একজন জিজ্ঞেস করছিল, কিন্তু ওনাকে কজন মনে রাখলো বল তো? আমি বলি, সাধারণ মানুষ তো তেমন কাউকেই মনে রাখে না। তাদের দৈনন্দিন ঝুটঝামেলার শেষে, শিল্পের চলমান ধারাকে মনে রাখার মতো সময় কোথায়! কিন্তু যারা সত্যিই সংগীতের বিবর্তন নিয়ে আগ্রহী, সংগীতের প্রকৃত গুণগ্রাহী, তারা ঠিক জানে, রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা সংগীতে যে আধুনিকতার আঘাত দেওয়াটা দরকার ছিল, সেটা সলিল চৌধুরী ছাড়া সম্ভব ছিল না।
তাঁর গান লেখা শুরু হচ্ছে ৪০-এর দশকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাহেন্দ্রক্ষণে। বাংলায় তখন রবীন্দ্র, নজরুল বা দ্বিজেন্দ্রলালের ভারতীয় ধারার সংগীত প্রবলভাবে বিদ্যমান। সেই সময়েই চা-বাগানে বড় হওয়া এক কিশোর বাখ-মোৎজার্ট-বেঠোভেন শুনে ফেলছেন। আর শুধু শুনছেনই না, সেই পাশ্চাত্য সংগীতকে মিশিয়ে দিচ্ছেন ভারতের রাগাশ্রয়ী এবং রাবীন্দ্রিক-ঘরানার সংগীতের সাথে। কিন্তু সেইরকম সুরের মতো উপযুক্ত কথাও তো চাই। কখনো সেই কথা পাচ্ছেন সুকান্তের কবিতায়। কখনো রচনা করছেন নিজেই।
ইউরোপিয়ান মোডাল music থেকে শুরু করে ভারতীয় রাগের modes হয়ে পাশ্চাত্যের আধুনিক scale-based music সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা সলিলের, শুধু সংগীত নিয়েই দিস্তের পর দিস্তে ভরিয়ে দেওয়া যায়, রাতের পর রাত আলোচনা করা যায়। সত্যিই ভেবে দেখুন, "রানার"-এর মতো এতো বৈচিত্র্যের গান, আর কিছু আপনি শুনেছেন কিনা! শুধুমাত্র একটি গানেই এতো ওঠা-নামা আনা যায়? এতো অনুভূতির সূক্ষতাকে একটি গানেই শুধুমাত্র সুরের বৈচিত্র্য দিয়ে ধরা যায়? সলিল সেটা ভারতীয় আঙিনায় করে দেখালেন। এবং শুধু সুরে নয়, কথাতেও করলেন। ১৯৪৩-এর কুখ্যাত বাংলার মন্বন্তরের পরে, তিনি তাঁর গানে তুলে ধরলেন "কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা"। যদিও এই গানেও তাঁকে সমালোচনা শুনতে হল, গাঁয়ের বধূর অনুভূতি এবং গানের বাস্তবরূঢ়তা নিয়ে। কিন্তু সলিলের লেখা গান মানুষকে অনুপ্রাণিত করা থামালো না। "আলোর পথযাত্রী" হয়ে মানুষকে পথ দেখালো, বললো "পথে এবার নাম সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা"। ওনার গানগুলিতে তখন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের "ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে"। গণনাট্য সংঘ (IPTA) ও কমিউনিস্ট পার্টির সভাগুলিতে হাজার হাজার মানুষ তার এই গানের সাথে গলা মেলাচ্ছেন।
প্রথম দিকে এসব গান রেকর্ড না হয়েও, মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে শুরু করলো। সলিল গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে এসব গান করেছেন এক সময়ে। দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখার্জি IPTA-এর হয়ে তাঁর সাথেই পথে নেমেছেন। তাঁরা গেয়েছেন "পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি।" এবং সে পথ তো সোজা ছিল না। স্বাধীনতার আগে ও পরে কমিউনিস্ট পার্টিকে বিভিন্ন জায়গায় ব্যান করা হয়েছে। অনেক সমস্যা সয়েছেন সলিলের মতো অনেক শিল্পীই। তবে বোধ হয়, সংগীত সলিলকে উজ্জীবিত রেখেছিল সবসময়। আর এছাড়াও তিনি ছিলেন চিরপরিবর্তনশীল। এরপরে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছেন, পারিবারিক অবস্থা খারাপ হওয়ায়। সেখানেও তিনি বদলে দিয়েছেন, নৌশাদ, খৈয়্যাম, মদন মোহনের music-এর সংজ্ঞা। "দো বিঘা জমিন", "মধুমতি", "হাফ টিকিট", "আনন্দ", "ছোটি সি বাত"-এর মতো ফিল্মের গানের মাধ্যমে এক অন্য ধরণের দমকা হাওয়া এনে ফেলেছেন আরব সাগরের তীরে। তবে এসব সাফল্যের মাঝেই তাকে শুনতে হয়েছে গঞ্জনা। কম্যুনিস্ট পার্টি (স্বভাবজাতভাবে) তাঁকে পার্টি থেকে বহিস্কারও করেছে।
কিন্তু এসবের জন্য তাঁর ধ্যানধারণা কখনো পাল্টায়নি। ছোটবেলায় চা-বাগানে থাকার সময় থেকেই মানুষের সম্মিলিত শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। মানুষের অনুপ্রেরণার জন্য গান, কবিতা লিখে গেছেন। মার্ক্স্ পড়ার সাথে সাথেই চারপাশের জগৎটাকে সূক্ষভাবে চেনবার চেষ্টা ছিল তার মধ্যে। সংগীতের এক বিরাট পারদর্শিতা কখনো সেই চেনায় খাদ আনতে পারেনি, বরং সহায়তা করেছে। নিজেকে নিরন্তর বদলাতে গিয়েই অবহেলায় বলতে পেরেছেন, "যাক যা গেছে তা যাক"। তাই জীবনের পরের দিকে সুর দিয়েছেন "মন লাগে না", "ও মোর ময়না গো", "ধিতাং ধিতাং বোলে"-এর মতো গানে। এই ধরণের চিরআধুনিক মানুষেরই অনুগামী হতে ইচ্ছে করে। আমি কোনোকিছু নিয়েই খুব একটা গর্ব বোধ করি না। কিন্তু সলিলের এই চিন্তাভাবনার অনুগামী হতে-পারার একটা গর্ব যেন কোথাও অনুভব করি। নিজেকে বামপন্থী মনে করি আর না-ই করি, সলিলপন্থী মনে করা যায়। ভেবে ভালো লাগে যে, নিজের মধ্যে একটুকরো সলিল চৌধুরীকে নিয়ে চলছি আমি। যে সলিল শুধু ঝড়ের কাছেই নিজের ঠিকানা রেখে যান, ঠিক "পাগল হাওয়া"র মতো।