Friday, August 31, 2018

"অরাজনৈতিক" আন্দোলন ও কলকাতা-কেন্দ্রিক নাগরিক সমাজ (~৫ মিনিট) । Apolitical Movements and Kolkata-based Civil Society

একবিংশ শতকের বয়েস বাড়ার সাথে সাথেই বাঙালির একটা প্রবণতা বেশি বেশি করে চোখে পড়ছে, "অরাজনৈতিক" হতে চাওয়ার প্রবল চেষ্টা। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনাস্থাই হয়তো এর মূল কারণ। কিন্তু এই "অরাজনীতি" তাঁদের সাময়িক আরাম ছাড়া আর কিছু দিচ্ছে বলে মনে হয় না। উপরন্তু এই "অরাজনীতির" সুযোগ যখন কোনো রাজনৈতিক দল নিতে পারছে, তখন তারা লাভবান হচ্ছে। আর যখন তা হচ্ছে না, তখন কিছু গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট কিছু সমস্যা ক্ষণিকের জন্য সমাধান হচ্ছে। অথচ "রাজনীতি" যদি সত্যিই দক্ষ এবং দায়িত্বপূর্ণভাবে করা যেত, তাতে কিছু ক্ষতি ছিল না, বরং একটা বৃহত্তর সমাজের ভালো হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে মেডিকেল কলেজের ঘটনা নিয়েও এই "অরাজনৈতিক" আকাঙ্খা আবারো দেখা গেল। মেডিকেল কলেজের হোস্টেল নিয়ে ছাত্ররা একটি আন্দোলন করছিলেন। তাঁদের দাবি না মানায় তারা একটি পলিটিকাল টুল হিসেবে "অনশন"-কে ব্যবহার করেন। দিন বাড়ার সাথে সাথে, কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলগুলো থেকে অনেক মানুষ এই আন্দোলনের সমর্থনে নেমে আসেন। তাঁরা মেডিকেলে কলেজে উপস্থিত থেকে ছাত্রদের সমর্থন জানান। শেষ পর্যন্ত কতৃপক্ষ ছাত্রদের দাবি মেনে নেয়। তবে এই আন্দোলনের পিছনের রাজনৈতিক চরিত্রটা কলকাতার মানুষ বুঝতে চাইলো না। আন্দোলনটাকে একটি "অরাজনৈতিক" চরিত্র দিয়ে তার পাশে দাঁড়ানো হল। 

এই আন্দোলনকে একটু গভীর ভাবে দেখলে অন্য চরিত্র বেরিয়ে আসে। মেডিকেল কলেজের যে ছাত্র সংগঠন এই আন্দোলনটা পরিচালনা করছিলো, ডিএসএফ, তাঁদের দাবিতে এও ছিল যে, তৃণমূলের প্রাক্তন ছাত্রকে যে সুপার করা হয়েছে, তাঁকে রাখা যাবে না। বদলে ছাত্র-শিক্ষকের কাউকে রাখতে হবে। অন্তত ন্যায়সঙ্গত দাবি, এবং রাজনৈতিকও। দাবিটাকে একটু বড় করে দেখলে বোঝা যায়, সব জায়গায় তৃণমূলের পোষ্য লোক বসিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এই দাবি। অনেক জায়গাতেই এখন এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন মানুষ। কিন্তু সব আন্দোলনকে "অরাজনৈতিক" রূপ দেওয়া যায় না, সব আন্দোলনের এলিটিজম থাকে না, যা মেডিকেল কলেজের আছে। ফলে সেইসব আন্দোলন কোনো স্বীকৃতি বা বৃহৎ আকৃতি পায়না। অথচ মানুষের এখনই দরকার ছিল, এই ধরণের আন্দোলনগুলোকে একত্রিত করার। কিন্তু তা না হয়ে, এটা স্রেফ মেডিকেলের ছাত্রদের সাময়িক উপশম ঘটালো।

