টুকাইয়ের বাড়িতে মাটির ওপর আসন পেতে বসে স্টিলের থালায় মাংস-ভাত খাচ্ছিলাম। ওর মা সামনে বসেছিলেন। সবশেষে টমেটোর চাটনিও ছিল, কাকিমা বেশ সুন্দর বানিয়েছিলেন। সেবারে টুকাইয়ের জন্মদিনে বেশ মজা হয়েছিল, সাজ্জানলালও এসেছিল। আমি একটা পেন্সিলবক্স উপহার দিয়েছিলাম টুকাইকে, তাতে কয়েকটা খুব সুন্দর পেন্সিল ছিল। তার আগের দিনই ওকে অঙ্কের মাষ্টারমশাই আলম স্যার ক্লাসের বাইরে নীল ডাউন করিয়ে দেন, ক্লাসে লেখার সময় ওর নিজের পেন্সিল না থাকায়। সেজন্যই বোধ হয় ওর খুব পছন্দও হয়েছিল পেন্সিলবক্সটা। ও খুব খুশি ছিল সেবার। আমাদের দুপুরের খাবারের একটু আগেই কেক কাটা হয়েছিল; এই পাশেই, ওদের শোয়ার ঘরে। অবশ্য যা ওদের শোয়ার ঘর, সেটাই ওদের বসার ঘর, সেটাই আমাদের ট্রাম্প কার্ড খেলার ঘর - সবই ওই এক ঘর। কারণ ওদের একটাই ঘর ছিল তখন, এবং সেটাই ওদের পুরো বাড়ি। বাইরে যে ছোট্ট মত জায়গাটায় আমরা খাচ্ছিলাম, সেই ছোট্ট মতো জায়গাটাতেই ওর মা, মানে কাকিমা রান্না করতেন। খেয়ে নিয়ে একটু গল্প করেই আমরা সেদিন স্কুলের মাঠে খেলতে চলে গেছিলাম, দৌড়ে দৌড়ে।
দৌড়োতে দৌড়োতে আমি ২৩বি নম্বর গেট-এ পৌঁছলাম, কিন্তু গিয়ে দেখলাম প্লেন ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। অবশ্য টুকাই দৌড়ে ৩৪ বি বাসটা ধরে ফেলেছিল ধর্মতলার মোড়ে, কে.সি.দাশ-এর অপোজিট-এ। এভাবে কিছু ট্রেন আমরা মাঝে মিস করেছি, কিছু প্লেন ধরে ফেলেছি। ঠিক মতো জানি না, টুকাই ঠিক কোন কোন ট্রেন বা বাসগুলো ধরতে পেরেছিল বা পারেনি। তবে এটুকু বুঝেছিলাম, আমার জন্য যে ট্রেনগুলো ছিল, সেগুলোর নাগাল পায়নি টুকাই। ওর আর্থিক অবস্থা থেকে পাওয়ার কথা ছিল না। হয়তো আমার ছোটবেলার বন্ধু সাজ্জানলালও কিছু একটা কাজ জুটিয়ে নিয়েছে এতদিনে, যদিও ওর একটা পা-এ সামান্য সমস্যা ছিল, খুঁড়িয়ে হাঁটতো। ওর আর কোনো খোঁজ পাইনি স্কুলের পরে, যেমন সামিউল-এরও পাইনি। টুকটাক কিছু খবর ছাড়া অন্য খবর পাওয়ার কথাও ছিল না। কারণ আমি ধীরে ধীরে আলোর দিকে চলে এসেছি। আর আমরা যখন আলোয় থাকি, অন্যদের স্রেফ কিছু সংখ্যায় পরিণত করি। তাই পেপারে আলাউল, টুকাই, সাজ্জানলালদের সম্পর্কে combined কিছু তথ্য পেয়েছি। বুঝতে পেরেছি ওদের জন্য কিছু উন্নতি হচ্ছিলো, আর অনেক কিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম আমাদের কাছাকাছি ও ব্যক্তিগত উন্নতিটা। একটা সময় মা উনুনে রান্না করতো, তারপর একদিন গ্যাসে এসে গেল। অন্যের বাড়ি থেকে আমাদের নিজেদের বাড়ি হচ্ছিল। টুকাইরা মাটি আর বাঁশের ঘর ছেড়ে পাকা ভাড়া-বাড়িতে উঠে আসছিল। কিন্তু এসবের পিছনের কাহিনীটা আরো পরে ধরতে আরম্ভ করি। সরকার থেকে চাকরি হচ্ছিল অনেকের, আমার বাবা-মা-আত্মীয়রা এই পরিবর্তনটার সাক্ষী ছিল। কিছু বেসরকারি চাকরিও দেখছিলাম। কিন্তু চাকরি তো এমনি এমনি হতে পারে না। এর পিছনে চলছিল লাগাতার আন্দোলন, শ্রমের অধিকার এবং মূল্যের জন্য। অনেক মানুষ মাঠে-ঘাটে নেমে এই আন্দোলনটা করছিলেন। তারা সত্যিকারের শ্রমের মূল্যের তত্ত্ব কতটা বুঝেছিলেন, জানিনা। কিন্তু তাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে শ্রমের প্রকারভেদ এবং নিজেদের সামাজিক অবস্থানটা যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাঁদের আন্দোলনের দিশাও ছিল, প্রাপ্তিও ছিল। একই জিনিস হচ্ছিল একটু গ্রামের দিকে, চাষিদের বাড়িতেও। মুশকিল হল - তাঁরা সকলেই বাস করছিলেন একটা গণতান্ত্রিক দেশে এবং আন্দোলন করছিলেন সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।
