আমেরিকায় কেউ এলে, বরফের ছবি, সুন্দর ন্যাশনাল পার্কের ছবি, বিদেশের রকমারি খাবারের কথা - এসব দেখতে শুনতে পেতাম বহুকাল ধরে। যদিও ছোটবেলায় এসব জানতাম না, কারণ চেনা-পরিচিত কেউ বিদেশে থাকত না। কিন্তু শিবপুরের মতো কলেজে ভাগ্যের জেরে পড়তে আসায় এবং ওখানকার সিনিয়রদের সুবাদে, আমেরিকার এই ঝাঁ-চকচকে দিকটার সাথে পরিচয় হতে শুরু করে। তখন ভাবতাম, তাহলে ওখানে বেশিরভাগ মানুষই নিশ্চই দুঃখে থাকে না। আমার চেনাপরিচিত বামপন্থী লোকজনদের জিজ্ঞেস করলে বলতো, "ওরা একটা ভোগবাদের দুনিয়া তৈরি ক'রে, মানুষকে আসল সমস্যাগুলো থেকে ভুলিয়ে রেখেছে।" এই অতিসাধারণ তত্ত্ব-টা মেনে নিতে সামান্য অসুবিধে হতো।
পরের দিকে যখন Occupy Wall Street আন্দোলন শুরু হল, তখনও আমার চেনা পরিচিত ফেসবুক দুনিয়ায়, তার কোনো রেশ দেখিনি। মনে হতো, তাহলে এই আন্দোলনগুলো করছে কে? প্রকৃতি যদি সেখানে তার শোভা মেলে দাঁড়িয়েও থাকে, লাস্যময়ী দুনিয়া যদি তার সমস্ত রূপ মেলেও দেয়, এই আক্রোশে থাকা মানুষগুলো কারা? আমার চেনাপরিচিত মানুষদের মধ্যে তাদেরকে কেন দেখতে পাচ্ছিনা? সেই প্রশ্নের উত্তর পাইনি, তবে এখানে এসে সেই মানুষগুলোকে খুঁজে পেতে শুরু করেছি, যারা আক্রান্ত। আজ শুরু করা যাক তাদের কিছু কথা বলার।
আমরা যখন ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে বলছি যে, বেশিরভাগ কাজের জায়গায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংগঠন বন্ধ করে দেওয়াই ভালো, তখন এখানে কিছুদিন আগে একটা বিচার দেয় সুপ্রিম কোর্ট। তারা বলে যে, Graduate Students-রা এবার থেকে সংগঠন করতে পারবে, যদি বেশিরভাগ ছাত্রেরই তাই মতামত হয়। এমনকি আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীরাও সেই সংগঠনে অংশগ্রহণ করতে পারবে। সেই প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে আমরা দ্বিতীয়বার মিটিং করি বস্টন ইউনিভার্সিটিতে। আমাদের বক্তব্য, আমরা Graduate Students-রা, একটা ইউনিভার্সিটির রিসার্চ, টিচিং থেকে শুরু করে গ্রেডিং পর্যন্ত করি, কিন্তু তার বদলে ইউনিভার্সিটির বড় বড় সিদ্ধান্তে, অনেক সময়েই আমাদের কোনো ভূমিকা থাকেনা। এছাড়াও STEM, মানে Science, Technology, Engineering, Math, -ছাড়া অন্য ডিপার্টমেন্ট গুলোতে মাইনে খুব একটা বেশি না। এর ফলে তাদের এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে অসুবিধে হতে থাকে। এই সব আরো কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে আমাদের ইউনিয়ন করার প্রস্তুতি চলছে।
