা, ভারত, ইতিহাস, সমাজতন্ত্র, স্বাধীনতা, পৃথিবী, প্রক্সিমা সেন্ট্যুরি, মহাজগত, বিগব্যাং, ব্ল্যাক হোল এবং... আমি। আসলে তো আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব নেই এই ভাবনাটারও। মৃত্যুর যদিও অস্তিত্ব আছে, আমাদের একমাত্র নিশ্চয়তা। সেটারই স্থায়িত্ব নির্ধারিত। আর একটা প্রচণ্ড চিৎকার, এবং শুধুই তার থেকে যাওয়া আছে, তারও অস্তিত্ব আছে। গান, লেখা - এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই, লেখার কোনো মূল্যও নেই। কারণ লেখা অনেক সহজ, বাঁচা অনেক কঠিন।
মাঝে মধ্যে মনে হয়, একটা প্রলম্বিত জেটল্যাগের মধ্যে রয়েছি, গত চার বছর ধরে।

Sunday, September 16, 2018

মন তরে কেবা পার করে

ভীষণ গোলাপী মতন হয়ে আকাশের গায়ে সন্ধ্যের ছায়া পড়তে শুরু করেছে। বোম্বে রোড ধরে চলে এসে কিছুক্ষনের ভিতরেই কলকাতাকে পেরোনো হয়ে গেছে। সেখানকার মেকী মনুষ্যত্ব, নাক-উঁচু স্বভাব গা থেকে ঝরে গেছে। মাটির কাছাকাছি, খুব খুব কাছাকাছি যাওয়া হচ্ছে। আকাশ গোলাপী রঙে সেজে উঠে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। যে নদীকে একটু আগেই অচেনা মহিলা লেগেছিল, এখন সে যেন কত চেনা পুরনো বান্ধবী। এইভাবে শ্রান্ত সন্ধ্যের মাঝে ওর সাথে বসে থাকতে থাকতে, হয়তো এই পুরনো বান্ধবীর প্রেমে পড়বো। এরই তো প্রেমে পড়া যায়। কি হবে আর বন্ধুত্বের দূরত্ব রেখে! ওই তো, একটা নৌকো দেখা যাচ্ছে। ওতে করে বেরিয়ে পড়ছি দুজনে মিলে। এরই মধ্যে,  ভাটিয়ালি গান শুরু হয়েছে। মাঝিভাই এক প্রান্তে বসে গানের ভেলায় দাঁড় বাইছেন। আমি আর নদী একদিকে শুয়ে আছি, পাশাপাশি। অকূল দরিয়ার গান শুনতে শুনতে উপরে দেখছি, কিভাবে তারারা একের পর এক কালো হতে থাকা আকাশের প্রান্তরে অবিন্যস্ত ভাবে দাঁড়াচ্ছে। এরই মাঝে আমার সদ্য হওয়া প্রেমিকা নদী গেয়ে উঠছে, "মাঝি তোর নাম জানিনা, আমি ডাক দিমু কারে, মন তরে কেবা পার করে"। এত বেদনা, কিন্তু তার মধ্যেও জীবনতরী বেয়ে চলার কি ভীষণ আর্তি! নদীর কণ্ঠ্যে যে কি আছে! দেহে শিহরণ হচ্ছে, কিন্তু চোখে জল, ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নদীকে জিজ্ঞাসা করতে গেলাম, "মেঘে ঢাকা তারাতে এই গানটা..."। নদী গান থামাল না, সদর্থক মাথা নাড়লো। আকাশ থেকে দূরে পাড়ের দিকে চোখ নেমে এলো, ছোট্ট ঘুপচির ভিতর টিমটিমে হলদে বাল্ব গুলো জ্বলে উঠছে, একের পর এক। কেউ হয়তো তুলসিতলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ দিচ্ছে, আজান শেষে কেউ ঘরে ফিরছে। শাঁখ বাজলেও শব্দ এসে পৌঁছায় না নদীর মাঝখানে।

আচ্ছা নদী, ওপারে যাওয়া যায় না? - আমার কৌতুহল। নদী বলছে, "আমি তো যাই। আমার তো তোমাদের মতন বাঁধন নেই। আমি স্বাধীন।" - নদীর মুখে মৃদু হাসির স্রোত খেলে গেল। কিন্তু সেই স্রোতই আমার মনের ভিতর কি ভীষণ রকম মোচড় দিচ্ছে। এতগুলো মানুষকে একটা পেনের আঁচড়ে ঘর ছাড়া করে দেওয়া হল, আলাদা করে ভেঙে দেওয়া হল। চাইলেও আর যাওয়া যাবে না, শুধু হয়তো কিছু ঘুপচির ক্ষীণ, শান্ত, নিরস্ত্র আলো দেখা যাবে, এপার থেকে। তবু যেতে আমাকে হবেই; তাই উপায় বের করে নদীর দেহে ডুব দিচ্ছি আমি, নদীর সাথে মিশে যেতে। তখন তো আর কোনো বাধা থাকবে না। নদী তো আমার প্রেমিকা, আমাকে নিশ্চই ফিরিয়ে দেবে না। দিচ্ছেও না, ডুবে যাচ্ছি আমি। মুক্তি হচ্ছে আমার, দেশীয় বাধা, বন্ধন, পার্থিব শৃঙ্খল থেকে মুক্তি, কি ভীষণ আনন্দ, কি দারুন পরিতৃপ্তি! কি মিঠা জল, কি শীতল, কি স্নিগ্ধ! আমি বুঝতে পারছি, আমার মৃত্যু হচ্ছে, আরো গভীরে চলে যাচ্ছি নদীর, কিন্তু কোন কষ্ট হচ্ছে না। সমস্ত দুঃখ আমাকে, এই প্রথম বোধ হয়, ছেড়ে চলে যাচ্ছে। গলার কাছে বিশালাকৃতির দলাটা নেমে যাচ্ছে। কিন্তু নিশ্বাস নিতে পারছি না যে! দমটাই শুধু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জৈবিক বাস্তবতা আঁকড়ে ধরছে আমায়। কেউ আমাকে একটু অক্সিজেন দিন না, দাদা একটু অক্সিজেন? - আমি ভিক্ষা চাইছি। কিন্তু কেউ যে নেই নদীতে, সকলে কোনো না কোনো পাড়ে ঠাঁই নিয়েছে, কাউকে পাচ্ছি না। দাদা একটু কেউ সাহায্য করুন না, প্লিজ। দাদা আমি যে বাঁচতে চেয়েছিলাম, দাদা আ আ আ আ আ.... 

