পাড়ার একটা রাস্তার ধারে খুব ছোট্ট মতন একটা মুদিখানার দোকান ছিল আগে, যখন স্কুলে পড়তাম। ওখানে এক ধরণের বিস্কুট পাওয়া যেত, নারকেলের স্বাদ থাকতো তাতে। ওই বিস্কুটটা ভীষণ ভালো লাগতো। হাইস্কুল যখন চারটে বা পাঁচটায় ছুটি হত, সেকেন্ড ব্রিজের উপর থেকে বাস ধরতে যেতাম। শীতকালে সূর্য তখন পশ্চিমাকাশের মায়া ত্যাগ করতো, আকাশটা খানিকটা লাল। নিচ দিয়ে শালিমার থেকে মালগাড়ি যাওয়া-আসা করতো খুব ধীরে ধীরে। ওই চিত্রকল্পটা এখনো মনে পড়ে যায় বারবার, ওই ছবিটা ভালো লাগে। হয়তো অপুর জন্যই রেলগাড়ির প্রতি একটা অমোঘ গ্রাম্য মায়া থেকে এই ভালোলাগা। গ্রামের দিকে যে টালির চালের বাড়ি দেখা যেত, ওগুলো আঁকতে ভীষণ ভালো লাগতো। রুলটানা খাতার পিছনে অথবা মার্জিনের ওপরে-নিচে বাড়ি এঁকে ফেলতাম, ৯-১০ টা পেন্সিলের টানেই। প্রাইমারি স্কুলে টিফিনের সময় একজন দাদু একটা চুরান বিক্রি করতো, ওটা খেতে খুব ভালো লাগতো। টিফিনের সময় যে ঘরটাতে আমরা বোতলে জল ভরতে যেতাম, সেখানে একটা স্বতন্ত্র গন্ধ পেতাম, জানিনা কিসের, হয়তো ছোট অনেক বাচ্চার সরলতার গন্ধ। এখন বেসমেন্টে যখন লন্ড্রির জন্য যাই, সার্ফ, হিটারের গ্যাস - এ সবকিছুর মেশানো অদ্ভুত গন্ধ পাই, ওটা খুব ভালো লাগে। গন্ধকে তো ডিজিটাইজ করা যায়না, তাই অন্যকে সহজে বোঝানোও কঠিন। কাচা জামাকাপড়ে হালকা জল ছিটিয়ে যখন গরম ইস্ত্রিটাকে রাখা হয়, তখন যে শব্দটা পাওয়া যায়, সেটা শুনতে ভাল্লাগে। সকালবেলা এক ধরণের পাখি ডাকতো ছোটবেলায়, সেই পাখির ডাকটা এখনো শুনতে পাই কল্পনায়, ওটা ভালো লাগে। মামাবাড়িতে গরমের দুপুরে লোডশেডিং থাকা অবস্থায়, দাদু ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করতো, "আয় ঘুম, যায় ঘুম, পাঁজা পাড়া দিয়ে", ওই গানের যে টান, তা অন্য কোনো গানে আর হয়তো পাবো না। ওই গানের ভালোলাগায় ছোটবেলা জড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে পুকুরের দিক থেকে হাওয়া এসে, পিঠের ঘামে লেগে আরাম দিতো, গান শুনতে শুনতে চোখ বুজে যেত। আমাদের নিজেদের বাড়িতে দাদু চোখ বুজে সন্ধ্যা আহ্নিক করতো, সেই সুরটাও খুব মনকেমন করানো ছিল - আমার ওই মন-কেমন ভালো লাগতো। কোনো কোনো দিন বিকেলে ক্রিকেট খেলা মিস হয়ে গেলেও খুব মন খারাপ করতো। তবে রোববার কখনো ক্রিকেট মিস হত না, কখনো চড়া রোদ্দুরে ৩টে থেকে খেলা শুরু করে দিতাম, মা দুপুরের দিকে ক্লান্তিতে তখন ঘুমোতো। আবার রোববার সকালে যখন পাড়ার কাকু চুল কেটে দিতো, ওই কাঁচির আওয়াজটা বেশ অন্যরকম লাগতো। সোমবার দিন সকালে যখন ইউনিভার্সিটির ফুটপাথ দিয়ে হাঁটি, প্রচুর মানুষ, ছাত্রছাত্রী একটা তালে হাঁটে - কাজের তাল, পড়াশোনার তাল। ওদেরকে একসাথে যখন দেখি, ওদের কোথাও আলাদা করতে পারিনা। কিন্তু সকলেরই তো একটা হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বিস্কুট আছে, একটা হারিয়ে যাওয়া গাড়ি আছে, ছবি আছে, গন্ধ আছে, শব্দ আছে, গান আছে। সেগুলোই তো ওরা। কিন্তু এরপরে ওরা সব্বাই কোনো ছোট-বড় কোম্পানিতে কাজ করা লোক হয়ে যাবে। অথবা নতুন কোনো জিনিস উদ্ভাবন করা গবেষক বা শিক্ষক বা অন্য কোন পেশার মানুষ হয়ে যাবে। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মনস্কতার মানুষ বলে আমরা তাকে চিনবো। ওদের ডি. এন. এ-কেও আমরা ডিজিটাইজ করে ফেলবো, কিন্তু ওদেরকে তো আমরা ওদের মতো করে কখনোই ধরতে পারবো না, ভাববো না এবং জানবোও না। জানার সুযোগও হবে না। তাদের ভালোলাগাগুলোও বায়বীয়তায় বিলীন হয়ে যাবে।