অনেক বাধা আছে, অনেক রেস্ট্রিকশন আছে, কিন্তু বক্তব্য সেটা নয়। বক্তব্য হল, এই যে চোরা স্রোতটা বয়ে যায় যে কোনো দেশেই, সেটার কথাও সকলের জানা দরকার। কোনো দেশ তো একদম পারফেক্ট নয়ই। এখানেও রেললাইনে দেখেছি যথাসাধ্য maintenance না করার চিহ্ন। প্রচুর মানুষ ঘরছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়, ভিক্ষা করে এবং মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে যায়। Consumer-দের স্বাধীনতা এখন Corporate-দের স্বাধীনতায় পরিণত। কিন্তু আমেরিকাতে যে লোকে এখন অন্য ভাবে ভাবছে, (এবং ভীষণ বেশি করে ভাবছে) সেই কথাটাও তো জানা জরুরি, বিশেষ করে আমার ঘরের দেশের মানুষদের।
তবে ভারতে শুধু নয়, সারা বিশ্বের নিরিখেই আমরা এক খুব অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। এতদিনকার সিস্টেমের হর্তাকর্তারা বুঝে পাচ্ছেন না, আমাদের সিস্টেমের এই দুর্দশার পরবর্তী সমাধানটা ঠিক কি হতে পারে। তারা ভীষণ confused. সেই সুযোগে, উঠে আসছে, ট্রাম্প, brexit এবং ৫৬ ইঞ্চি। জানি ৫৬ ইঞ্চিকে এই দলে দেখলে অনেকে রেগে যান, কিন্তু আমি মানুষের উদারমনস্ক, নিরপেক্ষ, objective চিন্তা-ভাবনার উপর বিশ্বাস রাখলাম। তাছাড়াও সারা বিশ্বকে একটা প্যাটার্নের মধ্যে বাঁধার প্রয়াসের মধ্যেও ওটা পড়ে। তাই ৫৬ ইঞ্চির উত্থান, সেই প্যাটার্নের একটা অংশ বলেই মনে করি। সারা বিশ্বের সেই ভয়ঙ্করতম প্যাটার্নের মধ্যেও, ওই যে কিছু লোক চেষ্টা করছেন, একটু অন্য ভাবে ভাবার, তারাই কিন্তু আপাতত মানবজাতির আশা। আর এই আশার কথা চিরকাল বলে যাওয়ার চেষ্টা করবো। The Shawshank Redemption-এ তো Andy বলেছিল, "Hope is a good thing, maybe the best of things, and no good thing ever dies." এবার মানুষের, মানে আমাদের সবার উপর নির্ভর করছে, আপনারা সেই আশার অংশীদার হবেন, নতুন ভাবনার অংশীদার হবেন, নাকি গতানুগতিকতার !
শেষ করবো, আপনাদের এতটা অব্দি পড়া হলে কি মনে হতে পারে - সেটা দিয়েই। একবার আমার সাথে এক বামপন্থী মনোভাবাপন্ন প্রফেসরের কথা হচ্ছিলো। তিনি তখন বলছিলেন, কিভাবে IITKgp-তে তাঁর সময়ে, তাঁর অনেক বন্ধু ট্রটস্কি-কে সমর্থন করতেন। তো আমার এক জায়গায় প্রশ্ন ছিল, এই বিশাল বিশ্বে আমি একটা ক্ষুদ্র মানুষ হয়ে কি-ই বা করতে পারি, নেতা হওয়া তো আমাদের কাজ নয়। উনি বলেছিলেন, যে মনোভাবটা রেখেছো, শুধু সেটা রেখে দিতে পারো, ওটুকুই তোমার কাজ। সেটুকু করতে গিয়ে, বাকি যদি আর কিছু হয়, তো হবে, কিন্তু সেটা তোমার হাতে নয়। আমাদের মতো মানুষেরা এটুকুই করতে পারি। ওনার সেই কথার সূত্র ধরেই এখন বলবো এবং পরেও হয়তো বারবারই বলবো, নিজের মনোভাবটা দেখুন, আর সেই মনের ভাবনা দিয়ে কিসের অংশীদার হবেন সেটা ভাবার চেষ্টা করুন। এরকম এক-এক জনের চেষ্টাতেই তো সংখ্যা বাড়ে, মানুষ বাড়ে। আর Bernie Sanders-ও বলেন, "*We* all have the power to make history.", হ্যাঁ, "মানুষই ইতিহাস রচনা করে।" এরকম যদি সকলেই মনে করতে থাকে, তাহলেই হয়তো ভবিষ্যৎটা আমাদের হাতে আসবে, নচেৎ গোলাপি মানুষ আর ৫৬ ইঞ্চি !