আমরা ছুটছি সহস্রবছর ধরে। আমাদের নিজেদের ঘরবাড়ি যে ছিলনা তা নয়, তবু আমরা ছুটেছি হাজার হাজার বছর। এভাবে দৌড়োতে দৌড়োতেই আমাদের সারা পৃথিবী আবিষ্কার করা হয়ে গেল, তাও বেশ কয়েক শতক পেরিয়ে গেছে। তারও বহুযুগ বাদে আমরা সকলে নিজেদের দেশ পেলাম - nation-state । কিন্তু তা খায় না ভালোবাসতে হয়, তা না বুঝেই আমাদের মধ্যে একটা দেশের ভাবনা কিন্তু ছিল। আমাদের ঘরবাড়ি, পাশের বাড়ি - প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, মুখের গড়ন, গায়ের রং - এসমস্ত আরো অনেক অনেক কিছুর সম্মিলিত ধারণা নিয়ে আমাদের একটা সামাজিক দেশ ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ তৈরীর আগেই আমরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছি, একসাথে লড়েছি।
এই যে দেশ - country বা রাজনৈতিকভাবে nation-state - এর পরিধি অনেক অনেক বিস্তৃত। তাই দেশের কথা বললে, দেশের প্রতি ভালোবাসার কথা বললে - তা অনেকসময়ই গুলিয়ে যেতে পারে, বা বলা ভালো, আমাদের কাছে গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বিস্তৃত পরিধির শুরুটা সম্পূর্ণ একটা ব্যক্তিগত পরিসর থেকে। বাবা-মা-ভাই-বোন দিয়ে যে ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি শুরু হয়, জীবন যত গড়ায়, সেই ভালোবাসাই অনেক খাতে বইতে থাকে। পাড়ার বন্ধু, চেনা কাকু-কাকিমা, কলেজের প্রেমিকা হয়ে সেই ভালোবাসা ধীরে ধীরে এমন এক বিমূর্ত রূপ নেয়, তাতে সমাজের যে কোনো মানুষকে ধরা যায়। তাকে কখনো জাতির প্রতি ভালোবাসা বলা যায়, বা কখনো দেশের প্রতি। তবে আসলে সেই ভালোবাসা ব্যক্তিগত - খুব যত্নে পেলবতা দিয়ে তৈরী করি আমরা - তাই পরে এক পূর্ণ প্রস্ফুটিত রূপ পায়।
দেশের সম্পর্কে এই ধারণাটা আমাদের কাছে নতুন নয়। কিন্তু খুব সুচারু ভাবে, পরিকল্পনা করে, ধীরে ধীরে এই পরিষ্কার ধারণাটায় প্রথমে ধোঁয়াশা আনা হয়েছে, তারপর এখন প্রায় শিকেয় তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন দেশের প্রতি ভালোবাসার নামে মানুষের কথা আসে না, সে ব্যক্তিগত পরিচিতির মানুষ হোক বা সামাজিকস্তরের। এখন বিভিন্ন দেশ হল বিভিন্ন আইডিয়ার প্রতিনিধি - যেগুলোকে ধরাছোঁয়া যায়না, যেগুলোর শুধু ছবি আঁকা যায় বা স্বপ্ন দেখা যায়। যেমন ভারত মানে হিন্দু রাষ্ট্র বা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, আমেরিকা মানে আমেরিকান ড্রিম, ব্রিটেন মানে অ্যারিস্টোক্রেসি, চীন মানে ম্যানুফ্যাকচারিং বা কম্যুনিস্ট পার্টি।