উঠে বসলাম, হাঁপাচ্ছি, ভীষণ ভয় করছে, চারিদিক অন্ধকার, শুধু বিছানার একটা কোণে রিডিং ল্যাম্পের আলোটা তাক করা আছে। চারিদিক অন্ধকারের ভিতরে, বিছানায় রাখা বুকমার্ক করা বইটার ওপর ল্যাম্পের আলোটা পড়ে, বইটার নামটা যেন একটু বেশি জ্বলজ্বল করছে, "পূর্ব-পশ্চিম" - আমাদের অবশিষ্ট আইডেন্টিটি।

Wednesday, September 05, 2018

তোমার আছে, তোমার নেই

Boston, 05-Sep-2018, 11:00 PM

তোমাদের সব আছে,
গাড়ি আছে, বাড়ি আছে,
নতুন কেনা ফ্ল্যাট আছে।
আলমারিতে সোনা-দানা,
সেবার পুজোর জহর খানা,
যত্ন করে রাখা আছে।
বছরে দুবার বিদেশ আছে,
ঘরের কাছেও ফ্লাইট করে
গোয়া কিংবা জয়পুরে
সময় পেলেই ঘোরা আছে।
সপ্তাহেতে দুবার করে,
রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে,
মুভি হলে সিনেমা আছে,
লাইভ শোয়ের টিকিট আছে।

কিন্তু তোমার সবুজ নেই,
শ্যামল মাঠের খোলা হাওয়ার
মাতাল করা সুবাস নেই,
মাথার ওপর নীল নেই। 
ঘরের ভেতর আরাম ক'রে,
নিখাদ একটা আড্ডা মারে -
এমন কোনো বন্ধু নেই। 
ঘোরা আছে, চেনা নেই,
শিল্প আছে, চর্চা নেই,
সত্যজিৎ খানিক আছেন,
শেষের কোনো কবিতা নেই।
রাস্তার পাশে ফুচকাওয়ালা-
শেষের ফাউটা দিতে বলার
ইচ্ছে আছে, উপায় নেই। 
"অনুপম" তো চিরন্তন,
গানের স্রোতে ভাসা নেই,
তোমার নতুন ভাষা নেই,
তোমার কেবল আমি আছি,
তোমার আসলে তুমি নেই।

Friday, August 31, 2018

"অরাজনৈতিক" আন্দোলন ও কলকাতা-কেন্দ্রিক নাগরিক সমাজ (~৫ মিনিট) । Apolitical Movements and Kolkata-based Civil Society

একবিংশ শতকের বয়েস বাড়ার সাথে সাথেই বাঙালির একটা প্রবণতা বেশি বেশি করে চোখে পড়ছে, "অরাজনৈতিক" হতে চাওয়ার প্রবল চেষ্টা। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনাস্থাই হয়তো এর মূল কারণ। কিন্তু এই "অরাজনীতি" তাঁদের সাময়িক আরাম ছাড়া আর কিছু দিচ্ছে বলে মনে হয় না। উপরন্তু এই "অরাজনীতির" সুযোগ যখন কোনো রাজনৈতিক দল নিতে পারছে, তখন তারা লাভবান হচ্ছে। আর যখন তা হচ্ছে না, তখন কিছু গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট কিছু সমস্যা ক্ষণিকের জন্য সমাধান হচ্ছে। অথচ "রাজনীতি" যদি সত্যিই দক্ষ এবং দায়িত্বপূর্ণভাবে করা যেত, তাতে কিছু ক্ষতি ছিল না, বরং একটা বৃহত্তর সমাজের ভালো হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে মেডিকেল কলেজের ঘটনা নিয়েও এই "অরাজনৈতিক" আকাঙ্খা আবারো দেখা গেল। মেডিকেল কলেজের হোস্টেল নিয়ে ছাত্ররা একটি আন্দোলন করছিলেন। তাঁদের দাবি না মানায় তারা একটি পলিটিকাল টুল হিসেবে "অনশন"-কে ব্যবহার করেন। দিন বাড়ার সাথে সাথে, কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলগুলো থেকে অনেক মানুষ এই আন্দোলনের সমর্থনে নেমে আসেন। তাঁরা মেডিকেলে কলেজে উপস্থিত থেকে ছাত্রদের সমর্থন জানান। শেষ পর্যন্ত কতৃপক্ষ ছাত্রদের দাবি মেনে নেয়। তবে এই আন্দোলনের পিছনের রাজনৈতিক চরিত্রটা কলকাতার মানুষ বুঝতে চাইলো না। আন্দোলনটাকে একটি "অরাজনৈতিক" চরিত্র দিয়ে তার পাশে দাঁড়ানো হল। 

এই আন্দোলনকে একটু গভীর ভাবে দেখলে অন্য চরিত্র বেরিয়ে আসে। মেডিকেল কলেজের যে ছাত্র সংগঠন এই আন্দোলনটা পরিচালনা করছিলো, ডিএসএফ, তাঁদের দাবিতে এও ছিল যে, তৃণমূলের প্রাক্তন ছাত্রকে যে সুপার করা হয়েছে, তাঁকে রাখা যাবে না। বদলে ছাত্র-শিক্ষকের কাউকে রাখতে হবে। অন্তত ন্যায়সঙ্গত দাবি, এবং রাজনৈতিকও। দাবিটাকে একটু বড় করে দেখলে বোঝা যায়, সব জায়গায় তৃণমূলের পোষ্য লোক বসিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এই দাবি। অনেক জায়গাতেই এখন এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন মানুষ। কিন্তু সব আন্দোলনকে "অরাজনৈতিক" রূপ দেওয়া যায় না, সব আন্দোলনের এলিটিজম থাকে না, যা মেডিকেল কলেজের আছে। ফলে সেইসব আন্দোলন কোনো স্বীকৃতি বা বৃহৎ আকৃতি পায়না। অথচ মানুষের এখনই দরকার ছিল, এই ধরণের আন্দোলনগুলোকে একত্রিত করার। কিন্তু তা না হয়ে, এটা স্রেফ মেডিকেলের ছাত্রদের সাময়িক উপশম ঘটালো।