Saturday, April 27, 2019
ডি. এন. এ - DNA
Friday, April 05, 2019
বাংলার সামাজিক সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি
আমরা বাঙালি, আমরা দেশের মধ্যে সব থেকে উদার এবং ধর্মনিরপেক্ষ বলে নিজেদের পরিচয় দিতে ভালোবাসি। আমাদের গর্ব - পশ্চিমবঙ্গের মাটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আখড়া নয়। সারা ভারতের কাছে আমরা হিন্দু-মুসলিম একসাথে মিলে মিশে থাকার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাইরের রাজ্য আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুখ্যাতি করলে আমাদের ভালো লাগে, অহংকার হয়। কিন্তু আমরা অনেকসময় ভুলে যাই, আমরা "ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে", "গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস"-এর বাংলা। ১৯৪৬-এর সেই সময়ে প্রায় চার হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছিলেন ও আরো কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায়। সেই একই সময়ের নোয়াখালী দাঙ্গারও উত্তরসূরি আমাদের আজকের বাংলা, যে দাঙ্গা স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীও সম্পূর্ণ শান্ত করতে পারেননি। কয়েক হাজার মানুষ মারা যান।
আমরা একত্রিত বাঙালিরা উদারবাদী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিলেও, আজকের মুসলিম অধুষ্যিত বাংলাদেশ চরমপন্থী ইসলামের আশ্রয় নিয়েছে। আবার এটাও মনে রাখা দরকার আমাদের বাংলাই তৈরী করেছে আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপিকে। বিজেপির পূর্বসূরি ভারতীয় জনসঙ্ঘকে জন্ম দিয়েছিলেন আমাদের বাংলার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। শ্যামাপ্রসাদবাবু হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, এবং মনে করেছিলেন RSS, হিন্দু মহাসভা-জাতীয় সামাজিক সংগঠনগুলোর একটা রাজনৈতিক শাখা থাকা উচিত। সেই দার্শনিক চিন্তাভাবনা থেকেই আজকের বিজেপির উত্থান। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, বাংলায় হিন্দুদের ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তাধারাই রাজনীতিতে আধিপত্য করেছে। তাই আমাদের সামাজিক উদারতা এসব তথ্যের দেয়ালে খানিক ধাক্কাই খায়।
ফলত ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যায়, বাঙালির আপাত উদারবাদী মনোভাব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আড়ালে সবসময়ই উগ্রতার ও গোঁড়ামির এক চোরাস্রোত বয়ে গেছে। ব্যক্তিগত পরিসরে আমরা অনেকেই ধর্মীয়ভাবে এখনও ভীষণরকমভাবে রক্ষণশীল। