Sunday, November 20, 2016

মনখারাপের রংগুলি - Colors of Melancholia

শেষবার যখন বাড়ি ফিরেছিলাম, এক বন্ধু এক আড্ডায় বলেছিলো যে ফেসবুকটা হল এমন একটা জায়গা যেখানে সবাই তাদের জীবন কতটা ভালো সেটা প্রমান করতে ব্যস্ত। তখনই মনে হয়েছিল, সত্যিই তো, আমরা কে-ই বা আমাদের জীবনের খারাপ দিকগুলো তুলে ধরি! তুলে না ধরার অনেক কারণের মধ্যে প্রধান হল, করলেই তো অন্য লোকে স্টিরিওটাইপ এবং judge করতে শুরু করবে। সেই জন্য বেশিরভাগ মানুষই খারাপ দিকের কথা share করে থাকেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে হল, মানুষ তো তার স্বভাব-বশতই judgemental, তা আমি যা-ই করি না কেন! তাই ভাবলাম খারাপ দিকগুলো নিয়েও কিছু লেখা এখানে থাকুক। নিজের কাছে যেগুলো আছে, তার মধ্যে থেকেই কিছু কিছু। লেখাগুলোর নাম হোক, মনখারাপের রংগুলি।

পশ্চিমবঙ্গের শীতকালের রাতের একটা অদ্ভুত মায়াবী রূপ আছে। চারদিক ভীষণ শান্ত হয়ে যায়। হয়তো খুব দূরে হঠাৎ একটা ট্রেন বা মালগাড়ি চলে যাওয়ার আওয়াজ ভেসে আসে। তাছাড়া বাকি চরাচর জুড়ে এক বহুকাঙ্খিত প্রশান্তি। এতো ডামাঢোল, এতো অসুবিধে, এতো অস্থিরতা - এসব পেরিয়ে এসেও এই আশ্চর্য শান্তি মনে লেগে থাকে। জানিনা বাংলা ছাড়া আর কোথায় কোথায় এই শান্তি থাকে, তবে বস্টনের রাতে থাকে। এডমন্টনেও থাকতো। হয়তো এই শান্তি আসলে রাতের অন্ধকারে আমাদের মনে এসেই ধরা দেয়, কোনো স্থানের তোয়াক্কা না করে! আবার এই শান্তির সাথে পুরোনো কথা, মনখারাপ আর নস্টালজিয়া একসাথে আসে, এ যেন সেই ছোটবেলার এক টাকার চকোলেটের সাথে পাওয়া চরকিটা - যদিও দ্বিতীয়টা ফ্রিতে পাওয়া কিন্তু দুটোই সমান দামি।

সেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মনখারাপের রংগুলোতে আজ প্রথম ছোপ পড়ুক কলেজের।এখন স্থানীয় সময়ে যটা বাজছে, এই রকম গভীর রাতগুলোতে কলেজে কি হতো তার কথা বলা যাক। যে রেসিডেন্সিয়াল হোস্টেলে আমরা থাকতাম, সেই "ম্যাকডোনাল্ডস হল্"-এর সুপার উইং-এ ছিল আমার রুম। আমার রুমের দরজা বেশ রাত অব্দি খোলা থাকতো। তখন কেউ হয়তো আশেপাশের কোনো রুম থেকে আসতো আমার কাছে, হন্তদন্ত হয়ে। এসে বলতে শুরু করলো, "সোহম, সব শেষ, এভাবে পারা যায়না। আমি এভাবে বেশিদিন টানতে পারছিনা, আজ সব শেষ করে দিলাম, একদম final break-up." এবং তার পরেও কিছু কথা এই নিয়ে। অগভীর মন নিয়ে গভীর জীবনবোধ চর্চা করার চেষ্টা চলত।

সেই ছেলে চলে যাওয়ার পর হয়তো এলো আর একজন কেউ। যে হয়তো কলেজের অন্য সব রেসিডেন্সিয়াল হলগুলো ঘুরে এসেছে। তার কাছে অন্য লোকেদের খবর থাকতো, সেগুলো নিয়ে কথাবার্তা শুরু হতো। যাদের যাদের নিয়ে কথা হচ্ছে তাদের ফেসবুক দেখা থেকে শুরু করে কোনো সিনিয়রের লিংকড-ইন অব্দি দেখে ক্লান্ত হয়ে, সে চলে যেত। তার পরেই হয়তো আবার আগের ছেলেটি ফিরে আসতো, তবে এবার ধীরে ধীরে। তার এবার বক্তব্য, "জানিস মেয়েটা ভালোই, আসলে ওর আগের জীবনের এতো কষ্ট, তাই কখন কি করে, ঠিক থাকে না, সব মিটিয়ে নিলাম বুঝলি।"

এভাবে আধ-ঘন্টার ব্যবধানে মানুষের জীবন পরিবর্তন হতে দেখা চলতে থাকতো। কেউ হয়তো রাতে এসে দুটো গান গেয়ে গেলো। কারো আবার রাতে নাচতে ইচ্ছে করেছে বলে, কোনো অবক্ষয়ী বঙ্গ-মানসিকতার গান খুব জোরে স্পিকারে চালিয়ে, তারা নাচের মাধ্যমে শরীরের কিছু মেদ ঝরিয়ে গেলো। কোনো সিনিয়র এসে হয়তো আবার তার নতুন কবিতা শুনিয়ে গেলো, কিন্তু সেই কবিতার ভাষার সাথে পরমুহূর্তেই তার গালাগালির ভাষাকে মেলানো যেত না।

তবে এ শুধু আমার নয়, বছরের পর বছর, এভাবেই সব রেসিডেন্সিয়াল হোস্টেলের কোনো না কোনো উইং-এ এরই রকমফের হয়ে চলেছে। কারোর না কারোর দরজা এভাবেই এখনো খোলা আছে, আজ থেকে বহুবছর আগেও যেমন ছিল, আবার পরেও যেমন থাকবে। এখনও এখানে আমার নিজের একলা ঘরের দরজা রাতের দিকে খোলাই রাখি। এখানেও থাকে অন্য রুমমেটরা, আমার সাথে পাশের অন্য ঘরগুলোতে। শুধু এখন আর কেউ তাদের জীবন নিয়ে আমার দরজার এপারে আসে না। তাদের সাথে হয়তো এখন ফিফা খেলা হয় আজকালকার X-Box-এ। তবে সত্যিটা তো এটাই যে, আমাদের সবার জীবনেই মাঝে কেটে গেছে বেশ কতগুলো বছর। সবার জীবনের চারিদিকেই হয়তো এসে গেছে কতগুলো স্তর, সেগুলো নিয়ে বোধ আর নাড়াচাড়া না করাই ভালো। তাদের কথা, আমার কথা যে যার ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা খায় আর অবশেষে মিলিয়ে যায়। যেভাবে আমরাও মিলিয়ে যাবো একদিন...

No comments:

Post a Comment