Monday, March 06, 2017

নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ - প্রথম পর্ব

বেশ একটা আবেশ করার মতো ঠান্ডা আবহাওয়া। আমরা দুজন পাশাপাশি ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছি। এভাবে আমরা কলেজের শীত-গ্রীষ্মতেও হোস্টেল থেকে ক্যাম্পাসের গেট অব্দি হেঁটে যেতাম, ঝালমুড়ি-তেলেভাজা খেতে। তবে এবারে আমরা বেড়িয়েছি স্রেফ চারপাশটা একটু দেখতে, আর কিছু ভালো পানীয়ের সন্ধান পেতে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, কলেজ থেকে আজকের এই মার্কিন মুলুকের পাশাপাশি হাঁটা - বেশ অনেকটা পথ হয়ে এলো। আমরা দুজনেই এরকমটা হতে পারে, ভাবিনি কোনোদিন। আমাদের ব্র্যাকগ্রাউন্ড যেরকম, তাতে ভাবাও সম্ভব না। আমি সরকারি চাকুরের ছেলে, মধ্যমেধার ছাত্র। আর আমার বন্ধুটি চাষির ছেলে, পরীক্ষার নম্বরের দিক থেকে আমারই মতন। কিন্তু তারাই আজ, কিছুটা ভাগ্য, আর কিছুটা চেষ্টার জোরে, বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহরে ঘুরতে বেড়িয়েছি।


লন্ডন-প্যারিস-নিউ ইয়র্ক - বিশ্বের এই তিনটে জায়গার নাম একসাথে উচ্চারিত হয়, এই শহর তিনটের আলাদা আকর্ষণের জন্য। এদের মধ্যে নিউ ইয়র্ককে বিশ্বের বাণিজ্যিক রাজধানী বলেন অনেকেই। বাণিজ্য, ব্যবসা - এই   শব্দগুলোর মধ্যে কোথাও যেন একটা কাঠিন্য লুকিয়ে আছে। মনে হয়, শব্দগুলোর বুঝি হৃদয় নেই, আবেগ নেই। কিন্তু তাও কোনো একটা আবেগের তাড়না থেকেই আমরা ২০১৭ সালের শুরুটা নিউ ইয়র্কেই করতে গেলাম ।


আমি বস্টনে থাকি। সেখান থেকে চার ঘন্টায় বাসে করে, নিউ ইয়র্কে আমরা পৌঁছলাম বিকেল নাগাদ। এক হোমস্টেতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম আমরা। এই ধরণের থাকায় দুটো সুবিধে: এক, একটু কম খরচায় থাকা যায়, হোটেলের থেকে। দুই, জায়গাটার খুঁটিনাটি সম্পর্কে, যার বাড়িতে থাকছি, তার থেকে অনেক কিছু ব্যক্তিগতভাবে জানা যায়। এছাড়াও নতুন মানুষের সাথে পরিচয়ের সুযোগ থাকে, তাতে নিজের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির দিগন্তটা আর একটু বিস্তৃত হয়। জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা বড় উদ্দেশ্য তো নিজের যে কোনো ধরণের দিগন্তের বিস্তার ঘটানো। এই ধরণের থাকার ব্যবস্থায় সেটা সাবলীলভাবেই হয়। আমরা নিউ ইয়র্কে ছিলাম বালুচিস্তানের (পাকিস্তান) এক মধ্যবয়স্কা মহিলার বাড়িতে। তিনি যথেষ্ট আপ্যায়নের সাথেই আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করেছিলেন।


নিউ ইয়র্ক শহরের মধ্যে যদি হৃদয় বলে কিছু থাকে, তাহলে টাইমস স্ক্যোয়ারের কথাই বলতে হয়। আমরা প্রথম দিন পৌঁছেই সন্ধ্যেবেলা সেখানে চলে গেলাম। পৌঁছেই অবাক হয়ে গেলাম। প্রচুর লোক সেখানে আনন্দে মাতোয়ারা। রাস্তার ধারে স্ট্রিট ফুড তৈরী হচ্ছে। সকলে ফটো তুলছেন। রাস্তা পেরোতে কেউ লাল-সবুজের তোয়াক্কা করছেন না। এ যেন এশিয়ার কোনো বড় শহরের ছবি। এমনিতে মার্কিন মুলুকের বেশিরভাগ শহরে এ ছবি দেখাই যায় না। আমরা এসব দেখে, খেয়ে ফেললাম বীফ স্যান্ডউইচ, রাস্তার ধার থেকেই। মোটামুটি কম দামের মধ্যে বেশ মুখরোচক খাবার। আর খিদে পেলে, যে কোনো খাবারের মধ্যেই একটা আলাদা স্বাদের আবির্ভাব হয়। তাই স্যান্ডুইচটা একটু বেশিই ভালো লেগে গেলো খেতে।


