একবিংশ শতকের বয়েস বাড়ার সাথে সাথেই বাঙালির একটা প্রবণতা বেশি বেশি করে চোখে পড়ছে, "অরাজনৈতিক" হতে চাওয়ার প্রবল চেষ্টা। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনাস্থাই হয়তো এর মূল কারণ। কিন্তু এই "অরাজনীতি" তাঁদের সাময়িক আরাম ছাড়া আর কিছু দিচ্ছে বলে মনে হয় না। উপরন্তু এই "অরাজনীতির" সুযোগ যখন কোনো রাজনৈতিক দল নিতে পারছে, তখন তারা লাভবান হচ্ছে। আর যখন তা হচ্ছে না, তখন কিছু গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট কিছু সমস্যা ক্ষণিকের জন্য সমাধান হচ্ছে। অথচ "রাজনীতি" যদি সত্যিই দক্ষ এবং দায়িত্বপূর্ণভাবে করা যেত, তাতে কিছু ক্ষতি ছিল না, বরং একটা বৃহত্তর সমাজের ভালো হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে মেডিকেল কলেজের ঘটনা নিয়েও এই "অরাজনৈতিক" আকাঙ্খা আবারো দেখা গেল। মেডিকেল কলেজের হোস্টেল নিয়ে ছাত্ররা একটি আন্দোলন করছিলেন। তাঁদের দাবি না মানায় তারা একটি পলিটিকাল টুল হিসেবে "অনশন"-কে ব্যবহার করেন। দিন বাড়ার সাথে সাথে, কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলগুলো থেকে অনেক মানুষ এই আন্দোলনের সমর্থনে নেমে আসেন। তাঁরা মেডিকেলে কলেজে উপস্থিত থেকে ছাত্রদের সমর্থন জানান। শেষ পর্যন্ত কতৃপক্ষ ছাত্রদের দাবি মেনে নেয়। তবে এই আন্দোলনের পিছনের রাজনৈতিক চরিত্রটা কলকাতার মানুষ বুঝতে চাইলো না। আন্দোলনটাকে একটি "অরাজনৈতিক" চরিত্র দিয়ে তার পাশে দাঁড়ানো হল।
এই আন্দোলনকে একটু গভীর ভাবে দেখলে অন্য চরিত্র বেরিয়ে আসে। মেডিকেল কলেজের যে ছাত্র সংগঠন এই আন্দোলনটা পরিচালনা করছিলো, ডিএসএফ, তাঁদের দাবিতে এও ছিল যে, তৃণমূলের প্রাক্তন ছাত্রকে যে সুপার করা হয়েছে, তাঁকে রাখা যাবে না। বদলে ছাত্র-শিক্ষকের কাউকে রাখতে হবে। অন্তত ন্যায়সঙ্গত দাবি, এবং রাজনৈতিকও। দাবিটাকে একটু বড় করে দেখলে বোঝা যায়, সব জায়গায় তৃণমূলের পোষ্য লোক বসিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এই দাবি। অনেক জায়গাতেই এখন এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন মানুষ। কিন্তু সব আন্দোলনকে "অরাজনৈতিক" রূপ দেওয়া যায় না, সব আন্দোলনের এলিটিজম থাকে না, যা মেডিকেল কলেজের আছে। ফলে সেইসব আন্দোলন কোনো স্বীকৃতি বা বৃহৎ আকৃতি পায়না। অথচ মানুষের এখনই দরকার ছিল, এই ধরণের আন্দোলনগুলোকে একত্রিত করার। কিন্তু তা না হয়ে, এটা স্রেফ মেডিকেলের ছাত্রদের সাময়িক উপশম ঘটালো।
এখনকার এই ঘটনা যেমন দেখায় যে অরাজনৈতিক আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা, তেমনি উল্টো পিঠও আছে। ২০০৭ সালের নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন হয়, তাকেও প্রথমদিকে এক "অরাজনৈতিক" রূপ দেওয়া হয়েছিল। কলকাতার সাধারণ মানুষ এবং "বুদ্ধিজীবী", শিল্পী সমাজ সেই আন্দোলনের সমর্থনে নেমে এসেছিলেন। যদিও এটা অরাজনৈতিক আন্দোলন একেবারেই ছিল না, পিছনে খুব ক্ষুরধার রাজনৈতিক মাথারা কাজ করছিলেন। মমতা ব্যানার্জি এই আন্দোলন থেকে নিজের পলিটিকাল মাইলেজ উদ্ধার করেন। আবার মাওবাদীরা - যাদেরকে দেশের সব থেকে বড় ইন্টারনাল সিকিউরিটি থ্রেট বলেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী - এই আন্দোলনের পিছনে তাঁদের অক্সিজেন খুঁজে পেয়েছিলেন। বাংলার সাধারণ মানুষ অজান্তে দেশের "বৃহত্তম ইন্টারনাল সিকিউরিটি থ্রেট"-কে সমর্থন করেছিল। এরপরে মমতা ব্যানার্জির শাসক চরিত্র উদ্ঘাটিত হওয়ার পরে, সেই বাংলাবাসীই হাত কামড়েছে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করার জন্য।
মূলত যেটা দেখা যাচ্ছে, বাঙালী "অরাজনৈতিক" হওয়ার চক্করে কখনো সুযোগ হারায়, কখনো ব্যবহৃত হয়। সম্ভবত ৭০-এর দশকে ছাত্রদের চরম রাজনৈতিক চরিত্রের ফলে যে করুন পরিণতি হয়, এবং হাজার হাজার ছাত্র-যুবরা মারা যান, তার কারণেই বাঙালী এখন রাজনৈতিক হতে ভীষণ ভয় পায়। বাড়ির বড়রাও বলেন ছাত্রদের রাজনীতির দিকে না এগোতে। যদিও এই ঘটনা খুব নতুন নয়, কিন্তু এর ফলগুলো নতুন নতুন করে বাঙালীকে সমস্যার মধ্যে রেখে দিচ্ছে। আমাদের শিবপুরে আমরা দেখেছি, কিভাবে কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের অরাজনৈতিক করার মাধ্যমে সমস্ত ধরণের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন। আমরা না বুঝেই "অরাজনৈতিক" হয়েছিলাম, তবে পরে উপলব্ধি করেছিলাম যে আমাদের বক্তব্য বলার মতো প্ল্যাটফর্মটা আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হল। সে কারণেই মনে হয়, "অরাজনীতির রাজনীতি"-এর এই ধোঁকাটা বন্ধ হওয়া দরকার। "অরাজনীতি" বলে যে কিছু হয়না - সেটা বোঝা দরকার।বাঙালী যদি রাজনীতিটাকে অস্পৃশ্য করে না রেখে, সুস্থ এবং দায়িত্বশীল একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারতো, তাতে তাঁদের নিজেদেরই মঙ্গল হত। আশা রাখবো, ভবিষ্যতের আন্দোলনগুলো গঠনমূলক রাজনৈতিক পরিচিতি পাবে, এবং সেখান থেকে এক বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের পরিসর গড়ে উঠবে।