এখনকার এই ঘটনা যেমন দেখায় যে অরাজনৈতিক আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা, তেমনি উল্টো পিঠও আছে। ২০০৭ সালের নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন হয়, তাকেও প্রথমদিকে এক "অরাজনৈতিক" রূপ দেওয়া হয়েছিল। কলকাতার সাধারণ মানুষ এবং "বুদ্ধিজীবী", শিল্পী সমাজ সেই আন্দোলনের সমর্থনে নেমে এসেছিলেন। যদিও এটা অরাজনৈতিক আন্দোলন একেবারেই ছিল না, পিছনে খুব ক্ষুরধার রাজনৈতিক মাথারা কাজ করছিলেন। মমতা ব্যানার্জি এই আন্দোলন থেকে নিজের পলিটিকাল মাইলেজ উদ্ধার করেন। আবার মাওবাদীরা - যাদেরকে দেশের সব থেকে বড় ইন্টারনাল সিকিউরিটি থ্রেট বলেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী - এই আন্দোলনের পিছনে তাঁদের অক্সিজেন খুঁজে পেয়েছিলেন। বাংলার সাধারণ মানুষ অজান্তে দেশের "বৃহত্তম ইন্টারনাল সিকিউরিটি থ্রেট"-কে সমর্থন করেছিল। এরপরে মমতা ব্যানার্জির শাসক চরিত্র উদ্ঘাটিত হওয়ার পরে, সেই বাংলাবাসীই হাত কামড়েছে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করার জন্য। 

মূলত যেটা দেখা যাচ্ছে, বাঙালী "অরাজনৈতিক" হওয়ার চক্করে কখনো সুযোগ হারায়, কখনো ব্যবহৃত হয়। সম্ভবত ৭০-এর দশকে ছাত্রদের চরম রাজনৈতিক চরিত্রের ফলে যে করুন পরিণতি হয়, এবং হাজার হাজার ছাত্র-যুবরা মারা যান, তার কারণেই বাঙালী এখন রাজনৈতিক হতে ভীষণ ভয় পায়। বাড়ির বড়রাও বলেন ছাত্রদের রাজনীতির দিকে না এগোতে। যদিও এই ঘটনা খুব নতুন নয়, কিন্তু এর ফলগুলো নতুন নতুন করে বাঙালীকে সমস্যার মধ্যে রেখে দিচ্ছে। আমাদের শিবপুরে আমরা দেখেছি, কিভাবে কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের অরাজনৈতিক করার মাধ্যমে সমস্ত ধরণের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন। আমরা না বুঝেই "অরাজনৈতিক" হয়েছিলাম, তবে পরে উপলব্ধি করেছিলাম যে আমাদের বক্তব্য বলার মতো প্ল্যাটফর্মটা আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হল। সে কারণেই মনে হয়, "অরাজনীতির রাজনীতি"-এর এই ধোঁকাটা বন্ধ হওয়া দরকার। "অরাজনীতি" বলে যে কিছু হয়না - সেটা বোঝা দরকার।বাঙালী যদি রাজনীতিটাকে অস্পৃশ্য করে না রেখে, সুস্থ এবং দায়িত্বশীল একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারতো, তাতে তাঁদের নিজেদেরই মঙ্গল হত। আশা রাখবো, ভবিষ্যতের আন্দোলনগুলো গঠনমূলক রাজনৈতিক পরিচিতি পাবে, এবং সেখান থেকে এক বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের পরিসর গড়ে উঠবে।

Thursday, August 30, 2018

শিল্পকলা নিয়ে নোটস - ২ | Notes on Arts - 2

আগের নোটে শিল্পের ক্লাসিকাল এবং মর্ডান ধারার মধ্যে একটা মেলবন্ধনের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে, শিল্পের বিষয়বস্তু বোধগম্য না হওয়ার একটা কথা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। সেটা নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করা যাক।

শিল্পকে বুঝতে পারার জন্য যেমন নমনীয়, অনুভূতিপ্রবণ একটা মনন দরকার হয়, তেমনি একটা বিশ্লেষণী ক্ষমতাও লাগে। তবে সেই বিশ্লেষণী ক্ষমতার কথা বেশি করে ভাবলে শিল্প আর শুধু অরগ্যানিক একটা বস্তু থাকে না, যার সৃষ্টি নাকি কোনো এক অদৃশ্য শক্তি, ক্ষমতা বা অনুভূতির ওপর নির্ভর করে। এই বিশ্লেষণী ক্ষমতা শিল্পকে কিছুটা যান্ত্রিক বা মেকানিকাল করে ফেলে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।