এর পরে আমরা দেখতে থাকলাম চারদিক, আর অবাক হলাম। বিশাল বড় বড় নিয়ন আলো দিয়ে তৈরী ডিসপ্লে বোর্ড। সেখানে বিশ্বের নামিদামি মডেল, অভিনেতারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন বিভিন্ন ব্যান্ডের। সেই বিজ্ঞাপনের নীল আর লাল আলো সাধারণ মানুষের উপর পড়ছে, আর তারাও যেন খানিকটা রঙিন হয়ে উঠছেন, তাদের সাদা-কালো জীবনকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখে।


নিউ ইয়র্কের সারা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রচুর মিউজিয়াম। কোনোটায হয়তো আছে ভ্যান গগের পুরোনো পেন্টিং। কোনোটায় দারুন সব স্থাপত্য, আবার কোনোটায় মহাজাগতিক বিশ্ব থেকে ধার করে আনা ছবি। আমাদের পক্ষে সব কিছু দেখা সম্ভব ছিল না। কারণ আমাদের হাতে সময় কম, আর অর্থ তো চিরকালই সীমিত। তাই আমরা ঘুরে দেখেছিলাম ৩-৪টি জায়গা - ম্যাডাম ট্যুসো মিউজিয়াম, আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টোরি, আর মিউজিয়াম অফ সেক্স। এছাড়া নিউ ইয়র্ক শহর আরো একটা যে কারণে বিখ্যাত - তা হল এখানের লম্বা লম্বা হাইরাইস গুলো। আকাশকে ভেদ করে চলে যাওয়া এই বিল্ডিংগুলো যেন মানুষের কীর্তিকে সদম্ভে প্রকাশ করে। আমরা এর মধ্যে অন্যতম প্রধান দুটো বিল্ডিং-এর শীর্ষে উঠেছিলাম (যেগুলোতে উঠতেও প্রবেশমূল্য দিতে হয়) - এম্প্যায়ার স্টেট্ বিল্ডিং, রকাফেলার সেন্টার।

এই সমস্ত জায়গা ঘুরতে ঘুরতে প্রচুর মানুষ দেখেছি, তাবড় তাবড় শিল্পীর দুর্দান্ত সব সৃষ্টি সেখানে। এতকালের সভ্যতার ইতিহাসের টুকরো টুকরো সাজানো আছে অনেক জায়গায়। ম্যাডাম ট্যুসো মিউজিয়ামে বিশ্বের বিখ্যাত মানুষদের মোমের মূর্তিগুলো দেখছিলাম। মানুষের বাইরেটাকে কিভাবে সহজে আবদ্ধ করে নেওয়া যায় - তা বোধ হয় এখানে আসলেই বোঝা যায়। মানুষের ভিতরের নীতি, বোধ, জীবনচর্চাই যে তার প্রকৃত স্বাক্ষর, সেটা এই বাহ্যিক মোড়কগুলো যেন আমাদের সামনে খুলে দেয়। আবার অন্য এক মিউজিয়ামে মানুষের আদি-অনন্তকাল থেকে যে আদিম চাহিদা, যে যৌন আকাঙ্খা - যার সাহায্যে আমরা পৃথিবীকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলতে পারি - তার বিবরণ। রকাফেলার সেন্টারের চূড়ায় উঠে মনে হচ্ছিলো - এদের এই এতো উঁচু বিল্ডিং যারা তৈরী করলো, তারা কি আর এখানে উঠে দেখতে পারে! তাদের নিজেদের সৃষ্টির স্বাদ কি তারা উপভোগ করতে পারে? আবার এই রকাফেলাররা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় গত একশো বছর ধরে তেলের সাহায্যে নিজেদের বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। তাই ওই বিল্ডিং-এর উপরে উঠে, নিচে তাকিয়ে আমার বন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলাম, নিজে কি দেখছিস? ও বলেছিলো, ছোট ছোট অনেক আরো বিল্ডিং দেখতে পাচ্ছি। আমি বলেছিলাম, আমি কি দেখছি জানিস, শত শত মানুষের ঘাম।

No comments:

Post a Comment