এখনকার এই ঘটনা যেমন দেখায় যে অরাজনৈতিক আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা, তেমনি উল্টো পিঠও আছে। ২০০৭ সালের নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন হয়, তাকেও প্রথমদিকে এক "অরাজনৈতিক" রূপ দেওয়া হয়েছিল। কলকাতার সাধারণ মানুষ এবং "বুদ্ধিজীবী", শিল্পী সমাজ সেই আন্দোলনের সমর্থনে নেমে এসেছিলেন। যদিও এটা অরাজনৈতিক আন্দোলন একেবারেই ছিল না, পিছনে খুব ক্ষুরধার রাজনৈতিক মাথারা কাজ করছিলেন। মমতা ব্যানার্জি এই আন্দোলন থেকে নিজের পলিটিকাল মাইলেজ উদ্ধার করেন। আবার মাওবাদীরা - যাদেরকে দেশের সব থেকে বড় ইন্টারনাল সিকিউরিটি থ্রেট বলেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী - এই আন্দোলনের পিছনে তাঁদের অক্সিজেন খুঁজে পেয়েছিলেন। বাংলার সাধারণ মানুষ অজান্তে দেশের "বৃহত্তম ইন্টারনাল সিকিউরিটি থ্রেট"-কে সমর্থন করেছিল। এরপরে মমতা ব্যানার্জির শাসক চরিত্র উদ্ঘাটিত হওয়ার পরে, সেই বাংলাবাসীই হাত কামড়েছে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করার জন্য। 

মূলত যেটা দেখা যাচ্ছে, বাঙালী "অরাজনৈতিক" হওয়ার চক্করে কখনো সুযোগ হারায়, কখনো ব্যবহৃত হয়। সম্ভবত ৭০-এর দশকে ছাত্রদের চরম রাজনৈতিক চরিত্রের ফলে যে করুন পরিণতি হয়, এবং হাজার হাজার ছাত্র-যুবরা মারা যান, তার কারণেই বাঙালী এখন রাজনৈতিক হতে ভীষণ ভয় পায়। বাড়ির বড়রাও বলেন ছাত্রদের রাজনীতির দিকে না এগোতে। যদিও এই ঘটনা খুব নতুন নয়, কিন্তু এর ফলগুলো নতুন নতুন করে বাঙালীকে সমস্যার মধ্যে রেখে দিচ্ছে। আমাদের শিবপুরে আমরা দেখেছি, কিভাবে কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের অরাজনৈতিক করার মাধ্যমে সমস্ত ধরণের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন। আমরা না বুঝেই "অরাজনৈতিক" হয়েছিলাম, তবে পরে উপলব্ধি করেছিলাম যে আমাদের বক্তব্য বলার মতো প্ল্যাটফর্মটা আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হল। সে কারণেই মনে হয়, "অরাজনীতির রাজনীতি"-এর এই ধোঁকাটা বন্ধ হওয়া দরকার। "অরাজনীতি" বলে যে কিছু হয়না - সেটা বোঝা দরকার।বাঙালী যদি রাজনীতিটাকে অস্পৃশ্য করে না রেখে, সুস্থ এবং দায়িত্বশীল একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারতো, তাতে তাঁদের নিজেদেরই মঙ্গল হত। আশা রাখবো, ভবিষ্যতের আন্দোলনগুলো গঠনমূলক রাজনৈতিক পরিচিতি পাবে, এবং সেখান থেকে এক বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের পরিসর গড়ে উঠবে।

Thursday, August 30, 2018

শিল্পকলা নিয়ে নোটস - ২ | Notes on Arts - 2

আগের নোটে শিল্পের ক্লাসিকাল এবং মর্ডান ধারার মধ্যে একটা মেলবন্ধনের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে, শিল্পের বিষয়বস্তু বোধগম্য না হওয়ার একটা কথা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। সেটা নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করা যাক।

শিল্পকে বুঝতে পারার জন্য যেমন নমনীয়, অনুভূতিপ্রবণ একটা মনন দরকার হয়, তেমনি একটা বিশ্লেষণী ক্ষমতাও লাগে। তবে সেই বিশ্লেষণী ক্ষমতার কথা বেশি করে ভাবলে শিল্প আর শুধু অরগ্যানিক একটা বস্তু থাকে না, যার সৃষ্টি নাকি কোনো এক অদৃশ্য শক্তি, ক্ষমতা বা অনুভূতির ওপর নির্ভর করে। এই বিশ্লেষণী ক্ষমতা শিল্পকে কিছুটা যান্ত্রিক বা মেকানিকাল করে ফেলে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।

কোনো "ভালো" গানের কথা ধরা যাক, যেমন অঞ্জন দত্তের "বেলা বোস" বা ক্যাকটাসের "হলুদ পাখি"। আমরা যদি ভেবে নিই, এই গানগুলোর সুর তৈরি হয়েছে শুধুমাত্রই অনুভূতি দিয়ে, মানে অঞ্জনবাবু কোন মনখারাপের বিকেলে "বেলা বোস"-এর কথার সাথে সুর তৈরি করেছেন, তাহলে হয়ত শিল্পের একটা আলাদা বায়বীয়তা, মাধুর্য, স্বর্গীয় ভাব তৈরি হয়। কিন্তু আমরা একটু গভীরে গিয়ে দেখবো যে, এই দুটো গানেই শুধুমাত্র ডি মেজর key-এর বিভিন্ন কর্ড ব্যবহার করা হয়েছে। হয়তো অঞ্জনবাবু বা ক্যাকটাসের মনে মনে হৃদয় থেকেই ডি মেজরের কর্ড গুলোই এসেছে। কিন্তু আমাদের এটাও দেখতে হবে যে, এরকম একটি স্কেলের মেজর কর্ড গুলো মানুষের কানেও শ্রুতিমধুর হিসেবে শোনায়। সেই সূত্র ধরেই এনারা পুরো গানের সুরটাকে বেঁধে ফেলেছেন।