কোনো "ভালো" গানের কথা ধরা যাক, যেমন অঞ্জন দত্তের "বেলা বোস" বা ক্যাকটাসের "হলুদ পাখি"। আমরা যদি ভেবে নিই, এই গানগুলোর সুর তৈরি হয়েছে শুধুমাত্রই অনুভূতি দিয়ে, মানে অঞ্জনবাবু কোন মনখারাপের বিকেলে "বেলা বোস"-এর কথার সাথে সুর তৈরি করেছেন, তাহলে হয়ত শিল্পের একটা আলাদা বায়বীয়তা, মাধুর্য, স্বর্গীয় ভাব তৈরি হয়। কিন্তু আমরা একটু গভীরে গিয়ে দেখবো যে, এই দুটো গানেই শুধুমাত্র ডি মেজর key-এর বিভিন্ন কর্ড ব্যবহার করা হয়েছে। হয়তো অঞ্জনবাবু বা ক্যাকটাসের মনে মনে হৃদয় থেকেই ডি মেজরের কর্ড গুলোই এসেছে। কিন্তু আমাদের এটাও দেখতে হবে যে, এরকম একটি স্কেলের মেজর কর্ড গুলো মানুষের কানেও শ্রুতিমধুর হিসেবে শোনায়। সেই সূত্র ধরেই এনারা পুরো গানের সুরটাকে বেঁধে ফেলেছেন।

এভাবে শিল্পের বিশ্লেষণ করতে বসলে দেখা যায়, প্রত্যেক শিল্পেরই কিছু ব্যাকরণ আছে। গানের যেমন major বা minor key-এর কর্ডস। এই ব্যাকরণ দিয়েই প্রত্যেক শিল্পের আলাদা কিছু ভাষা তৈরি হয়। যখন কোনো শিল্পী সেই ভাষায় কথা বলে কোনো শিল্প সৃষ্টি করছেন, তখন আমাদের কাছে তা ভীষণ ভালোলাগার এনে দিচ্ছে, যদি আমরা সেই ভাষা বুঝতে পারি। কিন্তু যখন আমরা সে ভাষা বুঝতে পারছিনা, তখন সেই শিল্পকে আমাদের গ্রহণ করতে সমস্যা হচ্ছে। সে জন্য পন্ডিত আমীর খাঁ-এর "সাহানা" রাগ আমাদের কারো কারো কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ওই রাগের যে ভাষা, তার স্বাদ বুঝতে পেরে তার শিল্পরসে ভেসে যাচ্ছেন।

শিল্পের এই ভাষা শেখানোর জন্যই আজকাল বিভিন্ন আর্ট স্কুলগুলো তৈরি হয়েছে। এই স্কুলগুলিতে প্রচলিত শিল্প-ভাষাগুলি শেখানো হয়ে থাকে। তাই কেউ যদি কোনো শিল্পের সম্পূর্ণ মাদকতা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হয়, তাহলে সে এই আর্ট স্কুলগুলোর শরণাপন্ন হতে পারে, অথবা নিজে থেকে সেইসব ভাষাকে রপ্ত করার চেষ্টা করতে পারে। তবে প্রচলিত ভাষা যেমন আছে, তেমনি সেই ভাষাকে ভেঙে দেওয়াও আছে।

আমরা যদি সত্যজিত কে দেখি, তাহলে দেখতে পাবো, সিনেমার ভাষা মেনে নিয়ে তিনি অকল্পনীয় কিছু সিনেমা তৈরি করে গেছেন। তার সিনেমাগুলো তখনকার ওয়েস্টার্ন ফিল্মের যে ভাষা, তার সাথে সামঞ্জ্যপূর্ণ। সত্যজিৎ নিজেও একাধিক সাক্ষাৎকারে তার এই ওয়েস্টার্ন ফিল্মের অনুপ্রেরণার কথা বলেছেন। বিপরীত দিকে আছেন ঋত্বিক। তিনি সিনেমার সব প্রচলিত নমনীয় ভাষা, ন্যারেটিভ ভেঙে দিচ্ছেন। ফলত প্রথমে মানুষ সেই ভাষাকে নিতে পারছেনা। কারণ একটা নতুন ভাষা বুঝতে পারা তো বেশিরভাগ জনগণের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা ঋত্বিক-এর বেশিরভাগ ফিল্মকে পছন্দ করেছেন না। কিন্তু "যুক্তি তক্ক গপ্প" একটা ল্যান্ডমার্ক ফিল্ম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে, আর এ জন্যই ঋত্বিক এর ছবিগুলোকে এখন বিভিন্ন ফিল্ম স্কুলে গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়ে থাকে। যাতে শিক্ষার্থীরা এই ভাষা সম্পর্কে অবগত হতে পারেন।

এর পরে প্রশ্ন আসতে পারে, শিল্পীরা তাদের শিল্পের উৎস ঠিক কোথা থেকে পেয়ে থাকেন। যে কোনো শিল্পের উৎকর্ষতা তো সেই শিল্পের সততা আর তার ভাষার উপর নির্ভর করলো। কিন্তু সেই উৎকর্ষ শিল্পের অনুপ্রেরণা কোথায়? এ নিয়ে পরের নোটে ভাবার চেষ্টা করবো।
(চলবে)

Wednesday, August 22, 2018

কাউকেই চিনি না - Don't know anyone!

