ফ্যানটা বেশ জোরে ঘুরছিলো। বসন্তের সকালের মৃদু বাতাস মুখে মেখে এসে, ওই সিলিং ফ্যানের কৃত্তিম হাওয়ার গায়ে এসে পড়াটা মেনে নিতে, সামান্য অসুবিধে হচ্ছিলো অমিতের। কিন্তু মনের ভিতরের উথালপাথালকে শান্ত করতে, ফ্যানের হাওয়ার কৃত্তিম আদরটাই সাহায্য করছিলো। কিছুক্ষন বসে বসে সে ঝড়ের প্রতীক্ষা করলো। অবশেষে সামনে এলো পর্দার পিছনের মানুষরা, মানে অমিতের প্রেমিকার মা আর বাবা। শুরু হলো অমিতের সাথে তাদের এক অসম আলোচনা।
অসফল সেই আলোচনার শেষে বিদায় নিলো অদৃশ্য পর্দায় আবৃত সেই ছায়ামানুষগুলো। ছায়ামানুষদের তো আসল আকৃতি বা গঠন হয় না। শুধু তাদের অবয়বটা বোঝা যায়। সেই অবয়বগুলোই ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে মিলিয়ে গেলো। পড়ে রইলো - অমিত, ফ্যানটা, আর অমিতের অস্বস্তি, মানে সুনয়না। তারা আর কতক্ষন দূরে থাকতে পারে! অমিতের ডান-বুকে নেমে এলো অস্বস্তির বারিধারা।
অমিত তার একটু আগেই সুনয়নাকে শেষবারের মতো জানতে চেয়েছিলো যে, সুনয়না শুধু তাকেই ভালোবাসে কিনা! উত্তরে সুনয়নার চোখের জলের মানে বুঝতে অমিত ভুল করেনি। অমিতের মাথা তখন হিমশীতলের মতো ঠান্ডা। হয়তো সেই প্রথমবার মাথা বুঝতে পেরেছিলো, আজ মনের কোণে মরুভূমির তপ্ত বালি আছড়ে পড়ছে, তাই ভারসাম্য রাখতে তাকে ঠান্ডা থাকতে হবে। অমিতের বুকে নেমে আসা সুনয়নার বরফের মতো ঠান্ডা চোখের জল, তার হৃদয়কে অদ্ভুতভাবে বেশ উষ্ণ করে তুলেছিলো। কিছুক্ষন সে যেন এক নিরাকার পাথরের মতো বসেছিল, হয়তো উষ্ণতার এই অবাঞ্ছিত তারতম্যের জেরেই। সে নিজের অস্তিত্বের মানে বোঝেনি। অমিতের মনে হচ্ছিলো, তার হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সযত্নে রাখা কিছু অস্থাবর। তবুও অমিত সুনয়নার চোখের জলকে তার বুকে নিবিড় স্থান দিয়েছিলো।
অমিতকে এর পরেও সুনয়নার মা খেতে বসতে বলেছিল। উনি তখনও জানতেন না, ওনারা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কি হয়েছে। উনি বা সুনয়নার বাবা কেউই জানতেন না - অমিতের হৃদয় সদ্য ভেঙে গিয়ে এক নদীর জন্ম হয়েছে, সুনয়নার চোখের জলেই যে নদী সম্পৃক্ত। গলার কাছে দলা, আর মুখের কাছে ভাত - সেই প্রথম অমিত একসাথে খেয়েছিল।
অবশেষে সন্ধ্যে নাগাদ, কোনো এক রাস্তার ধারে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল অমিত। তখন সে দেখেছিল - নিচে রেললাইন, আর উপরে সেতু, সে সেতু মিশে যাচ্ছে আর একটা সেতুতে, সারি সারি গাড়ি এসে নামছে নিচের রাস্তায়, আবার গাড়িগুলো সেতুতে উঠে যাচ্ছে। নিয়ন আলোয় বিরিয়ানির গন্ধ, মেশিনে ছেপে যাচ্ছে অজস্র টাকা, আর তারই পাশ দিয়ে দু'টো পা হেঁটে যাচ্ছে। অমিত বোঝেনি কি করে সেই পা দু'টো ওকে বয়ে নিয়ে চলছিল। সকালের সেই ফ্যানটা তখনও ঘুরছিলো কিনা জানা নেই, তবে অমিত চলছিল।
No comments:
Post a Comment