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি সামাজিকভাবে আজ গ্রহণযোগ্য হলেও, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রগুলো - যেমন বিয়ে, বাড়িভাড়া - এসবদিকে গোঁড়ামি বাঙালির মধ্যেও মজ্জাগত। বাঙালি হিন্দুদের কাস্ট নিয়েও যথেষ্ট শুচিবাই আছে। সেটা শুধু গ্রামবাংলা নয়, কলকাতাতেও বেশি বই কম নেই। কিন্তু আমার নিজের বড় হয়ে ওঠায় আমি এই সাম্প্রদায়িকতা দেখতে পাইনি। হাওড়ায় আমাদের বাড়ির কাছে, মুসলিম জনসংখ্যা ভালোই, তবে সেখানেও পরিবেশ তেমন উত্তপ্ত দেখিনি কখনো। এমনকি আমার বড় হওয়ার সময়ের পশ্চিমবঙ্গে, ধর্মকে ঘিরে তেমন কোনো বাকবিতন্ডা দেখিনি। এ নিয়ে প্রথম বাড়াবাড়ি শুনি, যখন তসলিমা নাসরিনকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দেওয়া হল, ২০০৭ সালের শেষের দিকে। কলকাতায় বড়সড় দাঙ্গার মতোই হল সেবার, নেতৃত্বে ছিলেন ইদ্রিশ আলী, যিনি পরবর্তীকালে তৃণমূলের পক্ষ থেকে বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে সাংসদ হন। এর পরে পশ্চিমবঙ্গে আরো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে থাকে, ২০১৩-তে ক্যানিং, ২০১৬-তে মালদা, ধুলাগড়, ২০১৭-তে বাদুড়িয়া - কোনটা একটু ছোট, কোনটা একটু বড়।
মাঝের প্রায় আধা শতক পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইস্যুগুলোতে দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলেও, এবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে সেটাও একটা ইস্যু। এমনকি ১৯৯০-এর দশকে, যখন বিজেপি প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী হিসেবে উঠে আসছে লোকসভায়, সারা ভারত যখন মুম্বাই দাঙ্গায় আক্রান্ত, অযোধ্যা, বাবরি মসজিদ নিয়ে চিন্তিত, তখন পশ্চিমবঙ্গ নাকি মোটামুটি শান্ত ছিল। বাবা-মা-দাদুদের মুখে তাই শুনেছি। আমাদের বি.ই.কলেজের এক সিনিয়রের লেখায় পড়েছি, সেই সময় বাইরে বেরোনো নিয়ে চিন্তা থাকলেও, পুলিশ এবং প্রশাসন মোটামুটি একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখেছিল, "ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে"-র বাংলাতেও। কিন্তু যখন সারা দেশে বিজেপি উঠে আসছে, রাজনৈতিকভাবে এই শান্তি কি করে সম্ভব? বিজেপির উত্থানের পিছনে যে অনুকূল পরিস্থিতি - চরমপন্থা - তা তো সারা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও তখন ছিল। ভোটের ফলের দিকে তাকালে এর পিছনের কারণ সম্পর্কে কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
ভোটের ফলাফল বলছে, বিগত বছরগুলোতে পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী দল, কংগ্রেস (এবং পরে তৃণমূল কংগ্রেস), একটা সম্মানীয় ভোট পেয়ে এসেছে সব সময়ই। এমনকি কংগ্রেস ১৯৯৬ সালে ৪০% ভোট পায়, যা কিনা সিপিএমের প্রাপ্ত ভোটের থেকেও বেশি, যদিও তাদের আসনসংখ্যা ৯-এই সীমাবদ্ধ ছিল। বিজেপি সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে কখনো ১৫%-এর বেশি ভোট পায়নি, তাদের ভোট ১০-১১%-এর কাছাকাছিই সীমাবদ্ধ থাকতো। এমনকি সারা ভারতে যখন বিজেপি ১৯৮৯ আর ১৯৯১-এর নির্বাচনে যথাক্রমে ৮৫ আর ১২০টা সিট্ পেয়ে প্রথম একটা সঙ্ঘবদ্ধ শক্তিশালী বিরোধী হিসেবে কংগ্রেসের সামনে দাঁড়াতে শুরু করছে, তখনও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির দৈন্য দশাই ছিল। এর মূল কারণ পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের শক্তিশালী বিরোধী অবস্থান এবং এই অবস্থানকে সিপিএম-এর মান্যতা দেওয়া। এখন আমরা মূলত এটা জানি যে, সিপিএম-এর যে ধরণের সাংগঠনিক বাহুবল