এভাবে শিল্পের বিশ্লেষণ করতে বসলে দেখা যায়, প্রত্যেক শিল্পেরই কিছু ব্যাকরণ আছে। গানের যেমন major বা minor key-এর কর্ডস। এই ব্যাকরণ দিয়েই প্রত্যেক শিল্পের আলাদা কিছু ভাষা তৈরি হয়। যখন কোনো শিল্পী সেই ভাষায় কথা বলে কোনো শিল্প সৃষ্টি করছেন, তখন আমাদের কাছে তা ভীষণ ভালোলাগার এনে দিচ্ছে, যদি আমরা সেই ভাষা বুঝতে পারি। কিন্তু যখন আমরা সে ভাষা বুঝতে পারছিনা, তখন সেই শিল্পকে আমাদের গ্রহণ করতে সমস্যা হচ্ছে। সে জন্য পন্ডিত আমীর খাঁ-এর "সাহানা" রাগ আমাদের কারো কারো কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ওই রাগের যে ভাষা, তার স্বাদ বুঝতে পেরে তার শিল্পরসে ভেসে যাচ্ছেন।

শিল্পের এই ভাষা শেখানোর জন্যই আজকাল বিভিন্ন আর্ট স্কুলগুলো তৈরি হয়েছে। এই স্কুলগুলিতে প্রচলিত শিল্প-ভাষাগুলি শেখানো হয়ে থাকে। তাই কেউ যদি কোনো শিল্পের সম্পূর্ণ মাদকতা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হয়, তাহলে সে এই আর্ট স্কুলগুলোর শরণাপন্ন হতে পারে, অথবা নিজে থেকে সেইসব ভাষাকে রপ্ত করার চেষ্টা করতে পারে। তবে প্রচলিত ভাষা যেমন আছে, তেমনি সেই ভাষাকে ভেঙে দেওয়াও আছে।

আমরা যদি সত্যজিত কে দেখি, তাহলে দেখতে পাবো, সিনেমার ভাষা মেনে নিয়ে তিনি অকল্পনীয় কিছু সিনেমা তৈরি করে গেছেন। তার সিনেমাগুলো তখনকার ওয়েস্টার্ন ফিল্মের যে ভাষা, তার সাথে সামঞ্জ্যপূর্ণ। সত্যজিৎ নিজেও একাধিক সাক্ষাৎকারে তার এই ওয়েস্টার্ন ফিল্মের অনুপ্রেরণার কথা বলেছেন। বিপরীত দিকে আছেন ঋত্বিক। তিনি সিনেমার সব প্রচলিত নমনীয় ভাষা, ন্যারেটিভ ভেঙে দিচ্ছেন। ফলত প্রথমে মানুষ সেই ভাষাকে নিতে পারছেনা। কারণ একটা নতুন ভাষা বুঝতে পারা তো বেশিরভাগ জনগণের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা ঋত্বিক-এর বেশিরভাগ ফিল্মকে পছন্দ করেছেন না। কিন্তু "যুক্তি তক্ক গপ্প" একটা ল্যান্ডমার্ক ফিল্ম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে, আর এ জন্যই ঋত্বিক এর ছবিগুলোকে এখন বিভিন্ন ফিল্ম স্কুলে গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়ে থাকে। যাতে শিক্ষার্থীরা এই ভাষা সম্পর্কে অবগত হতে পারেন।

এর পরে প্রশ্ন আসতে পারে, শিল্পীরা তাদের শিল্পের উৎস ঠিক কোথা থেকে পেয়ে থাকেন। যে কোনো শিল্পের উৎকর্ষতা তো সেই শিল্পের সততা আর তার ভাষার উপর নির্ভর করলো। কিন্তু সেই উৎকর্ষ শিল্পের অনুপ্রেরণা কোথায়? এ নিয়ে পরের নোটে ভাবার চেষ্টা করবো।
(চলবে)

Wednesday, August 22, 2018

কাউকেই চিনি না - Don't know anyone!

Boston, 22-Aug-2018, 10:00 PM

আমার কোনো মুসলিম বন্ধু নেই,
আমার কিছু বন্ধু আছে যারা মুসলিম,
আমার কিছু বন্ধু আছে যারা ঈদের দিন নতুন জামাকাপড় পরে,
কখনো আমাকে সুস্বাদু বিফ খাওয়ায়।
আমার কোনো হিন্দু আত্মীয় নেই,
আমার কিছু আত্মীয় আছে যারা পুজো-আচ্চা করে,
ভালো সিন্নি বানায়।
আমার কোনো বিহারী সহপাঠী ছিল না,
আমার কিছু বন্ধু আছে যারা আমায় প্রথম লিট্টি খাইয়েছিল।
আমার কোনো চেনা মাড়োয়ারি দোকানদার নেই,
পাড়ার মিষ্টির দোকানের মালিক জাগেতিয়া বাবু
আমার প্রিয় মিষ্টির খোঁজ রাখেন,
ওনার কাছে ওদের জয়পুরের বাড়ির গল্প শুনেছি।
আমি কোনো তামিল ছেলেকে চিনিনা,
তবে আমার রুমমেট আমাকে নিখুঁত ধোসা বানানো শিখিয়েছে।
আমি কোনো পাকিস্তানী মেয়েকে চিনিনা,
আমেরিকায় আমার ল্যাবমেট আমার সাথে হিন্দিতে লাহোরের গল্প করে।
আমার কোনো মেক্সিকান কলিগ নেই,
পাশের কিউবিকলের ছেলেটার জানে কোথায় ভালো টাকো পাওয়া যায়,
আমরা মাঝে মাঝে একসাথে খেতে যাই।

আমি আজকাল কাউকেই চিনিনা,
আমি শুধু কিছু মানুষ চিনি, মান-হুঁশ।

Sunday, August 19, 2018

শিল্পের আধুনিকতা নিয়ে নোটস - ১ | Notes on Modernity of Arts - 1

ভাবনাগুলোকে অক্ষরে চালান করতে করতে বুঝতে পারছি এগুলো মূলত নোটস। সেরকমই শিল্প আর তার আধুনিকতা নিয়ে বহুদিন ধরেই মনের মধ্যে ভাবনার অযাচিত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। তা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে বেশ ক্লান্ত। এ নিয়ে বেশ কয়েকজনের সাথে অনেক বার আলোচনাও হয়েছে। এবার বোধ হোয় এই ভার নামিয়ে রাখার সময় হয়েছে, সুতরাং লিখন।

