ফেসবুক একটি ভিডিওর মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে আমার এই বছরের সারসংক্ষেপ। সেটা দেখতে দেখতেই মনে হল, ফেসবুকের পক্ষে তো সব কিছু জানা সম্ভব নয়। এ বছরে যে চলমান ছবিগুলো বাস্তবের সীমারেখা পেরিয়ে মনের পরিখায় আটকে গেলো, সেগুলো তো একমাত্র আমার ব্যক্তিগত হাসি-কান্নার রাংতায় মোড়া বাক্সে রাখা। সেই ছবিগুলোর কিছু কিছু, অনুভূতির রংতুলি দিয়ে লেখার মধ্যে দিয়ে এঁকে দিতে ইচ্ছে করছে। কোনো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তো এই ছবি থেকে লেখায় রূপান্তরের বিদ্যে এখনো রপ্ত করতে পারেনি। তাই এই লেখা, সেইসব ছবি, দৃশ্য এবং চিত্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্যে, যেগুলো ২০১৬-কে ফ্ল্যাশব্যাকে ধরে রাখবে।
একটা বছরের চলে যাওয়া, শুধুই একটা নতুন বছরের, নতুন শুরুর আশা নিয়ে আসে তা-ই নয়, এর মধ্যে একটা স্বস্তিও থাকে, অনেকটা পথ ক্লান্ত হয়ে হেঁটে আসার। কোনো এক বছরের শেষে, কেউ কেউ হয়তো ক্ষতবিক্ষত হয়ে থাকে, কেউ কেউ আবার জীবনের সব থেকে মধুর সময়গুলো কাটিয়ে আসে। সব মিলিয়ে একেকটা বছর, জীবনের একেকটা পাতা ওল্টানো। পুরোনো পাতার সব অক্ষরগুলোই চেনা, কিছু অক্ষরের প্রতি খুব মায়া পড়ে যায়। মনে হয় সেই অক্ষর দিয়ে তৈরি লাইনগুলোকেই বারবার আওড়াই। কিন্তু নতুন পাতাও যে অপেক্ষা করে থাকে, নতুন সম্ভাবনা, নতুন সঙ্গীত, নতুন বাক্য নিয়ে। ছোট ছোট সেসব নতুন বাক্য দিয়েই তো জীবনের গদ্য কোনো এক ছন্দে মিশে যায়। এই লেখা পুরোনো পাতার ফেলে আসা কিছু বাক্যকে এক ঝলক দেখে নেওয়ার। যদি সেই ঝলকের মধ্যে, সেই দৃশ্যপটের ভিতর কোনো কবিতার ছন্দ লেখা হয়ে গিয়ে থাকে, তার কিছুটা হয়তো উদ্ধার হবে।
--প্রথম দৃশ্য--
চারিদিকটা খুব কম আলো। তবে অনেক মানুষ ঘোরাফেরা করছে, সবাইকে চিনিও না। কিন্তু আমারই সব থেকে বেশি চেনা উচিত ছিল সবাইকে। আর কিছুক্ষন বাদেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। হাতের ছোট্ট চিরকুটটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। সেই চিরকুটে আমার ভয় কাটানোর জরিবুটির কিছু ফর্মুলা লেখা আছে। এসি হলের ভিতরেও কপালের বিন্দু বিন্দু ফোঁটা জানান দিচ্ছে যে, স্টেজের সামনে দাঁড়াতে ধক লাগে। শেষ পর্যন্ত এলো, স্টেজের পাশ থেকে সামনে যাওয়ার আহ্বান।
মাইক পেলাম হাতে। নাঃ, সামনের বিশাল দর্শকরা সবাই সংখ্যায় পরিণত। তাদের নিজেদের পরিচয় নেই আর। স্টেজের ওপর একটি আলো শুধু আমার ওপরই তাক করা। আমরা আলোয় থাকলে কিভাবে অন্ধকারের মানুষগুলো স্রেফ সংখ্যায় বা স্ট্যাটিস্টিক্সে পরিণত করি, তা বুঝছিলাম। যাই হোক, তখন মনে হলো, বিশ্ব-সংসার যেন বলতে চাইছে, তোমার নামের ভার তুমি কি বুঝতে পারছো, সোহম ? এই চরাচরের বিধাতা হওয়া, তার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া এতো সহজ নয়। বিশ্ব-সংসারের হিউমার আছে বলতে হয়। আমিও বোধ হয় সেই মহাবিশ্বের ডাককে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে শুরু করলাম আমার ছোট্ট বক্তব্য।
৩ মিনিটের সে কথা, যেন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছিলো। হয়তো যখন সকলের সামনে আমরা একা হয়ে যাই, তখন অন্য গ্রহের হিসেবমতো সময় মেনে চলি। পরে ভিডিও দেখে বুঝেছিলাম, বেশ ভালোই উৎরেছিলো সেই ছোট্ট বক্তব্য। কেউ কেউ ছবিও তুলেছিল, এবং তাতে আরো আত্মবিশ্বাসী লাগছিলো দেখে। কিন্তু কোর্ট-প্যান্ট পরে প্রায় সকলকেই তা-ই লাগে। আমার মনে হয়, কোর্ট-প্যান্ট পোশাকটা তৈরিই করা হয়েছে এই উদ্দ্যেশ্যে - যাতে বড় হয়ে গেলেও, ছোটবেলায় আমরা স্কুলে যেমন পোশাকের নিরিখে এক হয়ে যেতাম, সেইরকম খানিকটা এক হয়ে যেতে পারি। কিন্তু কোর্টের ভিতরের বেগুনি রঙের জামাটা একটা আলাদা মাত্রা দিয়েছিল যেন, পছন্দটা যদিও অন্য এক পূর্ব-প্রিয় মানুষের ছিল...