সেইসময় ছিল, তখন বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া খুব কঠিন হত না। কিন্তু কংগ্রেসকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অর্থ - রাজনৈতিক মানচিত্রে বিপরীত প্রতিক্রিয়ার উঠে আসা - যা এক্ষেত্রে বিজেপির উত্থানের নামান্তর হত। অন্তত ১৯৯৯ পর্যন্ত এ কাজটা অতি সতর্কভাবেই পশ্চিমবঙ্গে এড়ানো গেছিল। প্রশাসনিক, পুলিশি ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সমীকরণ - দুদিক থেকেই এই কৌশল কাজে লেগেছিল। ১৯৯৮-৯৯-এ তৃণমূলের উত্থানের পরে সমীকরণ সামান্য বদলাতে আরম্ভ করে।
কংগ্রেসের বেশিরভাগ শক্তিবল নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরী হয়। কিন্তু তৃণমূল এরপরে বিজেপির সাথে জোটের রাস্তায় যায়। বিজেপির মূল উদ্দেশ্য খুবই আদর্শগত এবং তা হল হিন্দুত্ববাদের প্রচার। তাই তারা তৃণমূলের মতো কোনো ভাবাদর্শহীন দলকেই পছন্দ করে নিজের বিস্তার করার জন্য। তৃণমূলের সাথে জোট করে বিজেপি দৃঢ়ভাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। যদিও সেই ১৯৯৯-এ অটল বিহারি বাজপেয়ির সময়ও, বিজেপি ১১%-এর বেশি ভোট পশ্চিমবঙ্গে পেতে পারেনি, তৃণমূলের সাহায্য নেওয়ার পরেও। এরপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১-এ ক্ষমতায় আসেন এবং সিপিএম-সহ বামফ্রন্টকে মূলত নিশ্চিহ্ন করার পণ করেন। ওনার মূল লক্ষ্য ছিল সিপিএম। কংগ্রেস থেকে শক্তিবল ক্রমশ তৃণমূলের দিকে স্বততই আসতে থাকে। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার ছোটখাট কাজ করলেও, মূলত ভোটে জেতার রাজনীতির ওপর জোর দেয়। তাই সেখানে চাকরি, অর্থনীতি এসব মূল ইস্যু না হয়ে, প্রধান কাজ হয়ে ওঠে ক্লাবের মাধ্যমে ভোটব্যাংককে মজবুত করে রাখা। এছাড়া সংখ্যালঘু ভোটের শক্তিশালী কনসেন্ট্রেশন করতে তৃণমূল সক্ষম হয়। ইদ্রিশ আলী-রা বিধায়ক হন। সারদার টাকা বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে পাচার হয়, জঙ্গি কার্যকলাপে। সিমি-নামক মুসলিম জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে পরোক্ষে জড়িয়ে থাকা আহমেদ হাসান ইমরান এখনো তৃণমূলের পক্ষ থেকে রাজ্যসভার সংসদ। এসবেরই প্রতিক্রিয়া-স্বরূপ ফর্মুলামাফিক বিজেপির উত্থান। ২০১৪-তে বিজেপি প্রথম ১৫%-এর গন্ডি (১৭%) পার করে পশ্চিমবঙ্গে, তাও একা লড়ে।
সেই ১৭%-এ মোদী হাওয়া যেমন ছিল, তেমনি সেখানে অন্যান্য বিরোধীদের কোনঠাসা হয়ে যাওয়াও ছিল। এর পরে, কেন্দ্রের বিজেপি রাজ্যে তৃণমূলকে বিভিন্ন তদন্তের ভয় দেখিয়ে নিজেদের পশ্চিমবঙ্গে বিস্তারের চেষ্টা করতে থাকে এবং করে। গত কয়েক বছরে RSS প্রচুর শাখা খুলেছে পশ্চিমবঙ্গে।রাজনৈতিক বিস্তারের পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদের আদর্শগত বিস্তার - RSS এবং বিজেপির অন্যতম উদ্দেশ্য। মমতা ব্যানার্জির সৌজন্যে সেটা সম্ভব হচ্ছে। এটা একদিক থেকে বিজেপির আঁতুড়ঘরে ফেরা।