শিল্পকে এক হাজার ফুট উঁচু থেকে মূলত দুই ধারায় ভাগ করে নেওয়া যায় - ক্লাসিকাল আর মডার্ন। ক্লাসিকাল এর কথায় পরে আসছি। আধুনিক এর কথা দিয়ে শুরু করি, খুব সাবজেক্টিভ একটা ব্যাপার। বাংলা গানের আধুনিকতা নিয়ে লেখাটায় বলেছিলাম যে, সমসাময়িকতা আমার কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা বয়ে আনে। তাই সলিল চৌধুরী যখন কৃষকদের জমির অধিকারে স্বাধীনতার পরেই "হেই সামালো ধান" লিখছেন, আমার কাছে উনি ভীষণ আধুনিক হওয়ে উঠছেন। বব ডিলান যখন বিশ্বের নাগরিক অধিকারের জন্য, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লিখছেন, "টাইমস দে আর চেঞ্জিং", তিনি আমার কাছে ভীষণ পরিমাণে "আধুনিক"। আমি প্রধানত আধুনিক শিল্পকেই ভালোবাসি। ক্লাসিকাল এর প্রতি আমার তেমন আসক্তি নেই।

ক্লাসিকালকে এ হেন বুড়ো আঙুল যখন দেখাচ্ছি, তখন তার পিছনে অনেকগুলো কারণও আছে। নিখিল ব্যানার্জী যখন "মেঘ" রাগে পরিবেশমন্ডলীতে গভীর নিম্নচাপ তৈরি করেছেন, আমি আধঘন্টার জন্য সেই আবহাওয়াতে মিশে যাচ্ছি বটে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না, কি হচ্ছে! উনি যে কোথা দিয়ে আমাকে নিয়ে চলেছেন, সেই রাস্তাই চিনতে পারছি না। এই যে বিমূর্ততা, এটাই তো ক্লাসিকাল শিল্পের প্রাণ ভোমরা। এই বিমূর্ততা কে আমি ধরতেই পারছিনা, আমার অপারগতা। তাই ক্লাসিকাল শিল্পকে আমি আমার শিল্প বলে ভাবছিনা। ঠিক পছন্দ করতে পারছিনা।

এসব বলার পরে, জর্জ বিশ্বাস যখন "আকাশভরা" শুরু করছেন তখন তো আমি মহাবিশ্বের সাথে নিজেকে আর আলাদা করতে পারছিনা। তখন আমি, রবীন্দ্রনাথ, জর্জদা - একসাথে বসে আছি আমরা। সকলে মিলে পথের পাঁচালী দেখছি। যা কিনা আদ্যন্ত একটি ক্লাসিকাল ছবি, অন্তত আগে বলা আধুনিকতার সংজ্ঞা অনুযায়ী। তাহলে আধুনিকতার একটা নতুন সংজ্ঞা বানাতে হয়, কারণ শুধু সমসাময়িকতা দিয়ে আধুনিকতাকে আর বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। এই নতুন সংজ্ঞায় নিয়ে আসতে হচ্ছে "খোঁজ"।

চন্দ্রিলবাবুর বক্তব্যকে একটু বিস্তৃত করে বলা যায়, যে শিল্পের মধ্যে এক নিরন্তর সন্ধান চলেছে, সেই শিল্পই আধুনিক। সে খোঁজ নিজেকে চিনতে পারার হতে পারে, বা শিল্পকে উত্তরণের হতে পারে অথবা কোনো এক বিমূর্ত খোঁজ, যা কিনা আসলে সন্ধান পাবার পরও বিমূর্ত থাকবে। সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী ক্লাসিকাল শিল্পভাবনা এক চূড়ান্ত আধুনিকতায় পরিবর্তিত।

পন্ডিত আমীর খান "বসন্ত" রাগে যখন বিস্তার করছেন, তখন তো মনে হচ্ছে উনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই সর্বশেষ অনুভূতিকে যা বসন্তকে বয়ে আনবে। যে বসন্তের ছায়াছবি তাঁর মনে, হৃদয়ে, মস্তিষ্কে খেলা করছে, সেটাকেই সুরের মধ্যে প্রকাশের এক সর্বোত্তম চেষ্টা। সেই আল্টিমেট অনুভূতিকে নিরন্তর রূপ দেওয়ার চেষ্টাই সার্থক করে তুলছে ক্লাসিক্যাল শিল্পকে। কিন্তু কোনো শিল্পই তো সার্থক নয় এই সন্ধানটুকু ছাড়া। সত্যজিৎ- এর অন্যতম "আধুনিক" কীর্তি, প্রতিদ্বন্দ্বীর শেষ দৃশ্যটা মনে পড়ে যায়। সেই ছোটবেলার নাম-না-জানা পাখির ডাকটা। সেটারই তো খোঁজ সারা ছবিটা জুড়ে। ওই মিষ্টি ডাকটা, ওই সরল ডাকটা, যেটার মধ্যে লুকিয়ে আছে সব অন্তর্দ্বন্দ্বের অবসান। সেটার সন্ধানেই তো কি ভীষণ আধুনিকতা সত্যজিৎ-এ।

এই পর্যন্ত এসে ক্লাসিকাল আর আধুনিক সম্পূর্ণ মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলেছি। নবারুণ এর ছোট গল্প কিস্যু বুঝতে পারছিনা। অথচ মানুষটি কি ভীষণ "আধুনিক"। ওনার কবিতা দিয়েই তো আশা নিয়ে বাঁচছি, চেষ্টা করছি, যেন "একটা কথার ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে" পড়ে, হোক সারা সহর উথাল পাথাল। আধুনিকতা তছনছ করে দিক চারপাশের এই মেকী পরিপাট্য। এবং তার পরেই হয়ত একটা নতুন সূর্য উঠবে, "লাল সূর্য" পূর্ব দিকে। সব কিছু তখন কোমলতায় ভরে গেছে। পন্ডিত আলী আকবর খাঁ তখন ভৈরবী বাজাচ্ছেন। রাগেদের সাথে নাকি অনেকটা সময় কাটাতে হয়, তবেই নাকি তাদের বোঝা যায়। আমিও হয়ত একটু একটু করে বেশি সময় কাটিয়ে, রাগসহ অন্যান্য ক্লাসিকাল শিল্পের বিমূর্ততা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করবো। যেখানে অন্তর্দ্বন্দ্বের সাথেই সহাবস্থান করবে পরিতৃপ্তি বা রেসোলিউশন।
(চলবে)