আন্দোলনকারীরা তাঁদের যথার্থ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে স্বচ্ছলতাটা আনলেন তাঁদের জীবনে, সেটা সকলের জীবনেই আনা সম্ভব ছিল না। কাজ কখনো একেবারে, একটা প্রজন্মের আন্দোলনে শেষ হতে পারে না, তার জন্য অনেকটা সময়, অনেকগুলো যুগ লাগে। ফলে অনেক মানুষ, এর পরেও, পিছনেই পড়ে রইলেন। কিন্তু একটা প্রজন্মের আন্দোলনের বয়ে আনা স্বচ্ছলতা একটা বৃহৎ গোষ্ঠীকে মূলত পঙ্গু করে দিল। এই খুব বড় জনগোষ্ঠীই হল আমাদের সোনার মিডল ক্লাস, মানে আমরা যারা মধ্যবিত্ত। আমরা একটা আপাত সুখের মাঝে বড় হলাম; বাবা-মা তাঁদের স্বভাববশত, তাঁদের কষ্টটা আমাদের কাছে যথাসম্ভব চেপে রাখলেন। আমরা বড় হয়ে কেউ প্লেন ধরলাম, কেউ ছুটে গিয়ে বাস ধরলাম। এইভাবে আমরা নিজেদের আরো উপরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করলাম বটে, কিন্তু অনেকেই এই দৌড়টায় পিছিয়ে পড়লো।
যারা পিছিয়ে পড়লো, তারা মনে করলো, তাঁদের পিছিয়ে পড়ার কারণ তাঁদের নিজেদের অক্ষমতা। অথচ আমরা যে সেই একই সমাজব্যবস্থায় বাস করছি, সেটা অনেকেই খেয়াল করলাম না। নাহ্, একটু ভুল বললাম, ঠিক একই সমাজব্যবস্থায় আমরা আর বাস করছিলাম না। একটা বৃহৎ গোষ্ঠী, যারা আমাদের আগের প্রজন্মে সক্রিয় ছিল, তারা এখন নিজেদের অক্ষম বলে ভাবতে শুরু করেছে। তাই ব্যবস্থাটাকে আর একই বলা যাচ্ছে না। এই এখনকার অক্ষম গোষ্ঠীটাতেই আগে ছিল আমাদেরই বাবা-মা-আত্মীয়রা, তাঁদের যুবক-সত্ত্বায়, যারা তখন মাঠে-ঘাটে নেমে আন্দোলনটা করছিল, শ্রমের অধিকারের জন্য, সঠিক চাকরির জন্য। কিন্তু আমরা বড় হয়ে সেই চাকরিটাকে হয় নিজেদের অধিকার অথবা চাকরি না-পাওয়াটাকে নিজেদের অক্ষমতা বলতে শুরু করলাম। ফলে যে গোষ্ঠীটা খুব সক্রিয় ছিল নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে আনায় বা প্রতিষ্ঠিত করায়, সেই গোষ্ঠীটা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল।
পুরোপুরি বিলুপ্তও বলা যায় না, বলতে হয়, সেই গোষ্ঠীটা ছন্নছাড়া হয়ে গেল। সেই গোষ্ঠীর কিছু লোক এখন ব্যাঙ্গালোরে হুইস্কি সহযোগে হাহুতাশ করে মমতা ব্যানার্জির শাসন নিয়ে, অথবা নন্দনে বিকেলবেলা হাওয়া খেতে খেতে সিপিএম-এর করুন দশা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, অথবা আমেরিকায় বসে এরকম একটা লেখা লেখে। এরা কিছুটা সচেতন সমাজের এই (অধঃ)গতিটা সম্পর্কে এবং সেখানে নিজেদের কিছু করতে না-পারার ব্যর্থতা সম্পর্কে। কিন্তু যেহেতু এদের আগের প্রজন্ম এদের একটা স্বচ্ছলতা দিয়েছে, একটা পরিসর দিয়েছে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বপ্ন-চাহিদাগুলো পূরণ করার, তাই তারা মূলত উদাস এবং প্রমাণসাপেক্ষে অপারগ, এই সমস্যা নিয়ে কিছু করার উদ্দ্যশ্যে।
