Saturday, April 27, 2019

ডি. এন. এ - DNA

পাড়ার একটা রাস্তার ধারে খুব ছোট্ট মতন একটা মুদিখানার দোকান ছিল আগে, যখন স্কুলে পড়তাম। ওখানে এক ধরণের বিস্কুট পাওয়া যেত, নারকেলের স্বাদ থাকতো তাতে। ওই বিস্কুটটা ভীষণ ভালো লাগতো। হাইস্কুল যখন চারটে বা পাঁচটায় ছুটি হত, সেকেন্ড ব্রিজের উপর থেকে বাস ধরতে যেতাম। শীতকালে সূর্য তখন পশ্চিমাকাশের মায়া ত্যাগ করতো, আকাশটা খানিকটা লাল। নিচ দিয়ে শালিমার থেকে মালগাড়ি যাওয়া-আসা করতো খুব ধীরে ধীরে। ওই চিত্রকল্পটা এখনো মনে পড়ে যায় বারবার, ওই ছবিটা ভালো লাগে। হয়তো অপুর জন্যই রেলগাড়ির প্রতি একটা অমোঘ গ্রাম্য মায়া থেকে এই ভালোলাগা। গ্রামের দিকে যে টালির চালের বাড়ি দেখা যেত, ওগুলো আঁকতে ভীষণ ভালো লাগতো। রুলটানা খাতার পিছনে অথবা মার্জিনের ওপরে-নিচে বাড়ি এঁকে ফেলতাম, ৯-১০ টা পেন্সিলের টানেই। প্রাইমারি স্কুলে টিফিনের সময় একজন দাদু একটা চুরান বিক্রি করতো, ওটা খেতে খুব ভালো লাগতো। টিফিনের সময় যে ঘরটাতে আমরা বোতলে জল ভরতে যেতাম, সেখানে একটা স্বতন্ত্র গন্ধ পেতাম, জানিনা কিসের, হয়তো ছোট অনেক বাচ্চার সরলতার গন্ধ। এখন বেসমেন্টে যখন লন্ড্রির জন্য যাই, সার্ফ, হিটারের গ্যাস - এ সবকিছুর মেশানো অদ্ভুত গন্ধ পাই, ওটা খুব ভালো লাগে। গন্ধকে তো ডিজিটাইজ করা যায়না, তাই অন্যকে সহজে বোঝানোও কঠিন। কাচা জামাকাপড়ে হালকা জল ছিটিয়ে যখন গরম ইস্ত্রিটাকে রাখা হয়, তখন যে শব্দটা পাওয়া যায়, সেটা শুনতে ভাল্লাগে। সকালবেলা এক ধরণের পাখি ডাকতো ছোটবেলায়, সেই পাখির ডাকটা এখনো শুনতে পাই কল্পনায়, ওটা ভালো লাগে। মামাবাড়িতে গরমের দুপুরে লোডশেডিং থাকা অবস্থায়, দাদু ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করতো, "আয় ঘুম, যায় ঘুম, পাঁজা পাড়া দিয়ে", ওই গানের যে টান, তা অন্য কোনো গানে আর হয়তো পাবো না। ওই গানের ভালোলাগায় ছোটবেলা জড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে পুকুরের দিক থেকে হাওয়া এসে, পিঠের ঘামে লেগে আরাম দিতো, গান শুনতে শুনতে চোখ বুজে যেত। আমাদের নিজেদের বাড়িতে দাদু চোখ বুজে সন্ধ্যা আহ্নিক করতো, সেই সুরটাও খুব মনকেমন করানো ছিল - আমার ওই মন-কেমন ভালো লাগতো। কোনো কোনো দিন বিকেলে ক্রিকেট খেলা মিস হয়ে গেলেও খুব মন খারাপ করতো। তবে রোববার কখনো ক্রিকেট মিস হত না, কখনো চড়া রোদ্দুরে ৩টে থেকে খেলা শুরু করে দিতাম, মা দুপুরের দিকে ক্লান্তিতে তখন ঘুমোতো। আবার রোববার সকালে যখন পাড়ার কাকু চুল কেটে দিতো, ওই কাঁচির আওয়াজটা বেশ অন্যরকম লাগতো। সোমবার দিন সকালে যখন ইউনিভার্সিটির ফুটপাথ দিয়ে হাঁটি, প্রচুর মানুষ, ছাত্রছাত্রী একটা তালে হাঁটে - কাজের তাল, পড়াশোনার তাল। ওদেরকে একসাথে যখন দেখি, ওদের কোথাও আলাদা করতে পারিনা। কিন্তু সকলেরই তো একটা হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বিস্কুট আছে, একটা হারিয়ে যাওয়া গাড়ি আছে, ছবি আছে, গন্ধ আছে, শব্দ আছে, গান আছে। সেগুলোই তো ওরা। কিন্তু এরপরে ওরা সব্বাই কোনো ছোট-বড় কোম্পানিতে কাজ করা লোক হয়ে যাবে। অথবা নতুন কোনো জিনিস উদ্ভাবন করা গবেষক বা শিক্ষক বা অন্য কোন পেশার মানুষ হয়ে যাবে। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মনস্কতার মানুষ বলে আমরা তাকে চিনবো। ওদের ডি. এন. এ-কেও আমরা ডিজিটাইজ করে ফেলবো, কিন্তু ওদেরকে তো আমরা ওদের মতো করে কখনোই ধরতে পারবো না, ভাববো না এবং জানবোও না। জানার সুযোগও হবে না। তাদের ভালোলাগাগুলোও বায়বীয়তায় বিলীন হয়ে যাবে।

1 comment: