জানালা দিয়ে তাকালে এখন নীল আকাশে পেঁজা তুলো দেখা যাচ্ছে, রোদ ঝকঝকে চারপাশে বাংলার শরতের ছায়া। তবে বাইরে বেরোনো গেলে কম তাপমাত্রা আর আরামদায়ক ঠান্ডা বাতাস পেতাম। কিন্তু বাইরে বেরোনোর উপায় না থাকায়, বড় জানলাটা দিয়ে মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে সময় কাটানো যায়, তখন রোদ্দুর আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে গায়ে। মানুষের ছোঁয়া বহুদিন পাওয়া হয়ে ওঠে না। অন্য কারোর সরাসরি দৃষ্টিও আমার ওপর পড়েনি বহুদিন, তাই ভাবি, মেঘগুলোই বিভিন্ন রূপ নিয়ে আমাকে দেখে উধাও হয়ে যায়। ওরা কি বলতে চাইছে বুঝতে পারিনা, ভীষণ রকম নীরব। ওদের গতিও ভীষণ মন্থর। আমিও নীরব চোখে চেয়ে থাকি, নীরবতার ভাষায় আমরা কথা বলি। এটা হয়তো কোনো ক্রিয়েটিভ প্রসেস নয়, কিন্তু আমাদের এই যোগাযোগে সৃজন আছে, বহুদূরের বন্ধন তৈরী করা আছে। এই মেঘটাই তো উড়ে উড়ে অন্য কোনো মানুষকেও আমার সাথে বেঁধে ফেলছে। এই সৃষ্টিতে, এই বন্ধনে, এই কথোপকথনে কোনো ব্যাকরণ নেই, কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
অথচ চারিদিকের শিল্পে শুধুই যেন প্রাতিষ্ঠানিকতা, মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে। শিল্প বিষয়টার মধ্যে যে স্বতঃস্ফূর্ততা, কোথায় যেন তা ভীষণরকম ভাবে হাঁসফাঁস করতে থাকে। কিছুদিন আগের সত্যজিৎ-এর জন্মদিন উদযাপনে আর তারপরের রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনে বারবার সেই প্রাতিষ্ঠানিকতার আড়ম্বর। প্রাতিষ্ঠানিকতা শব্দতে স্বততঃই একটা নেতিবাচক ধারণা আছে। কিন্তু একটা প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু সংখ্যক সমমনস্ক মানুষকে কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দেয়। সেটা শুধু যে সেই মানুষদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা তৈরী করে তা নয়, সেটা একটা শিল্পচর্চার প্ল্যাটফর্ম তৈরী করে, একটা ফ্রেমওয়ার্ক তৈরী হয়। কিন্তু সমস্যার শুরুও হয় ঠিক সেখান থেকেই।
সেই ফ্রেমওয়ার্ক এবং প্ল্যাটফর্মের অনুরাগীরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি বেশি যত্নবান হতে গিয়ে রক্ষণশীল হয়ে পড়েন। তার থেকেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় আত্মম্ভরিতা, এলিটিসম এবং কোথাও গিয়ে এনটাইটেলমেন্ট। শিল্প তার বিবর্তনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলে, বিবর্তনের শিল্পীদের একঘরে করে দেওয়া হয়, জর্জ বিশ্বাসের "ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত" লিখতে হয়। যে কোন প্রতিষ্ঠানের যে প্রকৃত ভালো দিকগুলো, যার কারণে কোনো প্রতিষ্ঠান "প্রতিষ্ঠান" হয়ে ওঠে, তা কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকে। আমরা ভুলে যেতে থাকি, আসলে এসব প্রতিষ্ঠান তো স্রেফ একেকটা "tag", এর থেকে বেশি তো কিছু নয়। কোনো "জাতে" ওঠার একটা রাস্তা মাত্র। আসল বিষয়টা হল তো সৃষ্টিটা, তার ভালো-খারাপ দুইই থাকে। প্রাতিষ্ঠানিকতা তার বিশালত্বের নেশায় খারাপ দিকগুলো ছুঁড়ে ফেলতে থাকে বিস্মৃতিতে, পড়ে থাকে শুধু একটা ঝাঁ-চকচকে bubble।
শুধু শিল্পে তো নয়, এই প্রতিষ্ঠানের আমদানি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, স্কুল-কলেজ-অফিস। অথচ আমরা যদি পারতাম নিজেদের গর্বটাকে একটু সরিয়ে রাখতে, তাহলে প্রতিষ্ঠান শুধুই অন্তরঙ্গতার জায়গা থাকতে পারতো। কোনো প্রতিষ্ঠানই নিজের চারিধারে অহং-এর বেড়াজাল তৈরী করতে পারতো না। শিল্পের ক্ষেত্রে বিশেষ করে তা তৈরী করতো স্বচ্ছ নদীর মতো বহমানতা। সেই নদীতে সাদা মেঘের ছায়া পড়তো, যে মেঘেরা নতুন রূপে উড়ে যেত নতুন নতুন মানুষের কাছে, অদৃশ্য বন্ধনে আমরা নিজেদের বেঁধে নিতাম।
No comments:
Post a Comment