Sunday, June 17, 2018

পর্দার ওপারে - On the other side of the curtain

Austin, Texas, 18-Jun-2018, 2:17 AM

দুঃখ তখন বৃষ্টি ফোঁটায়, খুব ক'রে মেঘ ঈশান কোণে,
বাদল ঘনায় মনের কনায়, তবুও যেন কেউ না জানে। 

সবাই কেমন বহিরাগত, ভিতরপানে চায় না কেউ,
মনেই গড়া মস্ত দেওয়াল, আটকে দিচ্ছে সুজনকেও।

বয়স হওয়ার অধীর ভারে চুঁইয়ে পড়ছে বিষন্নতা,
কাছের মানুষ, দূরের মানুষ - ভীষণরকম একাত্মতা।

মনের সাথে একলা থাকার এই আদুরে গল্পখানি,
মেঘলা হাওয়ার স্পর্শ লেগে একটুমতো অভিমানী।

Wednesday, June 06, 2018

সাম্যবাদী গণতন্ত্র - Communist Democracy

টুকাইয়ের বাড়িতে মাটির ওপর আসন পেতে বসে স্টিলের থালায় মাংস-ভাত খাচ্ছিলাম। ওর মা সামনে বসেছিলেন। সবশেষে টমেটোর চাটনিও ছিল, কাকিমা বেশ সুন্দর বানিয়েছিলেন। সেবারে টুকাইয়ের জন্মদিনে বেশ মজা হয়েছিল, সাজ্জানলালও এসেছিল। আমি একটা পেন্সিলবক্স উপহার দিয়েছিলাম টুকাইকে, তাতে কয়েকটা খুব সুন্দর পেন্সিল ছিল। তার আগের দিনই ওকে অঙ্কের মাষ্টারমশাই আলম স্যার ক্লাসের বাইরে নীল ডাউন করিয়ে দেন, ক্লাসে লেখার সময় ওর নিজের পেন্সিল না থাকায়। সেজন্যই বোধ হয় ওর খুব পছন্দও হয়েছিল পেন্সিলবক্সটা। ও খুব খুশি ছিল সেবার। আমাদের দুপুরের খাবারের একটু আগেই কেক কাটা হয়েছিল; এই পাশেই, ওদের শোয়ার ঘরে। অবশ্য যা ওদের শোয়ার ঘর, সেটাই ওদের বসার ঘর, সেটাই আমাদের ট্রাম্প কার্ড খেলার ঘর - সবই ওই এক ঘর। কারণ ওদের একটাই ঘর ছিল তখন, এবং সেটাই ওদের পুরো বাড়ি। বাইরে যে ছোট্ট মত জায়গাটায় আমরা খাচ্ছিলাম, সেই ছোট্ট মতো জায়গাটাতেই ওর মা, মানে কাকিমা রান্না করতেন। খেয়ে নিয়ে একটু গল্প করেই আমরা সেদিন স্কুলের মাঠে খেলতে চলে গেছিলাম, দৌড়ে দৌড়ে।

দৌড়োতে দৌড়োতে আমি ২৩বি নম্বর গেট-এ পৌঁছলাম, কিন্তু গিয়ে দেখলাম প্লেন ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। অবশ্য টুকাই দৌড়ে ৩৪ বি বাসটা ধরে ফেলেছিল ধর্মতলার মোড়ে, কে.সি.দাশ-এর অপোজিট-এ। এভাবে কিছু ট্রেন আমরা মাঝে মিস করেছি, কিছু প্লেন ধরে ফেলেছি। ঠিক মতো জানি না, টুকাই ঠিক কোন কোন ট্রেন বা বাসগুলো ধরতে পেরেছিল বা পারেনি। তবে এটুকু বুঝেছিলাম, আমার জন্য যে ট্রেনগুলো ছিল, সেগুলোর নাগাল পায়নি টুকাই। ওর আর্থিক অবস্থা থেকে পাওয়ার কথা ছিল না। হয়তো আমার ছোটবেলার বন্ধু সাজ্জানলালও কিছু একটা কাজ জুটিয়ে নিয়েছে এতদিনে, যদিও ওর একটা পা-এ সামান্য সমস্যা ছিল, খুঁড়িয়ে হাঁটতো। ওর আর কোনো খোঁজ পাইনি স্কুলের পরে, যেমন সামিউল-এরও পাইনি। টুকটাক কিছু খবর ছাড়া অন্য খবর পাওয়ার কথাও ছিল না। কারণ আমি ধীরে ধীরে আলোর দিকে চলে এসেছি। আর আমরা যখন আলোয় থাকি, অন্যদের স্রেফ কিছু সংখ্যায় পরিণত করি। তাই পেপারে আলাউল, টুকাই, সাজ্জানলালদের সম্পর্কে combined কিছু তথ্য পেয়েছি। বুঝতে পেরেছি ওদের জন্য কিছু উন্নতি হচ্ছিলো, আর অনেক কিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।

আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম আমাদের কাছাকাছি ও ব্যক্তিগত উন্নতিটা। একটা সময় মা উনুনে রান্না করতো, তারপর একদিন গ্যাসে এসে গেল। অন্যের বাড়ি থেকে আমাদের নিজেদের বাড়ি হচ্ছিল। টুকাইরা মাটি আর বাঁশের ঘর ছেড়ে পাকা ভাড়া-বাড়িতে উঠে আসছিল। কিন্তু এসবের পিছনের কাহিনীটা আরো পরে ধরতে আরম্ভ করি। সরকার থেকে চাকরি হচ্ছিল অনেকের, আমার বাবা-মা-আত্মীয়রা এই পরিবর্তনটার সাক্ষী ছিল। কিছু বেসরকারি চাকরিও দেখছিলাম। কিন্তু চাকরি তো এমনি এমনি হতে পারে না। এর পিছনে চলছিল লাগাতার আন্দোলন, শ্রমের অধিকার এবং মূল্যের জন্য। অনেক মানুষ মাঠে-ঘাটে নেমে এই আন্দোলনটা করছিলেন। তারা সত্যিকারের শ্রমের মূল্যের তত্ত্ব কতটা বুঝেছিলেন, জানিনা। কিন্তু তাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে শ্রমের প্রকারভেদ এবং নিজেদের সামাজিক অবস্থানটা যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাঁদের আন্দোলনের দিশাও ছিল, প্রাপ্তিও ছিল। একই জিনিস হচ্ছিল একটু গ্রামের দিকে, চাষিদের বাড়িতেও। মুশকিল হল - তাঁরা সকলেই বাস করছিলেন একটা গণতান্ত্রিক দেশে এবং আন্দোলন করছিলেন সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।