--দ্বিতীয় দৃশ্য--
ফ্যানটা বেশ জোরে ঘুরছিলো। বসন্তের সকালের মৃদু বাতাস মুখে মেখে এসে, ওই সিলিং ফ্যানের কৃত্তিম হাওয়ার গায়ে এসে পড়াটা মেনে নিতে সামান্য অসুবিধে হচ্ছিলো। কিন্তু মনের ভিতরের উথালপাথালকে শান্ত করতে, ফ্যানের হাওয়ার কৃত্তিম আদরটাই সাহায্য করছিলো। কিছুক্ষন বসে বসে ঝড়ের প্রতীক্ষা করলাম। অবশেষে সামনে এলো, পর্দার পিছনের মানুষরা। শুরু হলো আমার সাথে তাদের এক অসম আলোচনা।
অসফল সেই আলোচনার শেষে বিদায় নিলো অদৃশ্য পর্দায় আবৃত সেই ছায়ামানুষগুলো। পড়ে রইলাম, আমি, ফ্যানটা, আর আমার অস্বস্তি। তারা আর কতক্ষন দূরে থাকতে পারে ! আমার ডান-বুকে নেমে এলো অস্বস্তির বারিধারা। আমার মাথা তখন হিমশীতলের মতো ঠান্ডা। হয়তো সেই প্রথমবার মাথা বুঝতে পেরেছিলো, আজ মনের কোণে মরুভূমির তপ্ত বালি আছড়ে পড়ছে, তাই ভারসাম্য রাখতে তাকে ঠান্ডা থাকতে হবে। আমার বুকে নেমে আসা বারিধারা, আমার হৃদয়কে অদ্ভুতভাবে, বেশ উষ্ণ করে তুলেছিলো। কিছুক্ষন আমি যেন এক নিরাকার পাথরের মতো বসেছিলাম। আমার নিজের অস্তিত্বের মানে বুঝিনি। মনে হচ্ছিলো, হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে কিছু সযত্নে রাখা অস্থাবর।
মনে পড়ে, এর পরে আমাকে খেতে বসতে বলা হয়েছিল। গলার কাছে দলা, আর মুখের কাছে ভাত - সেই প্রথম একসাথে খেয়েছিলাম। অবশেষে সন্ধ্যে নাগাদ, কোনো এক রাস্তার ধারে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। তখন দেখেছিলাম, নিচে রেললাইন, আর উপরে সেতু, সে সেতু মিশে যাচ্ছে আর একটা সেতুতে, সারি সারি গাড়ি এসে নামছে নিচের রাস্তায়, আবার সেতুতে উঠে যাচ্ছে। নিয়ন আলোয় বিরিয়ানির গন্ধ, মেশিনে ছেপে যাচ্ছে অজস্র টাকা, আর তারই পাশ দিয়ে, দু'টো পা হেঁটে যাচ্ছে। বুঝিনি কি করে সেই পা দু'টো আমাকে বয়ে নিয়ে চলছিল। সকালের সেই ফ্যানটা তখনও ঘুরছিলো কিনা জানিনা, তবে আমি চলছিলাম।
--তৃতীয় দৃশ্য--
আবার চারিদিকটা অন্ধকার, কিন্তু চারপাশে চেনা শুধু চারজন। সামনে ড্রাইভারদা আছেন। গাড়িটা জঙ্গলের নিস্তব্ধতার সঙ্গে কিছুটা ঝগড়া করেই এগিয়ে চলেছে। তবে তাতে গাড়ির গতিতে কোনো খাদ পড়েনি। আবহাওয়ার মাদকতা, যে কোনো পানীয়ের মাদকতাকে ম্লান করে দিতে পারে, সেটা বেশ বুঝতে পারছি। বর্ষাকালের পাহাড়ে গাড়ির জানালায় যে হাওয়াটা পাওয়া যায়, সেই হাওয়াটা আমার মুখে ঝাপ্টা দিয়ে যেন বলছে, স্নিগ্ধতার সংজ্ঞা এখান থেকেই অভিধানে লেখা হয়েছিল। আমিও ভেসে যাচ্ছি প্রকৃতি আর আমার চার বন্ধুর সাহচর্যের এক নিশ্চিন্ত সান্নিধ্যে। সেই দুরন্ত অমানিশায় আলো বলতে ছিলাম বোধ হয় আমরা ওই পাঁচজন।
এরপরে আমি হয়ে গেলাম অন্য চারজনের একজন। সেখানে একটা বড় ঘর, দুটো বিছানা। খুচরো নস্টালজিয়া, আর দু-একটা আফশোসকে আমরা কাঁচের গ্লাসে ঢালছি। পেটের ভিতরে গিয়ে সেগুলো এক মুখ থেকে অন্য মুখে ছড়িয়ে পড়ছে। সামনে রাখা টিভিটাও সেটা টের পেয়ে পুরোনো দিনের গান শোনাতে শুরু করলো। আমরা কিন্তু সেদিনই দিনের বেলা এক চূড়ায় উঠেছিলাম। তাই সেই রাতের গল্পের শেষও হয়েছিল, কোনো অন্য চূড়ায় আবার দেখা হওয়ার অঙ্গীকার করে।
