একটা প্রলম্বিত জেটল্যাগ চলছিল। সেটা শেষ হওয়ার আগেই একটা বড় ফ্ল্যাশব্যাক চোখের সামনে ভেসে উঠলো - এডমন্টনে (কানাডা) সেদিন মাইনাস ২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা, মনের উষ্ণতা তখন আরো অনেক অনেক কম, কোনো এক বিশেষ কারণে। সেই সমস্ত শীতলতা পেরিয়ে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো। বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি বাস মিস করেছি, অথচ সেদিনই কোর্সের ফাইনাল প্রেজেন্টেশন। তুষারপাতের মধ্যেই দৌড়েতে শুরু করলাম।
দৌড়োতে দৌড়োতে আবহাওয়া একটু ভালো হল, রোদ বেরিয়ে এল, চারিদিকটা ঝলমল করে উঠলো, তখন আমি দাঁড়িয়ে আছি বস্টনের নতুন সম্ভাবনার সামনে। হলুদ রঙের একটা বিল্ডিং, ততোধিক হলদে তার অন্দরের আভরণ। সেখান থেকে কাজ করে যখন বেরোলাম, রাত তখন সাড়ে বারোটা বাজে।
পেপারটা সাবমিট করতে পেরেছি রাত বারোটার ডেডলাইনের ভিতরেই। বাইরের কমনওয়েলথ অ্যাভিনিউর বেশিরভাগ দোকানপাট তখন বন্ধ, টেক-আউট কিছু রেস্তোরাঁ আর পিৎজার দোকান খোলা। একটা ঠান্ডা হাওয়া এসে মুখে লাগতে মনটা একটু হালকা হলো। বাবা মারা গেছে তখন দিন ১৩ হয়েছে, হয়তো কোনো অলৌকিক কারণবশত এই পেপারটাই পরে আমার পি.এইচ.ডি-র প্রথম অ্যাকসেপ্টেড পেপার হল। অস্টিনে যখন পেপারটা প্রেসেন্ট করতে যাওয়ার আগে হোটেলে বসে এই কথা ভাবছি, তখনই আর একটা দুঃসংবাদ পেলাম।
দাদু মারা যাওয়ার খবরটা আত্মস্থ করতে না করতেই, রাস্তায় সমস্ত যানবাহন স্তব্ধ হয়ে গেলো, ইউনিভার্সিটি অফিস সব বন্ধ হলো একে একে। একবার গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলো রাস্তায় অনবরত অ্যাম্বুলেন্সের শব্দে। আমরা মুখে পরলাম মাস্ক, চলে গেলাম আইসোলেশনে। নিজের শরীরের ক্ষত সারিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াতে রোদ পড়লো চোখে, ছায়া পড়লো রাস্তায়। পাশে দাঁড়ালো আর একটা ছায়া।
ছায়ারা বাড়তে বাড়তে পৌঁছলো গোল্ডেন স্টেট ক্যালিফোর্নিয়ায়, ছোট্ট এক বাসা বাঁধলো নিজেদের। এখানে তুষারপাত হয়না, তবে মাইলের পর মাইল গাড়ি চালিয়ে যেতে হয়। কোথাও যেন ভীষণ স্বাধীন মনে হল নিজেদের। সেই স্বাধীনতায় আরেকটু প্রাণ এল, ভীষণ মিষ্টি সে প্রাণ, গোল গোল করে তাকিয়ে দেখে। তার শব্দ খিলখিলিয়ে হৃদয় স্পর্শ করে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, একসময় মনে হল, আর কোনো জেটল্যাগ নেই। আমরা তখন ভারতের ফ্লাইটে উঠে বসেছি, প্লেন চলেছে কলকাতার উদ্দ্যেশ্যে।
No comments:
Post a Comment