ভারতীয় সময় ভোর থেকে সকালের দিকে অস্ট্রেলিয়া-ইন্ডিয়ার ক্রিকেট হচ্ছিল, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। বেশ কয়েকবছর পর এভাবে সকালের দিকে খেলা দেখছিলাম। আর সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে যাচ্ছিল, কয়েকবছর আগের এইভাবে সকালবেলা খেলা দেখা। এই বর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে প্রকৃত ক্রিকেটীয় স্কিলের একটা লড়াই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের ক্রিকেটে যে একটা মেকি লড়াইয়ের আবহ থাকে, অস্ট্রেলিয়ার সাথে এই সিরিজে সেটা থাকে না। তাই সেই প্রথম থেকেই এই সিরিজের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। শীতের সকালে উঠেই খেলা দেখার মধ্যেই একটা মজা ছিল, কারণ ভারতে শীতের ক্রিকেট অবধারিতভাবে শিশির, কুয়াশার কারণে দেরিতে শুরু হয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় সেই সমস্যা নেই। ফলে সকালে পড়তে বসার আগে খেলা দেখা যেত, আর অঙ্ক করার সাথে সাথেও খেলা দেখার অনুমতি পাওয়া যেত। কিন্তু এগারোটার স্কুলের জন্য বেরিয়ে যেতে হতো দশটার মধ্যে, তার আগে খেতে খেতে যতটা পারা যায় ক্রিকেটের সাথে ভাত মিশিয়ে খেয়ে বেরিয়ে যেতাম। রাস্তায় বাসে বেশিরভাগ সময়ই রেডিও চলতো, সেখানে গানের মাঝে মাঝে স্কোর বলতো। কখনো হয়তো মীর-ই বলতেন। সেটা শুনতে শুনতে স্কুলে পৌঁছতাম। ওটাই মোটামুটি শেষ খবর পাওয়া, তারপর আর বিশেষ খবর পাওয়া যেত না। এখন মনে পড়ছে না, তবে টিচার্স রুমে একটা ছোট টিভির ব্যবস্থাও মাঝে হয়ে থাকতে পারে। মোবাইল ফোনের কোনো অস্তিত্ব স্কুলজীবনে ছিল না, ফলে ক্রিকেটীয় লড়াইটাকে অনেক বাধা আর সংশয় নিয়ে মনের মধ্যে বন্ধ করে রাখতে হতো। আর সংশয়ের যথেষ্ট কারণও ছিল।
২০০৩-০৪-এ সৌরভের সেঞ্চুরি দিয়ে টেস্ট সিরিজ শুরু হচ্ছে। পরে জানা যাচ্ছে, গ্রেগ চ্যাপেলের ব্যাটিং টিপস-এই সৌরভের অমন দুর্দান্ত ব্যাটিং, এমনকি অস্ট্রেলিয়ার পেস বোলিং-এর বিরুদ্ধেও, যেটা দাদার কমফোর্ট জোন একেবারেই নয়। সেই সেঞ্চুরিই ওই সিরিজের মুড্ ঠিক করে দিলো। পরে আমরা সিরিজে ১-১ করে এই আজকের সিডনিতেই খেলতে নামলাম, মনে একরাশ আশা আর সংশয় নিয়ে। স্টিভ ওয়ার ফেয়ারওয়েল ম্যাচ, কিন্তু খেললেন ক্রিকেটের ভগবান। এই এবারের সিডনি টেস্টের মতোই আমরা প্রচুর রান করেছিলাম, ৭০০-এর ওপর। কিন্তু বাকিটা খানিকটা উৎকণ্ঠা আর কিছুটা সাদামাটা, সেখানে স্টিভ ওয়ার শেষ ইনিংসের ম্যাচ বাঁচানো আছে। সিডনিতে ড্র হওয়ার জন্য আমরা সিরিজ ড্র-ই করতে পারলাম, জেতা হলো না। কিন্তু ২০০৩ ওয়ার্ল্ড কাপে যে একটি টিমের বিরুদ্ধে আমরা হেরেছিলাম, সেই তাদের দেশের মাটিতে এসেই তাদের অন্যতম সেরা টিম লাইন-আপের বিরুদ্ধে কতৃত্বের সাথে সিরিজ ড্র করার মানে - ক্রিকেটে ভারতের গরিমা অন্য স্তরে পৌঁছলো। ২০০৪-এ সিডনিতে এরকম একটা জায়গায় আমরা শেষ করলেও, ২০০৭-০৮-এর সময়ের সিডনি খুব একটা সুখকর ছিল না।
তখন আমাদের উচ্চমাধ্যমিকের সময়। দাদার ক্যাপ্টেন্সি চলে যাওয়ার বেদনা কাটিয়ে উঠেছি অনেকটাই। দ্রাবিড়ের থেকে বেরিয়ে এসে কুম্বলের অধিনায়কত্ব মেনে নিচ্ছি মনে মনে। লোকটাকে বেশ ভালোমানুষ মনে হচ্ছে। সাথে ক্রিকেটীয় বুদ্ধিতে তো শানিত বটেই। সেবারে সিডনিতে ০-১ অবস্থাতে আমাদের প্রবেশ। সেই ম্যাচের মধ্যেই এতো নাটকীয়তা, সাইমন্ডস-হরভজন-মাঙ্কিগেট-রেসিজম। এবং এসবের পরেও অস্ট্রেলিয়ার প্লেয়ার এবং আম্পায়ারদের চূড়ান্ত অপেশাদারিত্ব। আম্পায়ার রিকি পন্টিংকে জিজ্ঞেস করছেন, সৌরভ আউট কিনা, এবং পন্টিং "হ্যাঁ" বলাতে আউট দিয়ে দিচ্ছেন। সে এক হাস্যকর এবং সাথে সাথেই প্রচন্ড রেগে যাওয়ার ঘটনা। আমরা সেবার দুই ইনিংসেই বেশ ভালো খেলছিলাম (এক্ষেত্রে "আমরা" মানে দাদা)। সেবারে হেরে যাওয়ায় কুম্বলের জন্য আরো বেশি করে খারাপ লেগেছিল, অন্তত ওঁর জন্য ম্যাচ আর সিরিজ দুটোই জিতলে ভালো লাগতো।
তবে সেবারের ইচ্ছে প্রায় দশ-এগারো বছর পরে এবারে সম্পূর্ণ হল। ভিরাট কোহলি যোগ্য ক্যাপ্টেন-ব্যাটসম্যান হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জিতলেন। সেটা ঘটলো এই সকালের খেলা দেখার মাঝে মাঝেই, কিছুটা কো-ইনসিডেন্টালি। মাঝের কিছু "ঠান্ডা" কর্তৃত্বে ভারত টেস্ট ক্রিকেটে কিছুটা ঠান্ডাই হয়ে গেছিল, তখন ক্রিকেট দেখতামও না। সেই শীতলতা অবসর নেওয়ার পর, ভিরাট আমাদের পুরনো আগ্রাসনের দুনিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। এটাই ২০০৩/০৪ এবং ০৭/০৮-এর সঠিক গতিময় ভবিষ্যত, যার মধ্যে শীতকাল থাকলেও কোনো "ঠান্ডা" আবহাওয়া নেই। শীতের কুয়াশা কেটে গিয়ে উজ্জ্বল রোদ উঠছে।