আন্দোলনকারীরা তাঁদের যথার্থ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে স্বচ্ছলতাটা আনলেন তাঁদের জীবনে, সেটা সকলের জীবনেই আনা সম্ভব ছিল না। কাজ কখনো একেবারে, একটা প্রজন্মের আন্দোলনে শেষ হতে পারে না, তার জন্য অনেকটা সময়, অনেকগুলো যুগ লাগে। ফলে অনেক মানুষ, এর পরেও, পিছনেই পড়ে রইলেন। কিন্তু একটা প্রজন্মের আন্দোলনের বয়ে আনা স্বচ্ছলতা একটা বৃহৎ গোষ্ঠীকে মূলত পঙ্গু করে দিল। এই খুব বড় জনগোষ্ঠীই হল আমাদের সোনার মিডল ক্লাস, মানে আমরা যারা মধ্যবিত্ত। আমরা একটা আপাত সুখের মাঝে বড় হলাম; বাবা-মা তাঁদের স্বভাববশত, তাঁদের কষ্টটা আমাদের কাছে যথাসম্ভব চেপে রাখলেন। আমরা বড় হয়ে কেউ প্লেন ধরলাম, কেউ ছুটে গিয়ে বাস ধরলাম। এইভাবে আমরা নিজেদের আরো উপরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করলাম বটে, কিন্তু অনেকেই এই দৌড়টায় পিছিয়ে পড়লো।

যারা পিছিয়ে পড়লো, তারা মনে করলো, তাঁদের পিছিয়ে পড়ার কারণ তাঁদের নিজেদের অক্ষমতা। অথচ আমরা যে সেই একই সমাজব্যবস্থায় বাস করছি, সেটা অনেকেই খেয়াল করলাম না। নাহ্, একটু ভুল বললাম, ঠিক একই সমাজব্যবস্থায় আমরা আর বাস করছিলাম না। একটা বৃহৎ গোষ্ঠী, যারা আমাদের আগের প্রজন্মে সক্রিয় ছিল, তারা এখন নিজেদের অক্ষম বলে ভাবতে শুরু করেছে। তাই ব্যবস্থাটাকে আর একই বলা যাচ্ছে না। এই এখনকার অক্ষম গোষ্ঠীটাতেই আগে ছিল আমাদেরই বাবা-মা-আত্মীয়রা, তাঁদের যুবক-সত্ত্বায়, যারা তখন মাঠে-ঘাটে নেমে আন্দোলনটা করছিল, শ্রমের অধিকারের জন্য, সঠিক চাকরির জন্য। কিন্তু আমরা বড় হয়ে সেই চাকরিটাকে হয় নিজেদের অধিকার অথবা চাকরি না-পাওয়াটাকে নিজেদের অক্ষমতা বলতে শুরু করলাম। ফলে যে গোষ্ঠীটা খুব সক্রিয় ছিল নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে আনায় বা প্রতিষ্ঠিত করায়, সেই গোষ্ঠীটা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল।

পুরোপুরি বিলুপ্তও বলা যায় না, বলতে হয়, সেই গোষ্ঠীটা ছন্নছাড়া হয়ে গেল। সেই গোষ্ঠীর কিছু লোক এখন ব্যাঙ্গালোরে হুইস্কি সহযোগে হাহুতাশ করে মমতা ব্যানার্জির শাসন নিয়ে, অথবা নন্দনে বিকেলবেলা হাওয়া খেতে খেতে সিপিএম-এর করুন দশা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, অথবা আমেরিকায় বসে এরকম একটা লেখা লেখে। এরা কিছুটা সচেতন সমাজের এই (অধঃ)গতিটা সম্পর্কে এবং সেখানে নিজেদের কিছু করতে না-পারার ব্যর্থতা সম্পর্কে। কিন্তু যেহেতু এদের আগের প্রজন্ম এদের একটা স্বচ্ছলতা দিয়েছে, একটা পরিসর দিয়েছে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বপ্ন-চাহিদাগুলো পূরণ করার, তাই তারা মূলত উদাস এবং প্রমাণসাপেক্ষে অপারগ, এই সমস্যা নিয়ে কিছু করার উদ্দ্যশ্যে।