পশ্চিমবঙ্গই বিজেপির আঁতুরঘর। ১৯৫১-এর সাধারণ নির্বাচনে শ্যামাপ্রসাদবাবুর জনসঙ্ঘ (যা বিজেপির পূর্বসূরি) সারা ভারতে যে তিনটি সিট্ জিতেছিল, তার দুটি ছিল পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু তার পরেও, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির কিছুদিন আগে পর্যন্ত মাথা তুলতে না পারার কারণ, শাসক এবং বিরোধী - এই দুই গোষ্ঠীই ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিল। এছাড়াও শাসক দল কখনোই ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধীদের সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে দিতে চায়নি। ফলে সুস্থ বিরোধিতার পরিবেশ ছিল, যেখানে বিজেপির উঠে আসার সুযোগ তৈরী করতে দেওয়া হয়নি। সেটা শাসক দল খুব সচেতনভাবেই করে থাকে। শাসক দল তার প্রতিপক্ষ তৈরী করে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজনৈতিক মাটিতে। পশ্চিমবঙ্গে এতদিন যাবৎ এভাবেই শাসক এবং বিরোধী দুপক্ষেই সুষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষতার আবহ টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির আমলে এসে এই চিত্র আপাতত প্রশ্নচিহ্নের মুখে। মমতা ব্যানার্জির হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির দৃঢ় পদার্পন। এখন ওনার আমলেই বিজেপির দৌরাত্ম্য ক্রমশ বাড়ছে পশ্চিমবঙ্গে।
বাংলার সাম্প্রদায়িক পরিবেশ নির্ভর করছে তার প্রধান রাজনৈতিক ও বিরোধী দল কি কথা বলবে। আর বাংলার প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল কে হবে, এটা নির্ভর করছে শাসক দল কোন বিরোধী দলকে তাঁদের সাংগঠনিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে দেবে। তৃণমূল কংগ্রেস বামপন্থীদের কোনঠাসা করে দিয়েছে, তাদের কোনোরকম সাংগঠনিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে না দিয়ে। আর কংগ্রেসকে মমতা ব্যানার্জি নিজের দলে পরিণত করেছেন। এই সুযোগেই বিজেপির একটা উত্থানের সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে এবং হচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি নিজেও সম্ভবত বুঝছেন, যে তিনি ঠিক কোন ধরণের আগুন নিয়ে খেলছেন।
বিজেপি কোনো একটি সাধারণ দল নয়। এটি একটি চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদী পার্টি। এই দলের আপাতত চাই লোকবল, যাতে তাঁরা তাঁদের আদর্শগত গোঁড়ামিকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। আর অদূর ভবিষ্যতে বিজেপির উদ্দেশ্য পুরো তৃণমূল দলটাকেই বিজেপিতে পরিণত করা। যেহেতু তৃণমূলের নিজস্ব কোনো আদর্শ নেই, তাই এই কাজটা তুলনামূলকভাবে সহজ। বিজেপি আপাতত সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছে। বিজেপির প্রথমদিকের লোকবল তৈরী হয়েছে সাধারণ সিপিএম ভোটারদের নিয়ে। সিপিএমের সাংগঠনিক শক্তি তলানিতে পৌঁছনোর পর, এইসব ভোটাররা সিপিএমের থেকে সরে গেছেন - যার বড় কারণ সিপিএম-এর সংগঠনগুলোর ওপর মমতা ব্যানার্জির তীব্র আক্রমণ। এর পরের স্টেজে তৃণমূলকে ভাঙ্গানোর কাজ চলছে বিজেপির। মনে রাখতে হবে, ত্রিপুরায় এভাবেই রাতারাতি সমস্ত কংগ্রেসকে গ্রাস করে ফেলেছিল বিজেপি। তাই, এক্ষেত্রে বাংলার মানুষকে বেছে নিতে হবে, তারা কোন শাসক এবং আরো প্রয়োজনীয়ভাবে কোন বিরোধী দলকে দেখতে চায়। যারা সামাজিক সমস্যাগুলোর কথা বলে, নাকি যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মতো ইস্যু নিয়ে লড়াই বাঁধায়। প্রশ্নটা ভীষণ সহজ, তবে উত্তরটা কঠিন।
Subscribe to:
Posts (Atom)