তারপরে আবার অন্য এক দলের অংশ হয়ে গেলাম। মেঘের আলয়ে আলো যে এতো কারবার করে, সেটা তার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিপত্তি না দেখলে, কোনোদিন বুঝতে পারতাম না। তবে অবাক হয়ে দেখলাম, কিভাবে মেঘ আর আলো - দুজনে একসাথে সংসার করে। সংসারে দুই বিপরীতের এক আশ্চর্য সহবাস। একটুকরো মেঘ আমি ধার করে এনেছি, আমার বস্টনের সূর্যকে দেব বলে। ওরা দুজনেও বন্ধু পাতাক, আমি জানালায় বসে ওদের প্রেম দেখবো। যে প্রেমের রং শুধু নীল নয়, লাল, মেরুন, আকাশি, হলুদ, তুঁতে, সবুজ দিয়ে ঘেরা। যেভাবে মন্দারমণীর মতো সমুদ্রপাড়ে, "পাহাড়তলী"-এর বাতাস বিভিন্ন রঙে ধোয়াঁশা হয়ে থাকে। আমরা সেই ধোঁয়া হয়ে আসা আশায় গানের সুর বসাই। আর সেই গান শুনে ওখানকার গাছগুলোও আনন্দে আত্মহারা হয়, যেন নতুন করে প্রাণ পায়। আমরাও তারপরে একরাশ প্রাণ নিয়ে কলকাতা ফিরে আসি।
--চতুর্থ দৃশ্য--
বেশ দেরি করে সকালে উঠেছি। প্রায় ন'টা বেজে গেছে। রিসার্চের জীবনটা যদিও এরকমই। সময়টা যেন আমার নির্দেশ মেনে চলবে। যত বলি একটু নিজের নিয়ম, জগতের নিয়মের খেয়াল রাখতে, সে প্রকৃতই আমার দাস। মনিব হতে আমার ভালো না লাগলেও, *সময়ের* ওপর এই দাসত্ব ফলাতে মন্দ লাগে না। সেই পোষ মেনে যাওয়া মিষ্টি সময়, যখন বিছানার সাথে আপোষের আর কোনো সুযোগ দিচ্ছে না, তখন উঠতেই হয়। শেষ পর্যন্ত শবাসন শেষ করে, উঠে বসলাম। তখনই আমার মোবাইল জানান দিলো, পৃথিবীর কোনো প্রান্তে আমার প্রসঙ্গ উত্থাপন হয়েছে। একটি উড়োচিঠি আমার মোবাইলে তার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। এই চলমান অবিশ্রান্ত বার্তাগুলোই আমাদের স্থবিরতাকে আজকাল টুঁটি টিপে মেরে ফেলে। আমিও নিজের আরামদায়ক অবস্থান ছেড়ে হাতে তুলে নিলাম ছোট্ট পৃথিবীকে, খুললাম ইমেইলটি।
আমার দৈহিক শক্তির যদি একটি মাত্রা করা যায় ১ থেকে ১০০ অব্দি, তাহলে ঘুম থেকে ওঠার সময় সেই শক্তির মান ছিল ঋণাত্বকভাবে ২০ (-২০). যখন হাতের মুঠোতে ফোনটা ধরি ইমেইল দেখার জন্য, সেই শক্তির মাত্রা ছিল +১০. আর ইমেইলটার প্রথম দু'লাইন পড়ার পরে সেই মান গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় +১১৫. এবং বিছানা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, বিছানাতে ৩টে ঘুসি মারি সজোরে। ঠিক যেভাবে অরিন্দম "নায়ক" সিনেমাতে বলেছিল, "I will go to the top, the top, the top." ফেব্রুয়ারির সেই দু' তারিখে পেয়েছিলাম প্রথম PhD-র জন্য admission letter. top না হোক, একটা ভীষণ বড় relief. বুক থেকে একটা পাথর নেমে যাওয়া, মাথা থেকে একটা ভার সরে যাওয়া। তারই দৈহিক প্রকাশ ঘুসিগুলো। যদিও সেই University পরে join করিনি, কিন্তু ওই অনুভূতিটার কোনো বিকল্প হয় না। বছরের সেরা মুহূর্তও বোধ হয় ওইটেই।