এর পরও পড়ে থাকছে এই বৃহৎ গোষ্ঠীর আর একটা মূল উপগোষ্ঠী। যাদের এখনো সেই চাকরিগুলো দরকার, যেগুলো সক্রিয় আন্দোলন এবং সঠিক উন্নয়ন থেকে উঠে আসতে পারে। এই হল সেই গোষ্ঠীটা যারা গণতন্ত্রের এবং সর্বোপরি সাম্যবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে আসা স্বচ্ছলতার শিকার। এরা এখন হয় শাসক দলের তাবেদারী করতে বাধ্য বা সিভিক পুলিশে নাম লেখাতে। এদের কাছে সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তেমন কোনো উপায় নেই। কারণ এরা জানেনা, আন্দোলন করার মানে, এদের বড় হওয়ায় হয় মিশে আছে সামান্য শৌখিনতা, অথবা স্বচ্ছলতার মেদুর স্বপ্ন যা ২০০৩-০৪-এর "Shining India"-এর মতোই সত্যি। সেই স্বপ্নে কোনো আক্রোশ নেই, বাসনা নেই, শুধু আছে চাতকের চাহুনি। আর সেই চাহুনি চেয়ে আছে সমাজবাদী, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে, যা খানিকটা "সুখী" আন্দোলনে পর্যবসিত। তবে প্যারাডক্সটা এখানেই যে, সফল আন্দোলনের মূল জ্বালানি যে অনুভূতিটা, সেই আক্রোশ বা ক্রোধ নামক আবেগটা এখন প্রায় অনুপস্থিত এই গোষ্ঠীর ভিতর। ফলে আমরা কোথাও আটকে গেছি একটা ডেডলকের মধ্যে। কেউ কোনোদিকে চলতে পারছি না, কেউ দৌড়োতে পারছি না, কেউ মাটির কাছাকাছি যেতে পারছি না। আমরা শুধুই মাটির ওপরে সুন্দর হাতের কাজ-করা আসনটুকু দেখতে পাচ্ছি, পেতে চাইছি; ওর উপর বসে মাংস-ভাত খাওয়ার স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু আসনটা যে মাটিতেই বিছিয়ে দিতে হবে, এবং তার জন্য আসনটাকে যে মাটি ছোঁওয়াতেই হবে - সেটা মেনে নিতে রাজি হচ্ছি না। বর্তমান শাসকেরাও চান না আমরা রাজি হই, কারণ তারা এই পঙ্গু গোষ্ঠীটাকে ভোট জেতার মেশিনারি হিসেবেই কাজে লাগাতে ব্যস্ত। সাম্যবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন আমাদের যে দৌড়টা দিতে শিখিয়েছিল, আমরা খুব সহজে ভেবে নিয়েছি যে, তার বোধ হয় কোনো ফিনিশিং লাইন আছে। কিন্তু সেটা তো ছিল না, সেটার একটা চিরন্তন বহমানতা থাকার কথা ছিল। অথচ আমরা সেই কাল্পনিক ফিনিশিং লাইনে এসে অপেক্ষা করছি, আশা করছি, একটা উন্নততর পৃথিবীর, যেটাকে মরীচিকা ছাড়া আর কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সাম্যবাদী আন্দোলনের এটাই বোধ হয় সব থেকে বড় পরিহাস।
---

আলোচনা ও ভাবনা সহায়তা: শুভাশিস পাত্র

শুভাশিসের মন্তব্য: তোর এই লেখাটা পড়ে আমার মনে যে টা সব থেকে বেশি টাচ করেছে সেটা হল 'গোষ্ঠী'। শ্রেণী নয়। একদম ঠিক। যতদুর মনে পড়ে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার এর পর থেকেই শ্রেণী চেতনা হারিয়ে গেছে এসেছে গোষ্ঠীবাজি। তুই সেটাই দেখেছিস।
তোর দেখাটা সত্য। বামফ্রন্ট সরকার যখন থেকে কাজের সুযোগ তৈরী করতে সক্ষম হল, তখন আন্দোলনটা গোষ্ঠীগত আন্দোলন হয়ে গেছে, শ্রেণীগত চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার তাগিদে ভুলে গেল তুলনামূলক ভাবে অগ্রসর শ্রেণী এর সিংহ ভাগ সুযোগ আত্মসাৎ করবে। হলও তাই। সেই ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে মুক্তি পেতে ultimately মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর উদয় হলো। কিন্তু সেটাও মরিচীকা।

Sunday, June 03, 2018

সংরক্ষণ বন্ধ করার আগে - Before abolishing caste-based Reservation

দীপক মন্ডল ক্লাসের মাঝারি মাপের ছাত্র। প্রথমবার সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসে ভালো ফল করতে পারেনি। যদিও সংরক্ষণের সুবিধা অনুসারে তার চাকরি হয়ে যায়, কিন্তু সে কখনোই ওই সুবিধে নেয়নি। তাই অনেক খেটে, পড়াশোনা করে দ্বিতীয়বার আবার চাকরির পরীক্ষা দেয় এবং ভালো ফল করে। তারপর সরকারি দপ্তরে জেনারেল কোটাতেই তার চাকরি হয়। সরকারি চাকরি পাবার পর খুব খুশি ছিল দীপক। ভেবেছিল এবার সে সুলগ্নাকে বিয়ে করতে পারবে। সুলগ্না তার কলেজের প্রেম, সুলগ্না চক্রবর্তী। কিন্তু সুলগ্নার বাড়ি থেকে এই বিয়েতে রাজি হয় না। কারণ দীপক SC, আর সুলগ্নারা ব্রাহ্মণ। সুলগ্নার বিয়ে ঠিক হয় সপ্তর্ষি ভট্টাচার্যের সাথে। সুলগ্না দীপককে ভালোবাসলেও বাবা-মা-র ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেতে পারেনি, সপ্তর্ষিকেই বিয়ে করে ও। সুলগ্না এখন ভালই আছে।

সুলগ্নার স্বামী সপ্তর্ষি একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। সেই ফার্মেরই রাইভাল ফার্মে দীপকের বন্ধু আলাউল কিছুদিন আগে অ্যাপ্লাই করেছিল। আলাউল অ্যাপ্লাই করার পরেও কল পায়নি ফার্মটা থেকে। দীপক জানত আলাউল-এর যা প্রোফাইল, অন্তত ইন্টারভিউর জন্য ওকে ডাকা উচিৎ। দীপকের অন্য কিছু বন্ধুও ওই একই ফার্মেই কাজ করতো। দীপক তাদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, আলাউল-এর শুধুমাত্র নামটা দেখেই নাকি ওকে বাছাই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছ।

আগে আপনারা দীপক মন্ডল আর সুলগ্না চক্রবর্তীর ভালোবাসার বিয়ে সুরক্ষিত করুন। আগে আলাউল ইসলামকে সমাজে প্রাপ্য সম্মান আর মর্যাদাটা দিন, তারপর না হয়, আমরা সরকারি ক্ষেত্রে ওদের সংরক্ষণ তোলার ব্যাপারে ভাববো।

আগে আমাদের রাজ্যের পার্টি, সরকার এবং অন্যান্য প্রভাবশালী জায়গায় দীপক মন্ডল আর আলাউল ইসলামদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ুক, আগে বুদ্ধদেব "ভট্টাচার্য", মমতা "ব্যানার্জী"-এর ব্রাহ্মণ্য এলিটিজম বন্ধ হোক, তারপর নয় সংরক্ষণে ঠিক কি কি সুবিধে SC/ST-রা বেশি পাচ্ছে, সেটা ভাবা যাবে।