Boston, 22-Aug-2018, 10:00 PM

আমার কোনো মুসলিম বন্ধু নেই,
আমার কিছু বন্ধু আছে যারা মুসলিম,
আমার কিছু বন্ধু আছে যারা ঈদের দিন নতুন জামাকাপড় পরে,
কখনো আমাকে সুস্বাদু বিফ খাওয়ায়।
আমার কোনো হিন্দু আত্মীয় নেই,
আমার কিছু আত্মীয় আছে যারা পুজো-আচ্চা করে,
ভালো সিন্নি বানায়।
আমার কোনো বিহারী সহপাঠী ছিল না,
আমার কিছু বন্ধু আছে যারা আমায় প্রথম লিট্টি খাইয়েছিল।
আমার কোনো চেনা মাড়োয়ারি দোকানদার নেই,
পাড়ার মিষ্টির দোকানের মালিক জাগেতিয়া বাবু
আমার প্রিয় মিষ্টির খোঁজ রাখেন,
ওনার কাছে ওদের জয়পুরের বাড়ির গল্প শুনেছি।
আমি কোনো তামিল ছেলেকে চিনিনা,
তবে আমার রুমমেট আমাকে নিখুঁত ধোসা বানানো শিখিয়েছে।
আমি কোনো পাকিস্তানী মেয়েকে চিনিনা,
আমেরিকায় আমার ল্যাবমেট আমার সাথে হিন্দিতে লাহোরের গল্প করে।
আমার কোনো মেক্সিকান কলিগ নেই,
পাশের কিউবিকলের ছেলেটার জানে কোথায় ভালো টাকো পাওয়া যায়,
আমরা মাঝে মাঝে একসাথে খেতে যাই।

আমি আজকাল কাউকেই চিনিনা,
আমি শুধু কিছু মানুষ চিনি, মান-হুঁশ।

Sunday, August 19, 2018

শিল্পের আধুনিকতা নিয়ে নোটস - ১ | Notes on Modernity of Arts - 1

ভাবনাগুলোকে অক্ষরে চালান করতে করতে বুঝতে পারছি এগুলো মূলত নোটস। সেরকমই শিল্প আর তার আধুনিকতা নিয়ে বহুদিন ধরেই মনের মধ্যে ভাবনার অযাচিত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। তা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে বেশ ক্লান্ত। এ নিয়ে বেশ কয়েকজনের সাথে অনেক বার আলোচনাও হয়েছে। এবার বোধ হোয় এই ভার নামিয়ে রাখার সময় হয়েছে, সুতরাং লিখন।

শিল্পকে এক হাজার ফুট উঁচু থেকে মূলত দুই ধারায় ভাগ করে নেওয়া যায় - ক্লাসিকাল আর মডার্ন। ক্লাসিকাল এর কথায় পরে আসছি। আধুনিক এর কথা দিয়ে শুরু করি, খুব সাবজেক্টিভ একটা ব্যাপার। বাংলা গানের আধুনিকতা নিয়ে লেখাটায় বলেছিলাম যে, সমসাময়িকতা আমার কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা বয়ে আনে। তাই সলিল চৌধুরী যখন কৃষকদের জমির অধিকারে স্বাধীনতার পরেই "হেই সামালো ধান" লিখছেন, আমার কাছে উনি ভীষণ আধুনিক হওয়ে উঠছেন। বব ডিলান যখন বিশ্বের নাগরিক অধিকারের জন্য, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লিখছেন, "টাইমস দে আর চেঞ্জিং", তিনি আমার কাছে ভীষণ পরিমাণে "আধুনিক"। আমি প্রধানত আধুনিক শিল্পকেই ভালোবাসি। ক্লাসিকাল এর প্রতি আমার তেমন আসক্তি নেই।

ক্লাসিকালকে এ হেন বুড়ো আঙুল যখন দেখাচ্ছি, তখন তার পিছনে অনেকগুলো কারণও আছে। নিখিল ব্যানার্জী যখন "মেঘ" রাগে পরিবেশমন্ডলীতে গভীর নিম্নচাপ তৈরি করেছেন, আমি আধঘন্টার জন্য সেই আবহাওয়াতে মিশে যাচ্ছি বটে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না, কি হচ্ছে! উনি যে কোথা দিয়ে আমাকে নিয়ে চলেছেন, সেই রাস্তাই চিনতে পারছি না। এই যে বিমূর্ততা, এটাই তো ক্লাসিকাল শিল্পের প্রাণ ভোমরা। এই বিমূর্ততা কে আমি ধরতেই পারছিনা, আমার অপারগতা। তাই ক্লাসিকাল শিল্পকে আমি আমার শিল্প বলে ভাবছিনা। ঠিক পছন্দ করতে পারছিনা।

