ক্লাসিকাল ইকোনোমিক্স তত্ত্বে শিল্প একটি কমোডিটি ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু আদপে শিল্প তো শুধু তাই হতে পারেনা, শিল্পের একটা দ্রব্য ধর্ম ছাড়া তাতে পুঞ্জীভূত থাকছে আমাদের অনুভূতি, অভিজ্ঞতা জাতীয় আপাতভাবে বায়বীয় কিছু বস্তু। আবার আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা শিল্পকে আহরণ করতে পারারও উপযোগী করে তুলছে। তাই শিল্প শুধু সৃষ্টিকর্তার হয়ে থাকছে না, তা দর্শক, শ্রোতা বা পাঠকের হয়ে উঠছে। মানে শিল্প সৃষ্টির বিপরীত প্রান্তে যারা শিল্পকে ভোগ করছে, শিল্প তাদের মাধ্যমে নতুন মাত্রা পাচ্ছে। সেদিক থেকে দেখলে ক্লাসিকাল ইকোনমিক্সের তত্ত্ব ভুল কিছু নয় - শিল্পের একটা উৎপাদন (production) এবং ব্যবহার (consumption) আছে। এই অর্থনীতিকে ভিত্তি করে ভাবতে শুরু করলে আমরা শিল্পের সামাজিক বাস্তবতার আলোচনায় ঢুকে পড়তে পারি - যেটা আপাতত করতে চাইছি না। আমরা শিল্পের বিমূর্ত দিকটার গভীরে ঢুকবো।
শিল্পের এই যে দ্বিমাত্রিক ক্ষমতা - উৎপাদন এবং আহরণ - মানবপ্রজাতির এক স্বতন্ত্র উদ্ভাবন। দুটো কাজেই মানুষ কিছু আনন্দ, দুঃখ বা অন্য অনুভূতি পেয়ে থাকে। সুতরাং, শিল্পের দু' প্রান্তেই মানুষের কিছু পাওয়ার আছে। অবশ্য সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে শিল্পীর তার শিল্পের ব্যবহার সম্পর্কে ভাবিত থাকার কোনো কারণ নেই। কিন্তু শিল্পের এই যে বহুমাত্রিক ভূমিকা, তা মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী বিকশিত করতে পেরেছে কি না, সে আমার জানা নেই। মানুষের চিন্তা এবং বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা শিল্পকে মানুষের জীবনে এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। সাথে বিজ্ঞানের অগ্রগতি নতুন ধরণের শিল্পমাধ্যম তৈরী করছে - যেমন সিনেমা, ফটোগ্রাফি, ইত্যাদি।
আবার বিজ্ঞানের এই প্রগতির মাধ্যমেই এখন আমরা আমাদের এই বিশ্লেষণী ক্ষমতা অনু-পরমাণুর মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছি। যেখানে বহু ইলেকট্রন দৌড়াদৌড়ি করে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে বিশ্লেষণের ক্ষমতা পাচ্ছে। যদিও এই প্রযুক্তি এখনও শিশুসুলভ, কিন্তু আমরা সহজেই মেশিনপ্রদত্ত গভীর বিশ্লেষণের অনুমান করতে পারছি। এই ধরনের সন্ধিক্ষণে আমি মানবসৃষ্ট শিল্পের আরো গোড়ায়, আরো ফান্ডামেন্টাল-এ ঢুকতে চাইছি। আমি খুঁজে পেতে চাইছি সেই শিল্পমাধ্যমকে যার জন্য মানুষ শুধু নিজেই মাধ্যম, তার আর অন্য কোন মাধ্যম লাগছে না। মানে ধরা যাক, আঁকতে গেলে লাগছে কাগজ, পাথর, রং, তুলি বা পেন্সিল; সাহিত্যে কালি ও কাগজ। সিনেমা বানাতে ক্যামেরা। কিন্তু এমন কোন শিল্প তো আছে, যেখানে মানুষ আর প্রকৃতিপ্রদত্ত শক্তিই শিল্প তৈরী করছে।
এখানে আমরা একাধারে পাচ্ছি গানকে। এখানে সংগীতের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে শব্দ নামক শক্তি, যা রূপান্তরিত হচ্ছে অন্য কোনো শক্তি থেকে। এই শব্দশক্তিই অন্য মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে শিল্প হয়ে এবং মানুষ তা আহরণ করছে। সংগীতের বিমূর্ততা গানের মাধ্যমে এভাবেই মানুষের কাছে ভীষণ বাস্তব হয়ে উঠছে, খুব গভীরে থেকে।
অন্যপাশে আমরা পাচ্ছি নাচকে - যার মাধ্যম মূলত মানুষের পার্থিব অবস্থান ও রূপ এবং আলোকশক্তি। আলোর মাধ্যমে নাচ পৌঁছে যাচ্ছে অন্য মানুষের উপলব্ধিতে। সুতরাং গান এবং নাচকে আমরা শিল্পের একদম ফান্ডামেন্টালে পেয়ে যাচ্ছি। এছাড়া অন্য কিছু আছে কিনা, আপাতত মনে পড়ছে না। তবে গানের সাথে মানুষের এই যে আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক যোগ - এটা নিজে যেমন অনুভব করেছি, তেমনি এটাও বুঝতে পারছি যে গান এভাবেই ভীষণ বিমূর্ত হয়েও মানবসত্ত্বার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। নাচ ছাড়া, গান শিল্পমাধ্যমগুলোর মধ্যে একটা স্বকীয় জায়গা করে নিচ্ছে - এভাবে আমি আমার সংগীতপ্রীতির একটা ব্যাখ্যা তৈরী করছি।
No comments:
Post a Comment