Sunday, March 01, 2020

প্রযুক্তি ও ভবিষ্যৎ ৩ (মেশিন লার্নিং ও অর্থনীতি)

গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রয়িকার কথা আমরা অনেকেই মোটামুটি জানি - সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার প্রধান দুটি কারন বলা হয় থাকে এ দু'টিকে। বাংলায় এদের নিয়ে অনেক ঠাট্টা, মস্করা, এমনকি গান পর্যন্ত লেখা হয়েছে - "...এমনকি পেরেস্ত্রয়িকাও থাকেনা" - চন্দ্রবিন্দুর "মঙ্গল গ্রহে" গানে। কিন্তু সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পিছনে অর্থনৈতিক কারণগুলো স্রেফ এই দুটি বিষয় ঘিরেই নয়। কয়েকটি মূল কারণ স্বরূপ বলা হয় - মিলিটারিতে অতিরিক্ত খরচ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েতের নিজের অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় অক্ষত এবং শক্তিশালী আমেরিকার বিনিয়োগের সাথে অসম লড়াই, ইত্যাদি। আর একটি কারণও ভীষণ জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেকাংশে মুখ্য - যেটা কিনা "সেন্ট্রাল প্ল্যানিং"-এর ব্যর্থতা।

সেন্ট্রাল প্ল্যানিং - যার অর্থ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। সোভিয়েতের "ঘোষিত কম্যুনিস্ট" বা "স্টেট্ ক্যাপিটালিজম"-এর মডেলে সেন্ট্রাল প্ল্যানিং-এর মস্ত বড় ভূমিকা ছিল। রাষ্ট্র ঠিক করতো কোথায় কত পরিমান খাদ্য এবং দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন হবে ও সরবরাহ হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারেনি, এর কারণ যেসব আধিকারিকরা ডিমান্ড এবং সাপ্লাইয়ের এই তথ্য রাষ্ট্রর কাছে পাঠাতেন - তাতে গলদ থাকতো। তাঁরা নিজেদের গা বাঁচাবার জন্য অনেকসময় ভুল তথ্য নথিভুক্ত করতেন। এছাড়া মূল অভিযোগ করা হয় যে, রাষ্ট্রের পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয় - কোন্ কোন্ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন কাঁচামাল কোথায় পাঠানো উচিত, বা কোনো সামগ্রী কতটা উৎপাদন করা উচিত। রাষ্ট্র এতসব তথ্য জোগাড় করতে এবং অনুমান করতে অক্ষম। তাই রাষ্ট্রের পক্ষে এরকম কেন্দ্রীয়ভাবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করাটা অবাস্তব। মার্কেট বা বাজারের হাতেই অর্থনীতির এই কাজটাকে ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে দাবী করা হয়। 

এবার আমরা চলে আসি আজকের যুগে, এখনকার বাস্তবে। এখন আমাদের কাছে ডিজিটাল মিডিয়ামের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা এবং সেই data analyze করা খুবই সহজ থেকে সহজতর হতে শুরু করেছে। মূলত কম্পিউটারের বিশাল উন্নতির কারণে এই কাজ খুব সহজেই করে ফেলা যাচ্ছে। ফলে প্রত্যন্ত গ্রামে কতটা ধান উৎপাদন বা আলু চাষ করলে, বড় বড় শহরের খাবারের চাহিদা মেটানো যাবে, সে সম্পর্কে অনেক বেশি সঠিকভাবে অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মানুষ ঠিক কোন ধরণের খাবার, সামগ্রী বেশি কিনছেন, চাইছেন, সে সম্পর্কেও আমরা খুব সহজে তথ্য পেয়ে যাচ্ছি আজকের ডিজিটাল যুগের কারণে। আপনি বিগ বাজার থেকে যখন মাসে ১ কেজি ডাল বা ৫ কেজি চাল কিনছেন, তখন তা একটি সার্ভারে ক্রমাগত নথিভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। সেই তথ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছানোও যাচ্ছে খুব দ্রুত। তবে এর পরেও অনেক কিছুই শুধুমাত্র মানুষের খাতা-পেনের ক্যালকুলেশনে বলে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এখানেই সহায়তা করতে পারে মেশিন লার্নিং। মেশিন লার্নিং-এর সাহায্যে মানুষের কেনাকাটার তথ্য থেকে অনুমান করা যেতে পারে জনগণের চাহিদার প্রকৃতি কিরকম, তাদের জিনিসপত্র কেনার প্যাটার্ন কিরকম। তারপর আমরা সেরকম দ্রব্যসামগ্রী তৈরী করার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারি। 