এসব বলার পরে, জর্জ বিশ্বাস যখন "আকাশভরা" শুরু করছেন তখন তো আমি মহাবিশ্বের সাথে নিজেকে আর আলাদা করতে পারছিনা। তখন আমি, রবীন্দ্রনাথ, জর্জদা - একসাথে বসে আছি আমরা। সকলে মিলে পথের পাঁচালী দেখছি। যা কিনা আদ্যন্ত একটি ক্লাসিকাল ছবি, অন্তত আগে বলা আধুনিকতার সংজ্ঞা অনুযায়ী। তাহলে আধুনিকতার একটা নতুন সংজ্ঞা বানাতে হয়, কারণ শুধু সমসাময়িকতা দিয়ে আধুনিকতাকে আর বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। এই নতুন সংজ্ঞায় নিয়ে আসতে হচ্ছে "খোঁজ"।

চন্দ্রিলবাবুর বক্তব্যকে একটু বিস্তৃত করে বলা যায়, যে শিল্পের মধ্যে এক নিরন্তর সন্ধান চলেছে, সেই শিল্পই আধুনিক। সে খোঁজ নিজেকে চিনতে পারার হতে পারে, বা শিল্পকে উত্তরণের হতে পারে অথবা কোনো এক বিমূর্ত খোঁজ, যা কিনা আসলে সন্ধান পাবার পরও বিমূর্ত থাকবে। সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী ক্লাসিকাল শিল্পভাবনা এক চূড়ান্ত আধুনিকতায় পরিবর্তিত।

পন্ডিত আমীর খান "বসন্ত" রাগে যখন বিস্তার করছেন, তখন তো মনে হচ্ছে উনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই সর্বশেষ অনুভূতিকে যা বসন্তকে বয়ে আনবে। যে বসন্তের ছায়াছবি তাঁর মনে, হৃদয়ে, মস্তিষ্কে খেলা করছে, সেটাকেই সুরের মধ্যে প্রকাশের এক সর্বোত্তম চেষ্টা। সেই আল্টিমেট অনুভূতিকে নিরন্তর রূপ দেওয়ার চেষ্টাই সার্থক করে তুলছে ক্লাসিক্যাল শিল্পকে। কিন্তু কোনো শিল্পই তো সার্থক নয় এই সন্ধানটুকু ছাড়া। সত্যজিৎ- এর অন্যতম "আধুনিক" কীর্তি, প্রতিদ্বন্দ্বীর শেষ দৃশ্যটা মনে পড়ে যায়। সেই ছোটবেলার নাম-না-জানা পাখির ডাকটা। সেটারই তো খোঁজ সারা ছবিটা জুড়ে। ওই মিষ্টি ডাকটা, ওই সরল ডাকটা, যেটার মধ্যে লুকিয়ে আছে সব অন্তর্দ্বন্দ্বের অবসান। সেটার সন্ধানেই তো কি ভীষণ আধুনিকতা সত্যজিৎ-এ।

এই পর্যন্ত এসে ক্লাসিকাল আর আধুনিক সম্পূর্ণ মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলেছি। নবারুণ এর ছোট গল্প কিস্যু বুঝতে পারছিনা। অথচ মানুষটি কি ভীষণ "আধুনিক"। ওনার কবিতা দিয়েই তো আশা নিয়ে বাঁচছি, চেষ্টা করছি, যেন "একটা কথার ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে" পড়ে, হোক সারা সহর উথাল পাথাল। আধুনিকতা তছনছ করে দিক চারপাশের এই মেকী পরিপাট্য। এবং তার পরেই হয়ত একটা নতুন সূর্য উঠবে, "লাল সূর্য" পূর্ব দিকে। সব কিছু তখন কোমলতায় ভরে গেছে। পন্ডিত আলী আকবর খাঁ তখন ভৈরবী বাজাচ্ছেন। রাগেদের সাথে নাকি অনেকটা সময় কাটাতে হয়, তবেই নাকি তাদের বোঝা যায়। আমিও হয়ত একটু একটু করে বেশি সময় কাটিয়ে, রাগসহ অন্যান্য ক্লাসিকাল শিল্পের বিমূর্ততা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করবো। যেখানে অন্তর্দ্বন্দ্বের সাথেই সহাবস্থান করবে পরিতৃপ্তি বা রেসোলিউশন।
(চলবে)