এখন দেশ আর দেশের মানুষ আলাদা। দেশের সাথে সেই দেশের মানুষকে আলাদা করার জন্য প্রথম যে কাজটা করা হল - আমাদের সবথেকে কাছের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে অর্থহীন করে দেওয়া। বাবা-মা-ভাই-বোনকে দিয়ে এই অর্থহীনতার শুরু, কিন্তু এদের থেকেও বেশি অগ্রাধিকার কাকে বা কোন বিষয়কে দেওয়া যেতে পারে? একমাত্র বিকল্প সে নিজেই কেউ। সেই গল্পেই বলা হলো - আমাদের পেশা এবং আমাদের কর্মজীবন এইসব ব্যক্তিগত সম্পর্কের কাছে তুচ্ছ। ব্যক্তিগত এবং পেশাগত চয়েসগুলোর মধ্যে একটা ট্রেডঅফ থাকে, এবং যে কোনো ট্রেডঅফের মতোই তার মধ্যে একটা ব্যালেন্সের জায়গা থাকে। কিন্তু আমাদের নিদান দেওয়া হল - যে কোনো একটা বেছে নিতে। শুধু তাই নয়, আমরা যখন সকলে পেশাগত দিকে ছুটে চললাম, ব্যক্তিগত সম্পর্ককে উপেক্ষা করে, তখন আমাদের এমন ভাবখানা হল, যে এটা কোনো আপোষ নয়, এটা আমাদের প্রগতিশীলতা, এটাই ভবিষ্যৎ।
সবথেকে কাছের সম্পর্ক উপেক্ষা করার পরিবেশ যখন তৈরী হয়ে গেল, তখন তথাকথিত দেশ ধারণাটার বাকি কাঠামোটা ভাঙতে আমাদের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। আমরা অচিরেই বললাম, আমাদের পুরোনো বন্ধুবান্ধব, অন্য আত্মীয়-স্বজন, পাড়া, রাজ্য, সমাজ, দেশ কিছুই আমাদের কাছে ম্যাটার করে না। আমরা হয়ে গেলাম বিশ্বমানবতার অংশ, গ্লোবাল-গ্রোথ এর চালিকা, অথচ আমরা নিজের বলে যা কিছু মনে করি, তাদেরকেই অপাংক্তেয় করে দিয়েছি ততদিনে। তার সাথে সাথেই চললো অন্যদিক থেকে আমাদেরকে ক্রমাগত কোণঠাসা করার কাজ। আমাদেরকে দৌড়তে বলা হল সুযোগ আর টাকার দিকে। আমাদের মধ্যে তৈরি করা হল অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা। আমাদের পেনসন এবং রিটায়ারমেন্টকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেওয়া হল। ফলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক যে শুধু পিছনে পড়ে রইলো তা নয়, আমরা নিজেদেরকে কখনও খুশি করতে পারলাম না।
আমরা নিজেদের পেশা, লক্ষ্য আর নতুনত্বের সন্ধানে আরো জোরে ছুটতে থাকলাম। সাথে হয়তো কখনো কোন সঙ্গীকে নিলাম - বিয়ে হল - অথবা একাই বেরিয়ে পড়লাম লক্ষ্যহীনভাবে, পেশাগত, বিত্তগত উচ্চতার শিখরে পৌঁছাতে। এই সফরে ভাবনা কম, কর্ম বেশি - ভাবনাহীন কর্মের অবিরাম লালন। দৌড়োতে দৌড়োতে উদ্দেশ্যও পরিবর্তন করে নিলাম - কখনো তার নাম দিলাম ভালো থাকা, কখনো তার নাম দিলাম বেটার এনভায়রনমেন্ট, কখনো নাম দিলাম বেটার এডুকেশন সিস্টেম, অথবা কখনো দিলাম পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তা। আমার নিজের বাবা যেখানেই থাকুক, আমার কাজ যেন আমি বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিতে পারি। আমার বন্ধুর বা দিদির মেয়ে যত খারাপ পরিস্থিতিতেই বড় হোক না কেন, আমার নিজের ছেলে-মেয়ে যেন সুন্দর আবহাওয়ায় আর ওয়ার্ল্ড ক্লাস এডুকেশন থেকে বঞ্চিত না হয়। নিজেদের পরিধিকে হাস্যকর করে তোলার আধুনিক আয়োজন। নিজের দেশ যা কিনা নিজের কাছের মানুষের সমার্থক - তাকে অর্থহীন করে দিয়ে নিরন্তর ছুটে চলাই আমাদের সময়ের পরিহাস, অথচ বাস্তবতাও।
No comments:
Post a Comment