এর পরও পড়ে থাকছে এই বৃহৎ গোষ্ঠীর আর একটা মূল উপগোষ্ঠী। যাদের এখনো সেই চাকরিগুলো দরকার, যেগুলো সক্রিয় আন্দোলন এবং সঠিক উন্নয়ন থেকে উঠে আসতে পারে। এই হল সেই গোষ্ঠীটা যারা গণতন্ত্রের এবং সর্বোপরি সাম্যবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে আসা স্বচ্ছলতার শিকার। এরা এখন হয় শাসক দলের তাবেদারী করতে বাধ্য বা সিভিক পুলিশে নাম লেখাতে। এদের কাছে সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তেমন কোনো উপায় নেই। কারণ এরা জানেনা, আন্দোলন করার মানে, এদের বড় হওয়ায় হয় মিশে আছে সামান্য শৌখিনতা, অথবা স্বচ্ছলতার মেদুর স্বপ্ন যা ২০০৩-০৪-এর "Shining India"-এর মতোই সত্যি। সেই স্বপ্নে কোনো আক্রোশ নেই, বাসনা নেই, শুধু আছে চাতকের চাহুনি। আর সেই চাহুনি চেয়ে আছে সমাজবাদী, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে, যা খানিকটা "সুখী" আন্দোলনে পর্যবসিত। তবে প্যারাডক্সটা এখানেই যে, সফল আন্দোলনের মূল জ্বালানি যে অনুভূতিটা, সেই আক্রোশ বা ক্রোধ নামক আবেগটা এখন প্রায় অনুপস্থিত এই গোষ্ঠীর ভিতর। ফলে আমরা কোথাও আটকে গেছি একটা ডেডলকের মধ্যে। কেউ কোনোদিকে চলতে পারছি না, কেউ দৌড়োতে পারছি না, কেউ মাটির কাছাকাছি যেতে পারছি না। আমরা শুধুই মাটির ওপরে সুন্দর হাতের কাজ-করা আসনটুকু দেখতে পাচ্ছি, পেতে চাইছি; ওর উপর বসে মাংস-ভাত খাওয়ার স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু আসনটা যে মাটিতেই বিছিয়ে দিতে হবে, এবং তার জন্য আসনটাকে যে মাটি ছোঁওয়াতেই হবে - সেটা মেনে নিতে রাজি হচ্ছি না। বর্তমান শাসকেরাও চান না আমরা রাজি হই, কারণ তারা এই পঙ্গু গোষ্ঠীটাকে ভোট জেতার মেশিনারি হিসেবেই কাজে লাগাতে ব্যস্ত। সাম্যবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন আমাদের যে দৌড়টা দিতে শিখিয়েছিল, আমরা খুব সহজে ভেবে নিয়েছি যে, তার বোধ হয় কোনো ফিনিশিং লাইন আছে। কিন্তু সেটা তো ছিল না, সেটার একটা চিরন্তন বহমানতা থাকার কথা ছিল। অথচ আমরা সেই কাল্পনিক ফিনিশিং লাইনে এসে অপেক্ষা করছি, আশা করছি, একটা উন্নততর পৃথিবীর, যেটাকে মরীচিকা ছাড়া আর কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সাম্যবাদী আন্দোলনের এটাই বোধ হয় সব থেকে বড় পরিহাস।
---
আলোচনা ও ভাবনা সহায়তা: শুভাশিস পাত্র
শুভাশিসের মন্তব্য: তোর এই লেখাটা পড়ে আমার মনে যে টা সব থেকে বেশি টাচ করেছে সেটা হল 'গোষ্ঠী'। শ্রেণী নয়। একদম ঠিক। যতদুর মনে পড়ে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার এর পর থেকেই শ্রেণী চেতনা হারিয়ে গেছে এসেছে গোষ্ঠীবাজি। তুই সেটাই দেখেছিস।
তোর দেখাটা সত্য। বামফ্রন্ট সরকার যখন থেকে কাজের সুযোগ তৈরী করতে সক্ষম হল, তখন আন্দোলনটা গোষ্ঠীগত আন্দোলন হয়ে গেছে, শ্রেণীগত চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার তাগিদে ভুলে গেল তুলনামূলক ভাবে অগ্রসর শ্রেণী এর সিংহ ভাগ সুযোগ আত্মসাৎ করবে। হলও তাই। সেই ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে মুক্তি পেতে ultimately মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর উদয় হলো। কিন্তু সেটাও মরিচীকা।