এটা যে আমি কোনো বায়বীয় তত্ত্ব বলছি, তা নয়। ওপরে বলা আমার বক্তব্যের বাস্তব প্রয়োগ করে চলেছে, আমার-আপনার চেনা একটি জনপ্রিয় কোম্পানি। Amazon। Amazon-এর একটি বিজনেস মডেলের ব্যাপারে সে জন্য জানা দরকার। Amazon-এ বিভিন্ন বিক্রেতা তাঁদের জিনিস বিক্রি করে থাকেন। ধরুন একটা ফ্রিজ। বিভিন্ন বিক্রেতা বিভিন্ন ধরণের ফ্রিজ বিক্রি করে থাকেন Amazon.com-এ। মানুষ তাঁদের চাহিদা মতো বিভিন্ন ধরণের ফ্রিজ কিনে থাকেন। কোনোটায় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের উপায় থাকে, কোনোটায় ফ্রিজারটা বড় হয় - এরকম হাজারো প্যারামিটার থাকে। কোন্ ক্রেতারা কোন্ ফ্রিজ কিনছেন, কোন্ ধরণের বৈশিষ্ট্যের ফ্রিজ তাঁদের ভালো লাগছে, তাঁরা ফ্রিজটিকে কেনার আগে কতক্ষন ধরে পরীক্ষা করছেন - Amazon এইসব তথ্যই জোগাড় করতে থাকে। এরপরে মোটামুটি সর্বাধিক ক্রেতাদের চাহিদা মতো একটি ফ্রিজ Amazon নিজেই বানানো শুরু করে। এই নতুন ফ্রিজটিকে তারা নিজেদের একটি ব্র্যান্ড দেয় - AmazonBasics. এরপর Amazon এই নতুন ফ্রিজটিকে অন্য সব বিক্রেতাদের থেকে একটু কম দামে বেচতে শুরু করে। সাথে সাথেই Amazon সম্ভাব্য ক্রেতাদের AmazonBasics-এর তৈরী করা সামগ্রীই কেনার জন্য রেকমেন্ড করতে শুরু করে তাদের প্ল্যাটফর্মে। আর যেহেতু Amazon-এর কাছে তাঁদের ক্রেতাদের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে ডেটা আগে থেকেই আছে, তাই তারা খুব সহজে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছেও যেতে পারে, মেশিন লার্নিং-কে কাজে লাগিয়ে। ফলত অন্য সব বিক্রেতা বাজার থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়, কারণ তাঁরা Amazon-এর সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠে না। Amazon খুব সহজেই ক্রেতাদের মনের মতো সামগ্রী, তাঁদের সূক্ষ বিশ্লেষণের মাধ্যমে, ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। এভাবে বাজারে তারা একরকম মনোপলি তৈরি করে।

এই একই মডেল যদি আমরা এনে ফেলি সেন্ট্রাল প্ল্যানিং-এ, তাহলে দেখবো তা Amazon-এর strategy-এর থেকে খুব একটা আলাদা তা নয়। Amazon তার সফল মডেলের জেরে বিশ্বের ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানি। কিন্তু আমাজন একটি প্রাইভেট কোম্পানি, ফলে তার লভ্যাংশ শুধু কোম্পানির মালিকেরাই পেয়ে থাকেন - প্রধানত জেফ বেজোস। অথচ সেন্ট্রাল প্ল্যানিং-এ যদি আমরা মেশিন লার্নিং-এর মডেল আনতে পারি, তাহলে সেটা একটা বৃহত্তর সমাজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তখন আমাদের খাদ্য, ব্যবহারযোগ্য সামগ্রীর অহেতুক অপচয় বন্ধ হতে পারে। আমাদের খুব দক্ষ প্রোডাকশন সিস্টেম মেশিন লার্নিং-এর সাহায্যে যতটা দরকার ঠিক ততটাই দ্রব্য উৎপাদনের উপযুক্ত হতে পারে। শুধু তাই নয়, আমরা যদি আবহাওয়ার কথাও এখানে চিন্তা করি, তাহলে কিভাবে প্রকৃতিকে নষ্ট না করে দ্রব্য উৎপাদন করা যেতে পারে, সেদিকেও মেশিন লার্নিং যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। যেমন করে আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে মেশিন লার্নিং এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে Bill and Melinda Gates Foundation পোলিও এবং অন্য রোগ দূরীকরণের কাজ সাফল্যের সাথে করেছেন। তাই আমাদের কাছে জনসাধারণের উন্নতির উদাহরণও যে নেই তা নয়। 

বর্তমানে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কগুলি বিভিন্ন ইকোনোমিক ডেটা সংগ্রহ করে' দেশীয় ব্যাঙ্কগুলির বেস ইন্টারেস্ট রেট নির্ধারণ করে। চীন একধাপ এগিয়ে তাদের দারিদ্র্য দূর করার জন্য মেশিন লার্নিংয়ের ব্যবহার করা শুরু করেছে, খাদ্য সরবরাহ এবং উৎপাদনের জন্য। আমাদের লক্ষ্য থাকা উচিত যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যেসব দেশগুলি চলছে, সেগুলির সরকারও ক্রমশ যাতে জনগণের জন্য টেকনোলজির ব্যবহার করা শুরু করে। যে প্রযুক্তির ব্যবহার আমরা প্রতিরক্ষা এবং মিলিটারি ক্ষেত্রে খুব সহজেই করে থাকি, সেই প্রযুক্তিই দ্রুত সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক এবং দৈনন্দিন স্বার্থে ব্যবহার করা দরকার। চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আলেন্দের আমলে Project Cybersyn নামক এক পরিকল্পনায় অনেকটা এই কাজটাই করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তখন প্রযুক্তি এবং ডেটা সংগ্রহ আজকের স্তরে না পৌঁছানোয়, সেই কাজ পুরোপুরি সফল হয়নি। আজ আমাদের প্রযুক্তি এবং সমাজ এই পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য মূলত প্রস্তুত। বামপন্থী দলগুলোর এই ধারণাগুলোকে আবার একবার তাই ফিরে দেখা দরকার। যেভাবে প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ মেশিন লার্নিংকে কাজে লাগাচ্ছে, সেভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও যদি মেশিন লার্নিং-এর সাহায্য নিয়ে ইকোনোমিক প্ল্যানিং-এর দিকে এগোতে পারে, তবে বাস্তব জীবনে টেকনোলজির এক বিরাট প্রয়োগ ও ফলস্বরূপে সাধারণের উন্নতির প্রভূত সম্ভাবনা আছে।